শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের 'অবনী বাড়ি আছো' একেবারে সাধারণ কবিতা নয়। একে সাংকেতিক কবিতা বলা যেতে পারে। এখানে সাধারণভাবে পংক্তির পর পংক্তি সাজিয়ে কবিতাটি কে গড়ে তোলা হয়নি। এখানে কবিতাটি গড়ে উঠেছে শব্দের বাইরের অর্থকে অতিক্রম করে ব্যঞ্জনার্থে, এই কবিতার শব্দগুলি যেন মূর্ত ব্যঞ্জিত হয়ে উঠেছে।
কবিতার বিষয়বস্তু
কবিতার ক্যানভাসে যে ছবিটি প্রথমেই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তা হল ঘুমন্ত চেতনাহীন অসাড় পুরী। সেখানে কবি চিত্তের হয় একক জাগরণ। তাই তিনি রাতের কড়া নাড়া শোনেন-
"অবনী বাড়ি আছো?"
অর্থাৎ নিত্য জাগ্রত মানব আত্মা মহাজাগরণের ডাক শোনেন। ক্ষুদ্র আমি বড় আমির ডাকে সাড়া দিতে চায়। ফলে কবি সবসময় রাতের কড়া নাড়া শোনেন। অবনী হল কবির আত্ম সাক্ষাৎকারের উদ্বোধন। অবনী শব্দের অর্থ যদি এখানে ধরা হয় "যে জনসমূহ রক্ষা করে" তাহলে দাঁড়ায় যে জনসমূহকে রক্ষা করে সেই ত্রাতাকে ইতিহাস আহ্বান জানাচ্ছে গভীর রাত্রির অন্ধকারে মানুষের অচেতনঅবস্থার পরমক্ষণে। অর্থাৎ একমাত্র চৈতন্যের উদ্ভাসনের জন্যই কবি রাত্রির আহ্বান শোনেন।
কবিতাটির দ্বিতীয় অংশে প্রকৃতির প্রেক্ষাপটে জীবনপ্রেম ও জীবন অনুরাগের সম্মিলিত চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। এখানেও কবি চৈতন্যের সুপ্ততাকে প্রতিহত করে জাগরনের গায়ত্রী মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ বলেই শুনতে পান- "অবনী বাড়ি আছো?"
কবিতাটির তৃতীয় অংশে চৈতন্য শক্তি জড়তায় বাধাপ্রাপ্ত হয়। চৈতন্যের জাগরনের সপ্তগুণের পরিবর্তে জড়তায় তিনি তমোগুণের শিকার হন। কিন্তু যার চিত্ত একবার উদ্ভোধিত হয়েছে সে তো আর চিরকালের জন্য বাধাগ্রস্ত হতে পারে না। তাই সাময়িক বিভ্রান্তি উত্তীর্ণ হয়ে আবার আত্ম চৈতন্যের সাক্ষাৎকার লাভ করে, আর তখনই শোনেন সেই অন্তর আত্মার সীমাহীন আকুতিময় প্রশ্ন- অবনী বাড়ি আছো? চারদিকের প্রতিকূলতায় ক্লান্ত কবিমন ঘুমিয়ে পড়লেও আবার হঠাৎ জাগরণ ঘটে-
"সহসা শুনি রাতের কড়া নাড়া
অবনী বাড়ি আছো?"
তার কবির স্বরূপ অর্থাৎ ব্যক্তিসত্তা ঘুমে বিলীন হতে চেয়েছে বা বিষন্নহীনতার স্তর থেকে বিষন্নময়তার স্তরে উপনীত হতে চেয়েছে। ফলে তিনি গভীর রাতে কেবল রাতের কড়া নাড়া শোনেন এবং সেই অনুচ্চারিত অথচ গভীর মোহনীয় প্রশ্নে উদ্বেলিত হন-
অবনী বাড়ি আছো?
এখানে মন্ত্রের মতো ঘুরে ফিরে একটি কথাই বারবার আবৃত্ত হতে থাকে। 'অবনী বাড়ি আছো' কবিতাটির মধ্য দিয়ে যেন কবির জীবনদর্শন ব্যক্ত হয়েছে।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের যে আস্তিক্যবোধের মধ্যে জন্ম নিয়েছিলেন সেই আস্তিক্যবোধে নানা কারণে ফাটল দেখা দিতে শুরু করলে কবি চিত্তে এক নৈরাশ্য বেদনার পরিমণ্ডল সৃষ্টি হয়। সেই পরিমণ্ডল থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কবির অন্তর্স্থিত কবিপুরুষও তাকে আহ্বান জানাতে পারেন। "অবনী বাড়ি আছো?" এই প্রশ্নসূচক বাক্যটি আসলে প্রশ্নহীনতা। কবি প্রশ্নের অবতারণা করে প্রশ্নহীনতায় যেতে চেয়েছেন। অর্থাৎ বিষণ্ণ থেকে বিষন্নহীনতায় যাওয়া, বস্তু-ময়তা থেকে অবস্তুময়তার গভীরে যেতে চাওয়ার কথাই কবিতাটির মূল লক্ষ্য।
উপসংহার
হার না মানা জীবনের যে শিকড় বোধির গভীরে প্রোথিত, দুর্মর প্রাণ সেখানে নৈর্ব্যক্তিক আবেগে চোখ মেলে থাকে। সেখানেই যেন "অবনী বাড়ি আছো"র মতো শব্দত্রয় নিকষ কালো অন্ধকারে বর্শার ফলার মতো আত্মচৈতন্যের উদ্বোধন ঘটায়। সুতরাং একথা বলা যেতেই পারে যে, এই কবিতাটি একটি আত্মউদ্বোধনের কবিতা।
Bonus Knowledge 🙂
১৯৯৫ এর ২৩ শে মার্চ শক্তি চট্টোপাধ্যায় পরলোক গমন করেন মাত্র ৬২ বছর বয়সে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন