উত্তর ভারতের অর্থনৈতিক জীবন
কৃষি
খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে ভারতের প্রথম সাম্রাজ্য মগধের ভিত্তি ছিল কৃষি অর্থনীতি। কৃষিকার্যই ছিল দেশের বেশিরভাগ মানুষের প্রধান জীবিকা। কৃষির উন্নতির সঙ্গে বিভিন্ন কুটির শিল্প গড়ে ওঠে। কৃষি-অর্থনীতির জন্যই শিল্প ও ব্যাবসা-বাণিজ্যের বিশেষ উন্নতি সম্ভব হয়েছিল।
কৃষক
মৌর্যযুগে সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণি কৃষকদের অবস্থা ভালোই ছিল। যুদ্ধ ও অন্যান্য কাজের, দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেত বলে তারা কৃষিকাজে বেশি শ্রম দিতে পারত। ফলে মৌর্যযুগে কৃষি উৎপাদন অনেক বেড়ে যায় এবং কৃষিজ দ্রব্যের মূল্য যথেষ্ট কম ছিল।
পশুপালন
মৌর্যযুগে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে পশুপালনের স্থান ছিল দ্বিতীয়। গো-সম্পদ বিশেষভাবে সমাদৃত হত। গ্রাম্যপরিবেশের বৃহৎ অংশ জুড়ে ছিল পশুচারণ ক্ষেত্র। অশোক তাঁর শিলালিপিতে পশু হত্যা নিবারণের উদ্দেশ্যে আপত্তিকর সামাজিক অনুষ্ঠান ও বৈদিক যজ্ঞ নিষিদ্ধ করেন। তিনি পরোক্ষভাবে বনসংরক্ষণের কথা বলেন।
শিল্প
খ্রিস্ট-পূর্ব চতুর্থ শতাব্দী থেকে শিল্পের যথেষ্ট উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। মেগাস্থিনিস পাটলিপুত্র নগরে শিল্পজাত দ্রব্যের উৎপাদন ও তত্ত্বাবধানের জন্য একটি পৃথক বোর্ডের উল্লেখ করেছেন। গ্রিক লেখকরা অস্ত্র, কৃষি উপকরণ ও জাহাজ নির্মাণের উল্লেখ করেছেন। তত্ত্ববায়, কর্মকার, জুতোর পেশা বিশেষ রাজানুগ্রহ লাভ করত। সোনা, রূপো, তামা, লোহা ও টিন ব্যবহার করে বিভিন্ন অলংকার ও জিনিসপত্র তৈরি করা হত। ধনীরা স্বর্ণালংকার ছাড়াও হাতির দাঁতের অলংকার ব্যবহার করত।
মৌর্যযুগে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন শিল্প গড়ে উঠেছিল। মথুরা, বারাণসী ও উজ্জয়িনী বস্তু শিল্পের জন্য এবং গান্ধার পশম শিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। বঙ্গদেশে উৎকৃষ্ট তুলো ও বস্ত্র শিল্পের উল্লেখ আছে পেরিপ্লাস গ্রন্থে। লোহার খনি ছিল মগধে, তামার খনি ছিল রাজপুতনায়। সোনা ও মূল্যবান পাথর জোগান দিত দক্ষিণ ভারত। লবণ উৎপন্ন হত পাঞ্জাবের সন্ট রেঞ্জে।
স্থানীয় বিভিন্ন গ্রামে এমনকি শহরগুলির বিভিন্ন সরণিতে শিল্প প্রসার লাভ করেছিল। কোনো গ্রাম ছিল কুম্ভকারের, কোনো গ্রাম ছিল কর্মকারের। শহরের কোনো রাস্তায় তাঁতি, কোনো রাস্তায় রঞ্জনশিল্পী, কোনো রাস্তায় হাতির দাঁতের কারিগরের কাজকর্ম ও বাস ছিল।
মৌর্য পরবর্তী সময় খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে কারিগরি নৈপুণ্য আরও উন্নত হয়। ধাতুশিল্পী ও ঢালাই কারখানার কারিগরদের বিশেষ খ্যাতি ছিল।
প্রাচীন ভারতে বাণিজ্য ও শিল্পকে কেন্দ্র করে বণিক সংগঠন গড়ে উঠেছিল, এদের বলা হয় শ্রেণি বা 'গিল্ড'। প্রাচীন সাহিত্যে এর সমার্থক 'গণ' ও 'সংঘ' শব্দ পাওয়া যায়।
শ্রমিক
এই সময়ে শ্রমিকদের মোটামুটি দু'টি শ্রেণি ছিল-ক্রীতদাস শ্রমিক ও ভাড়াটে শ্রমিক। ভাড়াটে শ্রমিকদের মধ্যে যারা দক্ষ তারা তুলনামূলকভাবে ভালো মজুরি পেত। নগদে বা খালো এই মজুরি দেওয়া হত। পরবর্তীকালে অবশ্য মজুরদের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকে, শিল্পের ওপর রাজার নিয়ন্ত্রণ বাড়তে থাকে।
দক্ষিণ ভারতের অর্থনৈতিক জীবন
পল্লব (৩৫০ খ্রিঃ-৮৯১ খ্রিঃ) ও চালুক্য (৫৩৫ খ্রিঃ-৭৪৬ খ্রিঃ)
দক্ষিণের পল্লব ও চালুক্য রাজ্যে গাঙ্গেয় উপত্যকার মতো বিশাল উর্বর ভূমি না থাকায় এই অঞ্চলে কৃষিনির্ভর অর্থনীতি গড়ে ওঠেনি। এইসব রাজ্যে শিল্পও বিশেষ গড়ে ওঠেনি। ফলে পল্লব ও চালুক্য অর্থনীতি বহির্বাণিজ্যের ওপরই ক্রমশ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। এই দুটি রাজ্যে জমির মালিক ছিলেন রাজা। রাজকর্মচারীদের ও সৈন্যবাহিনীকে নগদ বেতনের পরিবর্তে জমি দেওয়া হত। চাষিরা রাজস্বদানের শর্তে কৃষি জমি নিত। তবে এই দুটি দেশে কৃষির তুলনায় বৈদেশিক বাণিজ্যের গুরুত্ব ছিল বেশি। পরবরা নৌবহরের সাহায্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন।
চোল (৯৮৫ খ্রিঃ-১১২০ খ্রিঃ)
দক্ষিণ ভারতে চোল সাম্রাজ্যে কৃষি জমির ওপর কর ছিল রাজস্ব আদায়ের প্রধান উৎস। স্বায়ত্তশাসিত গ্রামগুলি ভূমিকর নিজেরাই সংগ্রহ করত। চোল আমলে সাধারণ মানুষের ওপর করের বোঝা ছিল যথেষ্ট বেশি। তবে কৃষি জমির ফলন কমে গেলে জমির করও কমানো হত। চোল সাম্রাজ্যের মন্দিরগুলি ছিল অর্থভাণ্ডার। চোল সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক জীবনে বৈদেশিক বাণিজ্যের বিশেষ ভূমিকা ছিল। চোল বণিকেরা বৈদেশিক বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রচুর সম্পদ লাভ করে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন