ভূমিকা
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য কবি অমিয় চক্রবর্তী আধুনিক বাংলা কবিতার আকাশে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। তার 'চেতন স্যাকরা' নিঃসন্দেহে অন্যতম উল্লেখযোগ্য কবিতা। এই কবিতায় চেতন, স্যাকরা, সোনা, ময়না প্রভৃতি শব্দ প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। কবি নিজেই এখানে চেতন স্যাকরার ভূমিকায় উপস্থাপিত হয়েছেন। সোনার গয়না বানানো তার কাজ। তিনি গয়না বানিয়ে কাচের বক্সে রাখেন। বাক আত্মার মুক্তির জন্য মানুষের শুভ চেতনা জাগ্রত করার জন্য শিল্প সৃষ্টি করেন। কবিতায় কবি পার্থিব জীবনের লোভ, লালসা, নোংরামি, নীচতা ইত্যাদির আভাস দিয়েছেন। সমাজের মানুষ সমাজটাকে নোংরা গলিতে পরিণত করেছে। সেই নোংরা পরিবেশের মধ্যেই কবি তার দোকানে বসে সোনার গয়না বানান।
কবিতার বিষয়বস্তু
কবির মতে এই সমাজ বাঁচার উপযুক্ত নয়। তবু আশ্চর্যভাবে মানুষ এর মধ্যেই বাঁচে এবং মরে। ড্রেন, ধুলো, মাছি, মশা, ঘেয়ো কুকুরের সঙ্গে মানুষকে বাঁচতে হয়। সহ্য করতে হয় কত রকমের উপদ্রব, দারিদ্রতা, রোগ-ব্যাধির প্রকোপ। দারিদ্র্যের কারণে রোগের চিকিৎসা হয় না। অন্তিম কাল উপস্থিত হলে আসে ডাক্তার। তার আগে পর্যন্ত সংসারের ঘানি কলে ঘুরতে হয়। তাও এই পরিবেশের মধ্যে মানুষ স্বপ্ন দেখে- "কিছু একটা হয়তো হবে, বুঝি বা কোথায় যাব।" কিন্তু কোথাও যাওয়া হয় না। দরিদ্র অক্ষম মানুষের কোথাও যাওয়া হয় না-
"কোথাও যাবে না, গলিতেই থাকবে
বড় রাস্তায় যাদের বাসা
হাঁ করে দেখবে তাদের মোটর ; পনেরোটা বিড়াল
-শখের চাকর -থাকবে খাসা।"
শ্রেণি বৈষম্যের কথাটা এখানে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ সমাজে দরিদ্র মানুষদের কোন জায়গা নেই, অন্যদিকে বড়লোকদের সবকিছুই আছে। যেমন তাদের মোটর হবে, খরচ করে পনেরোটা বিড়াল পুষবে, আভিজাত্য দেখানোর জন্য চাকর রাখবে। আর দরিদ্র শ্রমিক কৃষককে শোষণ করে সিন্দুক ভরাবে।
প্রাচীন কাল থেকে অনেক মহাপুরুষ ভালো ভালো কথা বলে এসেছেন। অনেক কাব্যনাটক সৃষ্টিও হয়েছে। কবি তাকে বলেছেন তাল তাল সোনা। উত্তম উত্তর। কিন্তু তা দিয়ে একালের গলিতে কাজ চলে না। গয়না বানাতে গেলে খাঁটি সোনার সঙ্গে খাদ মিশিয়ে গয়নার উপযোগী করে তুলতে হয়। কবিও তেমনি খাঁটি সোনার মতো সেই সব মহাপুরুষের বাণীর সঙ্গে মিশিয়ে দেন গলির সংস্কৃতি। সমাজের দুর্নীতিপরায়ণ মানুষগুলিকে শাস্তি দেবার ক্ষমতা কবির নেই। তার আছে আগুন, সৃষ্টির আগুন। আর্টের আগুন। সেই আগুন নিয়ে তার কাজ। গয়না বানানো তার কাজ। শুভ চেতনা ও কল্যাণ ভাবনায় উদ্বুদ্ধ করা তার কাজ।
যারা সংসারের স্যাকরা, মুনাফার প্রতি তাদের লোভ থাকে আর নারী ময়নাদের আকৃষ্ট করতে আগ্রহী হয়। কবি কিন্তু তেমন স্যাকরা নন। খদ্দের ধরার তাগিদ তার নেই। নারী ময়নাদের আকৃষ্ট করা যায় কিন্তু আত্মাকে আকৃষ্ট করা যায় না। আসল কথা হল শিল্প সৃষ্টি জোর করে কারোর উপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না। তাতে মানুষের চেতনার উন্মেষ ঘটে না। সংসারের বিভিন্ন কাজে থাকা মানুষ যদি কখনো সোনা কেনে, শুভ চেতনার প্রতি আকৃষ্ট হয় সেই আশাতেই থাকতে হয় কবিকে।
উপসংহার
আধুনিক কবিতার সমস্ত লক্ষণই চেতন স্যাকরা কবিতার মধ্যে আছে। সমকালীন বাস্তব সমাজের পঙ্কিলতা, শ্রেণি বৈষম্য, শোষণপীড়ন এসবের যেমন স্পষ্ট চিত্র আছে তেমনিই এর থেকে মুক্তির ব্যাকুলতাও আছে। শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোন রকমের সংস্কার মানা হয়নি। বহু কথ্য শব্দ, বিদেশি শব্দ অনায়াসে প্রয়োগ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে বলা যায় চেতন স্যাকরা নিঃসন্দেহে একটি সার্থক আধুনিক বাংলা কবিতা।
Bonus Knowledge 🙂
প্রথম মহাযুদ্ধের পর ১৯২৩ সালের কাছাকাছি সময় থেকে কল্লোল, কালিকলম, প্রগতি প্রভৃতি পত্রিকাকে আশ্রয় করে আধুনিক বাংলা কবিতার আন্দোলন শুরু হয়।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন