বাংলার মুখোশ - বাংলার লোকশিল্পের একটি অনন্য অধ্যায়

বর্তমান বিভক্ত বাঙলার পশ্চিমাংশে অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে বেশ কয়েকটি লোকনৃত্যে মুখোশের ব্যবহার আছে। পশ্চিম থেকে পুবের দিকে এগিয়ে মধ্যবঙ্গ হয়ে উত্তরে হিমালয় পর্যন্ত পৌঁছালে আমরা ছৌ, রাবণ কাটা, গম্ভীরা, কালীকাচ, মুখাখেল, গমীরা ইত্যাদি সমতলের বেশ কয়েকটি নাচে মুখোশের ব্যবহার লক্ষ করি। এছাড়াও দার্জিলিং জেলার পার্বত্য অংশে 'মহাকালী লাখে', 'মিঙ্গীছম', 'চমরীছম' ইত্যাদি কয়েকটি নৃত্যেও মুখোশ ব্যবহৃত হতে দেখি। এই সব মুখোশ প্রধানত কাগজের মণ্ড, কাঠ এবং মাটি দিয়ে তৈরি হয়। কোন কোনটিতে রয়েছে পিচবোর্ড অথবা পাতলা টিনের ব্যবহার। প্রসঙ্গত বলা ভালো যে, বাঙলার মুখোশের আলোচনায় আমরা কেবল সমতলের নৃত্যে ব্যবহৃত মুখোশগুলির বিষয়েই আমাদের বক্তব্য সীমাবদ্ধ রাখবো।

বাংলার মুখোশ ব্যবহারের রীতিকে আমরা মূলত তিন ভাগে ভাগ করতে পারি : আচার মূলক, প্রমোদমূলক ও মিশ্র।

১. কিছু ধর্মীয় আচার ও অনুষ্ঠান উপলক্ষে লোকসমাজে নৃত্যের প্রচলন আছে। সেই অনুষ্ঠানগুলি নির্দিষ্ট তিথি, বার মেনে এবং কোন না কোন লোকদেবতার পূজার আচার অনুষঙ্গে পালিত হয়। সে-গুলিকেই আমরা 'আচার মূলক মুখোশ' নৃত্য বলেছি। যেমন— গম্ভীরা মুখোশ নৃত্য, ছৌ-মুখোশ নৃত্য, রাবণ কাটা মুখোশ নৃত্য, কালীকাচ, গমীরা প্রভৃতি।

২. এর পরের স্তরে আমরা উল্লেখ করেছি প্রমোদ মূলক মুখোশ নৃত্যের। এই ধারার মুখোশ নৃত্যের মূল উদ্দেশ্য প্রমোদ বিতরণ। কোনো অনুষ্ঠান বা আচারের সঙ্গে এর যোগ নেই। বছরের যে কোন সময়েই অনুষ্ঠিত হতে পারে, বার তিথির কোন বাঁধন নেই। তাই এদেরকে প্রমোদমূলক মুখোশনৃত্য বলা হয়েছে। যেমন, জলপাইগুড়ি জেলার 'মুখা খেল' মুখোশ নৃত্য।

৩. ‘মিশ্র শ্রেণীর মুখোশ' নৃত্য বলতে বোঝাতে চাওয়া হয়েছে যে, যে সব নৃত্যের সূচনায় বা মূলে ধর্মীয় আচার আছে বা অতীতে ছিলো, এখন তা মানা আবশ্যিক নয়; নির্দিষ্ট বার-তিথি মেনে নাচ আরম্ভ করার পাশাপাশি, বছরের যে কোন সময়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বা সাধারণভাবেও নাচ আরম্ভ করা যেতে পারে তাকেই আমরা মিশ্র মুখোশ নৃত্য বলতে চাই। অধিকন্তু এই সব নাচের মধ্যে যেমন আচার কেন্দ্রিক নৃত্যবিষয় অনুষ্ঠিত হয়, তেমনি এমন সব বিষয় যুক্ত থাকে যা একেবারেই দৈনন্দিন জীবন-আশ্রয়ে গড়ে ওঠে। উদাহরণ হিসাবে পুরুলিয়ার 'ছৌ মুখোশ নৃত্য'। মালদহের 'গম্ভীরা মুখোশ নৃত্য, পশ্চিমদিনাজপুর কোচবিহারের গম্ভীরা মুখোশ নৃত্যের নাম উল্লেখ করতে পারি। এইসব নাচে যেমন একটা আচার বা আনুষ্ঠানিক নৃত্যের দিক থাকে তেমনি নিছক প্রমোদ বিতরণও এর উদ্দেশ্যের সঙ্গে যুক্ত হয়। বিষয়ের দিক থেকেও যেমন আচারনুষ্ঠানের দিকে এর লক্ষ্য থাকে, তেমনি বাবু ছৌ, মাঝি-মেঝেনের নাচ, গঞ্জীরায় বুড়া-বুড়ি, ডাইনী, প্রেতিনী, পইরি, গমীরায় কৃষরাণ কৃষাণী, বাঘ-ভল্লুক ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এই কারণেই বাংলার মুখোশ নৃত্যের একটি মিশ্র ধারা দেখানোর প্রয়োজন হয়েছে।

আগেই বলে এসেছি যে মুখোশ তৈরির উপাদান বিভিন্ন সহজলভ্য দেশজ বস্তু। আমরা এখানে মুখোশগুলির কোনটি কোন উপাদানে, কিভাবে তৈরি হয় তার পরিচয় দেব।

ছৌ-নাচের মুখোশ : 


পুরুলিয়া জেলার বাঘমুণ্ডি থানার মাইল খানেক দূরে চড়িদাগ্রাম এই নৃত্যধারার একমাত্র মুখোশ নির্মাণ কেন্দ্র। নির্মাতা হচ্ছেন বর্ণহিন্দুর অন্তর্গত সূত্রধর উপাধীর মানুষ জনেরা। এঁদেরই কেউ কেউ পুরুলিয়া শহরে যেমন দোকান দিয়ে মুখোশ বিক্রি করেন, তেমনি একটি অংশ এই জেলারই জয়পুর থানার অন্তর্গত ডুলুরডি গ্রামে মুখোশ তৈরির কেন্দ্র স্থাপন করেছেন। উপকরণের মধ্যে রয়েছে ছেঁড়া কাগজ, ছেঁড়া কাপড়, মাটি, ময়দার আঠা। কাঁচি, হাতুড়ি, বাটালি, করণি ইত্যাদি লোহা ও কাঠের যন্ত্র ব্যবহার করা হতো, এখন বাজার থেকে রঙ কিনে আনা হয়। এখন সলনা, চুমকি, কাচের পুঁতি, প্লাস্টিকের মালা রাঙতা, ময়ূরের পালক ইত্যাদি দিয়ে মুখোশকে সাজানোর প্রতিযোগিতা লক্ষণীয়। ফলে মুখোশের দাম বেড়ে দু-আড়াই শোতে দাঁড়িয়েছে। রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণের চরিত্রানুযায়ী অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে তৈরি মুখোশগুলি আকর্ষণ যোগ্যতায় এবং নান্দনিক মূল্যে বাঙালীর কলারুচিকে সমুন্নতি দান করেছে।

রাবণ কাটার মুখোশ :


বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর শহরের একপ্রান্তে মাত্র একটি স্থানে শারদীয়া পূজার তিন চারদিন ধরে যে নাচ হয় তার নাম রাবণ কাটা নৃত্য। এতে হনুমান-এর দুটি, জাম্বুবানের একটি রাবণের একটি এবং ইন্দ্রজিতের একটি মুখোশ ব্যবহৃত হয়। এগুলি সবই স্থানীয় অরণ্য জাত কাঠের মুখোশ। বেশ ভারি। মুখোশগুলি তৈরির ক্ষেত্রে কিছু আচার পালন করা হয় । হনুমানের মুখোশের রঙ সাদা, ইন্দ্রজিত ও রাবণের গাঢ় সবুজ এবং জাম্বুবানের কালো।

গম্ভীরা নাচের মুখোশ :


এই নাচের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও প্রধান মুখোশ হচ্ছে নারসিংহীর। এটি নিম কাঠের তৈরি, বেশ ভারি ও বৃহদাকার। বড় বড় চোখ, দীর্ঘ নাসা এবং লাল রঙ করা লোলা-জিহ্বা। কানের কাছ থেকে দুটি সিং ওপরের দিকে উঠে গেছে। আগে এই নাচে কালিকা, চামুণ্ডা, হনুমান, শিব, বড়াবুড়ি সকলেরই পরিচয় জ্ঞাপক মুখোশ তৈরি হতো। আজ নারসিংহী ছাড়া সবারই মাটির বা পিচবোর্ডের মুখোশ তৈরি হয় এবং অধিকাংশই আর মুখোশ ব্যবহার করে না। এই মুখোশ সম্পর্কে হরিদাস পালিত মহাশয় তাঁর 'আদ্যের গম্ভীরা' (১৯১২) গ্রন্থে বলছেন : 'নৃত্য করিবার পূর্বে ভক্ত গম্ভীরা গৃহে পূজকের নিকট নূতন কাষ্ঠ নির্মিত মুখার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করিয়া লয়। যাহাদের মুখা আছে, তাহারা বিজয়াদশমীর দিবসে পূজাদি প্রদান করিয়া থাকে। এক্ষণে এই প্রকার পূজাপ্রথা প্রায় উঠিয়া গিয়াছে। এদেশের সাধারণের বিশ্বাস, কোন কোন মুখাজাগ্রত... অনেকে মুখা লইয়া নৃত্য করিতে গিয়া প্রাণ হারাইয়াছে।'

মুখাখেলের মুখোশ : 


মূলত রামায়ণের কাহিনী নিয়ে তৈরি এই নৃত্যের মুখোশগুলি কাঠের। স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত হালকা কাঠ এই মুখোশ নির্মাণে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। রঙ ব্যবহারে কোন বৈশিষ্ট্য নেই। আজকাল এই নাচের প্রচলন খুবই কমে যাওয়ায় এই নাচের মুখোশ নির্মাণ শিল্পও প্রায় মৃত্যুর পথযাত্রী।

অপরাপর মুখোশ :


পশ্চিমদিনাজপুরে কালীর নাচের জন্য যে মুখোশ ব্যবহার করা হয় তাকে স্থানীয়ভাবে মোখা বলে। বেশ বড় ও বীভৎস দর্শন তিব্বতীয় মুখোশের আদল লক্ষণীয়। 'কালী কাচ' এর জন্য যে মুখোশ তা কাঠ, মাটি কখনও বা মোটা পিচবোর্ডের সাহায্যে তৈরি করা হয়। তবে পূর্বে এক্ষত্রে কাঠ ও মাটি যে প্রশস্ত ছিলো তা বলা বাহুল্য।

মোটামুটিভাবে বাঙলার মুখোশ তৈরির প্রধান উপকরণ কাঠ ও মাটি। কাগজজাত অপরাপর উপাদান পরবর্তীকালের সংযোজন। একেবারে আদিকালে মুখে রঙ ব্যবহার এবং পশু চামড়া ও লাউ ইত্যাদির খোলাই যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল, তা মুখোশ ব্যবহারের আদি ইতিহাস অনুসন্ধান করলে বুঝতে অসুবিধা হয় না।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কলকাতার যীশু কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা বিচার ও সংবাদধর্মীতা

মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্যের নামকরণের সার্থকতা বিচার

ঘোড়সওয়ার কবিতার সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু ও আধুনিকতার লক্ষণ