বাবরের প্রার্থনা কবিতার ভাববস্তু ও কবিতায় কবির পিতৃসত্তার পরিচয়

ভূমিকা

বাবরের প্রার্থনা কবিতাটি আবুল ফজল বর্ণিত বাবরের শেষ জীবনের কাহিনিকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে। ওই বর্ণনা থেকে ও বাবরের আত্মজীবনী বাবরনামা থেকে জানা যায় মোঘল সম্রাট বাবরের জীবনের নানান কথা। সেখান থেকেই জানা যায় বাবরের পুত্র হুমায়ন গুরুতর ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে বাবর আল্লার কাছে তার নিজের জীবনের বিনিময়ে পুত্রের আরোগ্য কামনা করেছেন। এর পর হুমায়ন ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেও বাবর অন্তিমশয্যা গ্রহণ করেছেন।

বাবরের মৃত্যু সম্পর্কে এই লোকপ্রসিদ্ধ ঘটনাকে অবলম্বন করে শঙ্খ ঘোষ বাবরের প্রার্থনা কবিতাটি রচনা করেন। ইতিহাসের এই তথ্য থেকে জীবন রস সঞ্চয় করে কবির জীবন দর্শন প্রকাশিত হয়। এর পিছনে আরও একটি কারণ আছে, যা কবির ব্যক্তিজীবনের সাথে যুক্ত। কবির বড় মেয়ে একবার গুরুতর ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। চিকিৎসাতেও কোনো সুফল মেলেনি। কবি এই ঘটনায় খুবই হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। বাবরের প্রার্থনা কবিতাটি রচনার পিছনে মেয়ের এই অসুস্থতার বিষয়টি ভূমিকা গ্রহণ করেছে বলা যায়। 

কবিতাটির বিষয়বস্তু

সমগ্র কবিতাটিতে বাবরের পিতৃসত্তা প্রধান হয়ে উঠেছে। তিনি তার একমাত্র পুত্রের আরোগ্য কামনায় আল্লার কাছে প্রার্থনারত। যে দুর্ধর্ষ অভিযানে তিনি মোঘল সাম্রাজ্যের ভিত গড়ে তুলেছিলেন, যেভাবে তিনি একের পর এক রাজ্য জয় করেছিলেন এবং সেই জয়ের পিছনে যে বর্বরতা প্রকাশ পেয়েছিল, তারই কৃতকর্মের ফল তিনি ভোগ করছেন। তার মনে হয়েছে যে তারই কৃত পাপের জীবাণু তার ছেলের শরীরে প্রবেশ করেছে। এর ফলে তার পুত্র আজ মৃত্যুমুখে পতিত। কবির কথায় -

"আমারই বর্বর জয়ের উল্লাসে
মৃত্যু ডেকে আনি নিজের ঘরে।"

তাই রাজ্য জয়ের উল্লাস, প্রাসাদে আলোর রোশনাইয়ের পরিবর্তে তার পিতৃসত্তা আজ পীড়িত হয়ে উঠেছে। সম্রাট নিজের জীবনের বিনিময়ে আকুল হয়ে কামনা করেছেন পুত্রের সুস্থ জীবন। বাবরের এই আকুল প্রার্থনার মধ্য দিয়ে ফুটে উঠেছে আত্মত্যাগের সদিচ্ছা ও মনুষ্যত্ববোধ। যে মনুষ্যত্ববোধের দ্বারা গড়ে উঠবে প্রকৃত সত্য ও সুন্দরের ভূমি যেখানে অত্যাচার, লুণ্ঠন ও অনাচারের পাপ থাকবে না। এখানে কবির সমাজ সচেতনতার পরিচয় আমরা পাই।

কবিতাটিতে প্রকাশ পেয়েছে বিপন্ন সময় ও সমাজের প্রতি মানবিকতাবোধের দৃঢ় প্রত্যয়। কবি শঙ্খ ঘোষ যা আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন নিখুঁত ভাবে। পরিমিত শব্দ ব্যঞ্জনে, ইতিহাস চেতনার অমোঘ পরিবর্তনের অনুভব তাকে সমাজ মানসের স্বাভাবিক গতিরেখায় চলতে শিখিয়েছে। সন্ততির মধ্যেই পিতা বেঁচে থাকেন। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যের সেই বিশাল উক্তি নিশ্চয়ই আমাদের মনে আছে -

"আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে"

শঙ্খ ঘোষের কবিতার মধ্যে সেই কথাই যেন প্রতিফলিত হয়েছে। কবিও তাই বলেছেন - 

"ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।"

উপসংহার


কবি শঙ্খ ঘোষ মননের জগতে প্রত্যক্ষ করতে চান এর চিরন্তন সত্যকে। সেই সত্যের ভিত্তি মানব হৃদয়ের গভীরে। তিনি আকাশের নীলিমার দিকে তাকিয়ে থাকেন শান্তির প্রার্থনায়। সম্রাট বাবর যেমন একমাত্র পুত্রের রোগমুক্তির প্রার্থনায় প্রাসাদের বিলাসবহুল কোলাহলময় রোশনাই- এর উল্লাস ত্যাগ করে পশ্চিম দিকে মুখ করে আকাশের দিকে ধ্যানী দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন, কবি শঙ্খ ঘোষের মধ্যেও যেন সেই ধ্যানী দৃষ্টি আমরা লক্ষ করি।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কলকাতার যীশু কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা বিচার ও সংবাদধর্মীতা

মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্যের নামকরণের সার্থকতা বিচার

ঘোড়সওয়ার কবিতার সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু ও আধুনিকতার লক্ষণ