যদি নির্বাসন দাও কবিতার সারমর্ম ও কবির রোমান্টিক চেতনা ও স্বদেশপ্রীতির পরিচয়

ভূমিকা

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের যদি নির্বাসন দাও কবিতাটি একটি সার্থক স্বদেশ প্রেমমূলক কবিতা। এই কবিতার প্রেক্ষাপটে আছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। বাংলাদেশের মাদারীপুরে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম। জন্মভূমি বাংলাদেশের প্রতি এক প্রগাঢ় মমত্ববোধ থেকেই এই কবিতার জন্ম। পাকিস্তানী বর্বর সেনাবাহিনীর দ্বারা বাংলাদেশের মানুষ শোষিত ও অত্যাচারিত হয়েছিল। সেই নিপীড়নে ব্যথিত কবি হৃদয় বেদনার করুণ রাগিণীকে ফুটিয়ে তুলেছেন যদি নির্বাসন দাও কবিতার বাক্ শরীরে। কবিতাটির একদিকে যেমন স্বদেশভূমির প্রতি কলকাতার নাগরিক কবির মমত্ববোধ প্রকাশিত হয়েছে, ঠিক তেমনই লক্ষ করা যায় কবিমনের ক্ষোভ মিশ্রিত অন্তর্লীন বেদনাকে। যা কবিতাটির পরতে পরতে আমরা লক্ষ করি। 

কবিতাটির বিষয়বস্তু

কবি বাংলাদেশকে ছেড়ে এসে এপার বাংলার রাজধানী কলকাতায় নাগরিক জীবন যাপন করলেও স্বজনভূমিকে ভুলতে পারেননি। যেখানে তিনি শৈশবে বেড়ে উঠেছেন, সেই মাটিকে ভোলা এত সহজ নয়। তিনি দেখেছেন যে, তার জন্মভূমি আজ শত্রুর কবলে পড়ে আজ সৌন্দর্যহীন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের মাটি, আকাশ, বাতাস, মেঘ, নদী, সাড়ে তিন হাত ভূমিকে কবি ভুলতে পারেননি।

"বিষন্ন আলোয় এই বাংলাদেশ
                       নদীর শিয়রে ঝুঁকে পড়া মেঘ
                       প্রান্তরে দিগন্ত নিনির্মেষ-
                       এ আমারই সাড়ে তিন হাত ভূমি"

শৈশবের স্মৃতির রঙে উজ্জ্বল হয়ে আছে এইসব ফেলে আসা ছবিগুলি। পরিস্থিতির চাপে পড়ে কবি পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় চলে এলেও কবি জন্মভূমিকে ভুলতে পারেননি। 

কবিতার দ্বিতীয় স্তবকে আমরা দেখি যে, কবি একই সঙ্গে দেশভাগের পর বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক হননের বীভৎস ঘটনার পাশাপাশি সুজলা সুফলা নদীমাতৃক বাংলাদেশের অপরূপ প্রকৃতির ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন স্মৃতি রোমন্থনের মধ্য দিয়ে। যে ধানখেত ছিল কবির স্বপ্নভূমি, সেখানে কবি দেখেছেন দাঙ্গা বিদ্ধস্ত সাম্প্রদায়িক হানাহানিতে রক্তে রাঙানো চরম বীভৎসতার ছবি। অক্লান্ত শ্রমের দ্বারা ঘাম ঝরিয়ে মেহনতি মানুষেরা যেখানে ফসল ফলাত সেখানে খানসেনাদের বর্বরতার ছাপ সুস্পষ্ট। যে নদীর বুকে কবি স্নান করতেন এবং স্নানার্থীদের প্রণাম করা দেখতেন, সেখানে পাকিস্তানী সেনাদের আগমনকে কবি লুটেরা, ফেরারী বলে ভেবেছেন।

এইভাবে কবি একের পর এক দ্বৈত চিত্র ফুটিয়ে তোলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কালকে ধরে। কবি দেখেন বিশাল প্রাসাদে কাপুরুষতা, বুলেট ও বিস্ফোরণ। এইসবের মধ্যে অতীতচারিতাই তার জন্মভূমির প্রতি কবিমনের আকর্ষণ অনুভূত হয়েছে। তাছাড়াও এই অতীতচারিতায় একদিকে জন্মভূমির প্রতি কবিমনের আনন্দ, সুখানুভূতি যেমন প্রকাশিত হয়েছে, তেমনই বর্তমানে দেশের দুর্গতির চিত্রও কবি মমতার সঙ্গে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। 

কবি তার কবিতার তৃতীয় স্তবকে এক নির্মল শুদ্ধতায় শৈশবের হারানো দিনগুলিতে ফিরে যেতে চেয়েছেন। আত্ম-জিজ্ঞাসার মাধ্যমে তিনি বলেছেন-

"কুয়াশার মধ্যে এক শিশু যায় ভোরের ইস্কুলে
নিথর দিঘির পাড়ে বসে আছে বক
আমি কি ভুলেছি সব
                    স্মৃতি, তুমি এত প্রতারক?"

উপসংহার 

আলোচ্য কবিতাটির মধ্যে এই ফেলে আসা স্বদেশভূমির জন্য যে আন্তরিক ভালবাসা, সেই ভালবাসার প্রকাশ ঘটেছে আলোচ্য কবিতাটিতে। প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতিপ্রেমিক রোমান্টিক কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই কবিতায় স্মৃতি মেদুরতার অন্তরালে সুগভীর দেশাত্মবোধকেই ফুটিয়ে তুলেছেন।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কলকাতার যীশু কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা বিচার ও সংবাদধর্মীতা

মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্যের নামকরণের সার্থকতা বিচার

ঘোড়সওয়ার কবিতার সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু ও আধুনিকতার লক্ষণ