ফুল ফুটুক না ফুটুক কবিতাটিতে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জীবনবোধের পরিচয়



ভূমিকা

'ফুল ফুটুক না ফুটুক' কবিতাটিতে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মানবিকতাবোধের চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বলা যেতে পারে। কবিতাটিতে কয়েকটি অনুষঙ্গ এসেছে। যেমন- কঠিন বাস্তবের পটভূমি, জীবন সংগ্রামের ক্ষেত্র, সেই সংগ্রামের ভেতর দিয়ে সফলতা অর্জনে কবির দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় ইত্যাদি। 

কবিতাটির বিষয়বস্তু 

কবিতাটির প্রথমেই কঠিন বাস্তবের পটভূমি রচনা করেছেন, শান বাঁধানো ফুটপাতে একটি গাছের অস্তিত্ব রক্ষার আপ্রাণ প্রয়াসে।পাথরে পা ডোবানো গাছটি নিজের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি রস পায় না। কবি তার মধ্যেও আত্মপ্রত্যয় ঘোষণা করতে দ্বিধাবোধ করেননি-

"ফুল ফুটুক না ফুটুক
আজ বসন্ত।"

এখানে কাঠখোট্টা গাছকে সংগ্রামী মানুষের প্রতীক রূপে কল্পনা করা হয়েছে। আর বসন্তের মধ্য দিয়ে কবি সফলতার আশ্বাসকে প্রতিধ্বনিত করেছেন। এ যেন কবি শঙ্খ ঘোষের ভাষায় "সমাজ বিপ্লবের স্বপ্ন পূর্ণ হবার দীপ্ত ভরসা।" অর্থাৎ সংগ্রামী মানুষের মাথা উঁচু করে রাখার স্পর্ধা ফুটে উঠেছে এখানে।

এরপর কবি আমাদের একটি আইবুড়ো মেয়ের ভাবনার মধ্যে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিচিত্রগুলো তুলে ধরেছেন। সময়ের মধ্যে যেমন অন্ধকার মৃত্যুতে মাখামাখি দিনগুলো দূর হয়ে যাচ্ছে, তেমনই হারিয়ে যাচ্ছে সময়ের সঙ্গে কোকিল ডাকা হরবোলা ছেলেটা আইবুড়ো মেয়েটার জীবন থেকে। কিন্তু কবি এখানেই থেমে থাকেননি। তিনি আমাদেরকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন জীবন জিজ্ঞাসার ভেতরে।

গায়ে হলুদ দেওয়া এক কালো কুশ্রী আইবুড়ো মেয়ের বেদনা বিধুর স্মৃতি কাতরতার ছবি আঁকার সঙ্গে সঙ্গে অঙ্কিত হয়েছে লক্ষ্মীছাড়া প্রজাপতির আগমন, আর তার মধ্যেই দড়াম করে দরজা বন্ধ করে দেয় মেয়েটি।

"ঠিক সেই সময়
চোখের মাথা খেয়ে গায়ে উড়ে এসে বসল
পোড়ার মুখ লক্ষ্মীছাড়া প্রজাপতি
তারপর দড়াম করে দরজা বন্ধ হবার শব্দ।"

মেয়েটি এরপর পলায়ন করে। এমন ভাবে পলায়নে জীবনধর্মকে অস্বীকার করা হয় - এই কথাটি অনুচ্চারিত রাখেন কবি। কিন্তু অনুচ্চারিত কথাটি আমরা বুঝি জীবন সংগ্রামে চরিতার্থ কাঠখোট্টা গাছের মুখচাপা কৌতুকের হাসিতে। কৌতুকের হাসিতে গাছটি বুঝিয়ে দেয় যে জীবনে গ্লানি আছে, প্রতিকূলতা আছে কিন্তু এই জীবনের ভূমিতে দৃঢ় পায়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে সফল করাই হচ্ছে প্রাণধর্ম।

আসলে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী মানবতাবাদী কবি বহির্বিশ্বের সঙ্গে প্রাণের স্পন্দনের যোগসূত্র গড়ে তুলতে সমাজ বদলানোর প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। আইবুড়ো মেয়েটি মায়ার বন্ধন শিথিল করার জন্য প্রজাপতির আগমনে দরজা বন্ধ করে দেওয়ার পর দড়ি পাকানো গাছের মুখ চাপা হাসির মধ্যে এই কথাটিই যেন ব্যক্ত করতে চেয়েছেন। ভীরুতা ও পলায়ন যে কাঙ্ক্ষিত নয়, জীবনধর্মী মনোবৃত্তি নয়, তা প্রকাশ পায় ওই গাছটার আচরণের মধ্য দিয়ে। কবির অভিপ্রেত জীবনবাদই এখানে প্রতিফলিত হয়েছে। জীবন বিমুখতা নয়, জীবনকে সুন্দর সজ্জিত করে তোলাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।

উপসংহার

কবিতাটির আঙ্গিক নির্মাণে কবি যে চিত্রকল্প ও ভাষার আশ্রয় করেছেন তাতে আটপৌরে শব্দ প্রয়োগ করে কবিতাটির ভিতরে অবলীলাক্রমে ঘটিয়েছেন অন্তর্লীন এক শ্রুতিসম্পন্ন ছন্দের দুলকি। ভাষার ইঙ্গিতময়তা এই কবিতায় অসাধারণ। হরবোলা ছেলেটাও যেন আমাদের চোখের সামনে দিয়ে হেঁটে যায়। গীতিকবিতার সীমার মধ্যেই চিত্রিত হয়েছে আবেগমথিত নাটকীয়তা। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পরিণত শিল্পনৈপুণ্য এবং জীবনবোধের ব্যাপ্তির একটি রসোত্তীর্ণ দৃষ্টান্ত হচ্ছে এই কবিতাটি।

Bonus Knowledge 🙂

এই কবিতাটি 'ফুল ফুটুক' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় ১৯৫১ থেকে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে এই কবিতাটি রচনা করেছেন। 

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কলকাতার যীশু কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা বিচার ও সংবাদধর্মীতা

মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্যের নামকরণের সার্থকতা বিচার

ঘোড়সওয়ার কবিতার সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু ও আধুনিকতার লক্ষণ