সুদীর্ঘ মোগল রাজত্বকাল শুধু সাম্রাজ্য বিস্তার ও সাম্রাজ্য শাসনের জন্যই নয়, শিল্পকলা ও সাহিত্য সৃষ্টির জন্যও ভারতের ইতিহাসে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেছে।
শিল্পকীর্তি:
ঔরঙ্গজেব ব্যতীত অন্য মোগল সম্রাটগণ সকলেই ছিলেন সৌন্দর্যপ্রিয় ও শিল্পরসিক। তাঁরা পারসিক শিল্পরীতির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতায় স্থাপত্য ও চিত্রশিল্পে অভাবনীয় উন্নতি হয়। সুলতানি আমলের শিল্পরীতিতে যে সমন্বয়ের সূচনা হয়, মোগল আমলে তা পূর্ণতা লাভ করে। সাম্রাজ্যের সর্বত্র শান্তি শৃঙ্খলা ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি শিল্পচর্চার সহায়ক হয়েছিল।
প্রথম দুজন মোগল সম্রাটের আমলে কোনো উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য-কীর্তি নেই। আফগান সম্রাট শেরশাহ শিল্পরসিক ছিলেন। তাঁর স্বল্পকালীন আফগান শাসনকালের মধ্যে শিল্পকীর্তি হল দিল্লির পুরানা কেল্লা ও সাসারামের স্বনির্মিত সমাধি সৌধ।
প্রত্নতত্ত্ববিদ জন মার্শালের মতে, দেশের বিশালতার কারণে ভারতের এক এক অঞ্চলে এক এক রকম শিল্পরীতি গড়ে ওঠে।
শিল্প সৃষ্টির ক্ষেত্রেও আকবর উদার মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু-মুসলমান শিল্পাদর্শের পূর্ণ বিকাশ হয়। আকবরের আমলে স্থাপত্য শিল্পে পারসিক প্রভাব অটুট ছিল। তারপর থেকেই ভারতীয় প্রভাব লক্ষ করা যায়। দিল্লি, আগ্রা, ফতেপুর সিক্রিতে নির্মিত প্রাসাদ, বুলন্দ দরওয়াজা, পাঁচমহল, ইবাদতখানা, যোধপুরিমহল, সেলিম চিস্তির সমাধি, হুমায়ুনের সমাধি প্রভৃতি ছিল তাঁর আমলের শিল্প-স্থাপত্য কীর্তি, সেকেন্দ্রাবাদে রয়েছে তাঁর নিজের সমাধি সৌধ।
শাহজাহান ছিলেন এই রাজবংশের শ্রেষ্ঠ রসিক। শিল্প সাধনা ছিল তাঁর জীবনের স্বপ্ন, আলংকারিক কারুকার্য ছিল তাঁর স্থাপত্য শিল্পের বৈশিষ্ট্য। দিল্লির দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস, মোতি মসজিদ, জামা মসজিদ, লালকেল্লা প্রভৃতি এবং আগ্রা দুর্গ এই শিল্পরীতির অপূর্ব নিদর্শন। তাঁর শিল্প সৃষ্টির অনন্য কীর্তি তাজমহল মর্মরের বেদনা-স্বপ্ন। আগ্রায় মমতাজ বেগমের কবরের ওপর নির্মিত মসৃণ শ্বেত পাথরের তাজমহল আজও শিল্প রসিকদের কাছে বিস্ময়। শাহজাহানের ময়ূর সিংহাসন শিল্পসৃষ্টির আর এক অপূর্ব নিদর্শন।
ঔরঙ্গজেব ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য দিল্লিতে একটি মর্মর প্রস্তরের মসজিদ নির্মাণ করেন।
হিন্দু স্থাপত্য:
শাহজাহানের রাজত্বকালে হিন্দু মন্দির নির্মাণ নিষিদ্ধ ছিল। ধর্মান্ধ ঔরঙ্গজেব কয়েকটি হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেন। তা সত্ত্বেও ধর্মীয় আবেগ প্রবণতায় দেশের বিভিন্ন স্থানে কিছু হিন্দু মন্দির নির্মিত হয়। মোগলরীতির পাশাপাশি এগুলি ছিল হিন্দু শিল্পরীতির উজ্জ্বল নিদর্শন। এই মন্দিরগুলির মধ্যে মানসিংহ নির্মিত বৃন্দাবনের মন্দির ও বীরসিংহ বুন্দেলা নির্মিত মথুরার কেশব দেও-এর মন্দির বিখ্যাত।
মোগল চিত্রকলা:
স্থাপত্যের ন্যায় মোগল সম্রাটগণ চিত্রশিল্পেরও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। যথারীতি এই শিল্পেও ভারত-বহির্ভারতের শিল্পকলার সমন্বয় হয়েছিল। মোগল চিত্রকলার মধ্যে দরবার ও শিকারের চিত্রগুলি ছিল বিখ্যাত। সম্রাটদের মধ্যে জাহাঙ্গির ছিলেন চিত্রকলার পরম পৃষ্ঠপোষক ও সমঝদার।
শিক্ষা, সাহিত্য, ইতিহাস-মোগল যুগে বিশেষত আকবরের আমলে শিক্ষার ব্যাপক প্রসার হয়। আরবি, ফারসি ও সংস্কৃত ভাষার যথেষ্ট চর্চা হত। মোগল সম্রাটদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন সাহিত্য রসিক ও সাহিত্য স্রষ্টা। বাবরনামা, হুমায়ুননামা, আকবরনামা, তুজুক-ই-জাহাঙ্গিরি, ফতোয়া-ই-আলমগিরি গ্রন্থ থেকে ওই লেখক-সম্রাটদের সাহিত্য দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। এই যুগে স্ত্রী-শিক্ষার যথেষ্ট বিস্তার লাভ হয়।
মোগল আমলে সাহিত্য ক্ষেত্রেও মননশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়। যুবরাজ দারাশিকো যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে ফারসি ভাষায় উপনিষদ অনুবাদ করেন। শাহজাহান দুহিতা জাহনারা ও ঔরঙ্গজেব দুহিতা জেবউন্নিসা ফারসি ভাষায় কবিতা রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন।
ইতিহাস এবং দর্শনও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে। বাবর ও জাহাঙ্গির আত্মজীবনী লেখেন। এই যুগে আবুল ফজলের আকবরনামা ও আইন-ই-আকবরি, বদাউনির মুস্তাখিবা-উৎ-তারিখ প্রভৃতি গ্রন্থগুলি মোগল ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল। কাফি খাঁ ছিলেন এই যুগের আর এক খ্যাতিমান ঐতিহাসিক।
সংগীত:
সংগীতের প্রতি মোগল সম্রাটদের পরম অনুরাগ ছিল। আকবর ছিলেন হিন্দুস্তানি সংগীতের পরম পৃষ্ঠপোষক। শোনা যায়, সম্রাট নিজেই কয়েকটি সুর সৃষ্টি করেন। তানসেন ছিলেন সমকালীন ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠতম সংগীতজ্ঞ। আকবরের দরবারে আরও বত্রিশজন গায়ক ছিলেন; এঁদের মধ্যে বাবা রামদাস, বৈজু বাওড়া, সুরদাস প্রভৃতির নাম করা যায়। জাহাঙ্গির ও শাহজাহান সংগীত চর্চা করতেন। শাহজাহানের দরবারে গায়কদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রামদাস, মহাপত্তর, লাল খাঁ প্রভৃতি।
আঞ্চলিক সংস্কৃতি:
মোগল যুগে আঞ্চলিক সংস্কৃতির বিকাশ এক বিশেষ স্থান অধিকার করেছে। হিন্দু-মুসলমানের সমন্বয়ীভাব এই সংস্কৃতিকে উচ্চাসনে বসায়।
১। বাংলার স্থাপত্য:
এই সময়ে বাংলায় বহু মসজিদ, সমাধিসৌধ, তোরণ নির্মিত হয়। সুলতানি আমলের শিল্পরীতির ধারাবাহিকতা এগুলিতে অক্ষুণ্ণ থাকে। মালদহের জাম-ই মসজিদ, ঢাকার কতলব খাঁর মসজিদ, নারায়ণগঞ্জের বিবি মরিয়মের মসজিদ, চট্টগ্রামের বায়াজিদ দরগা বাংলার নিজস্ব স্থাপত্য গঠন শৈলীর নিদর্শন।
২। দক্ষিণ ভারত:
মোগল যুগে দক্ষিণ ভারতের স্থাপত্য-শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন বিজাপুরের গোলগম্বুজ। এর পরিধি রোমের পন্থিয়ন-এর চেয়ে বড়ো।
৩। রাজপুত চিত্রকলা:
পাঞ্জাবের কাংড়া অঞ্চলে রাজপুত শিল্পকলার নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। এই চিত্রকলার বিষয়বস্তু ছিল মহাকাব্য ও পুরাণের ঘটনাবলি। কাংড়ার নাম অনুসারে এই শিল্পরীতি কাংড়া চিত্রকলা বা পাহাড়ি চিত্রকলা নামে পরিচিত।
৪। সাহিত্য:
(ক) হিন্দি:
মোগল আমলে হিন্দি সাহিত্য বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করে। গোস্বামী তুলসীদাসের রামচরিত মানস, কবীরের দোঁহা সুরদাস ও বীরবলের কবিতা হিন্দি সাহিত্যের মান উন্নত করে। আকবরের সময় থেকে হিন্দি কবিরা মোগল রাজদরবারে সমাদর পেতেন।
(খ) উর্দু:
হিন্দি ও পারসিক সংমিশ্রণে উদ্ভূত উর্দু সাহিত্য মোগল আমলের এক বিশেষ অবদান। অচিরেই আরবি-ফারসির কাঠিন্য ছেড়ে সাধারণ মুসলমান এবং হিন্দুদেরও একাংশের মধ্যে কথা ও সাহিত্য সৃষ্টির ভাষা হিসাবে উর্দু গুরুত্ব লাভ করল।
(গ) বাংলা:
মোগল যুগে প্রধানত বৈষ্ণব সাহিত্যের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যের বিকাশ লক্ষ করা যায়। এই বাঙালি বৈষ্ণব লেখকদের মধ্যে চৈতন্যচরিতামৃত রচয়িতা কৃষ্ণদাস কবিরাজ, চৈতন্যমঙ্গল রচয়িতা জয়ানন্দ এবং ভক্তি রত্নাকর রচয়িতা নরহরি চক্রবর্তী বিখ্যাত। এছাড়া কাশীরাম দাসের বাংলা মহাভারত, কবি মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল, ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির উৎকর্ষের পরিচায়ক। বাউল সংগীত হিন্দু-মুসলমানের ঐকতানের প্রতীক রূপে আবির্ভূত হয়।
(ঘ) মারাঠি:
মোগল যুগে রামদাস, তুকারাম প্রভৃতির রচনা মারাঠি সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছিল। আঞ্চলিক ভাষা ও সাহিত্যগুলি ছিল ওই অঞ্চলের মানুষের নিজস্ব চিন্তাভাবনার ধারক ও বাহক। আঞ্চলিক শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই আঞ্চলিক ভাষা ও সাহিত্য বিকশিত হয়।
উপসংহার:
সুলতানি আমলে হিন্দু-মুসলমান সংস্কৃতির মধ্যে যে আদান-প্রদান শুরু হয়, মোগল আমলে তা আরও ঘনিষ্ট হয়। সর্বভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐক্য যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। গ্রামাঞ্চলে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে মেলামেশা অনেক সহজ, সরল হয়ে ওঠে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন