লোকসংস্কৃতি : সংজ্ঞা স্বরূপ শ্রেণীবিভাগ অনুশীলন পদ্ধতি - মানস মজুমদার

লোকসংস্কৃতি-র আলোচনায় 'লোক' বলতে কোনও একজন মানুষকে বোঝায় না। বোঝায় এমন একদল মানুষকে যারা সংহত একটি সমাজের বাসিন্দা। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট একটি ভূখণ্ডে তারা বসবাস করে, তাদের আর্থিক কাঠামো একইরকম, জন্ম থেকে মৃত্যু এবং বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকলে এক ধরনের বিশ্বাস-সংস্কার, আচার-আচরণ, প্রথা-পদ্ধতি, উৎসব- অনুষ্ঠান পালন করে থাকে।

'সংস্কৃতি' হল সভ্যতাজনিত উৎকর্ষ। এ উৎকর্ষ জীবনচর্যার। সংস্কৃতি অনুশীলন-নির্ভর, কাল পরম্পরায় বহমান, ক্রমপরিবর্তনশীল।

'লোকসংস্কৃতি' হল তাই, যাতে লোকসমাজের সভ্যতাজনিত উৎকর্ষের প্রতিফলন ঘটে। লোকসমাজের জীবনচর্যার উন্নত রূপটি প্রকাশ পায়। 
লোকসংস্কৃতিকে কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করা চলে। যেমন: বস্তুকেন্দ্রিক, বিশ্বাস- অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক, খেলাধুলাকেন্দ্রিক, বাককেন্দ্রিক, অঙ্গভঙ্গিকেন্দ্রিক, লিখন বা অঙ্কনকেন্দ্রিক। 

বস্তুকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতির উদাহরণ লোকসমাজে ব্যবহৃত বস্তুসমূহ। ঘরবাড়ি, খাদ্যপানীয়, পরিধান ও প্রসাধনদ্রব্য, কৃষি ও শিকার সরঞ্জাম, আসবাবপত্র, যানবাহন বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি। পাহাড়ি অঞ্চল আর সমতলভূমির ঘরবাড়ির ছাঁদ এক নয়। যে-অঞ্চলে যে সমস্ত উপাদান- উপকরণ সহজলভ্য তাই দিয়েই লোকসমাজ ঘরবাড়ি তৈরি করে থাকে। খাদ্যপানীয় একটি অঞ্চলের জলবায়ুর ওপর নির্ভরশীল। বাংলার লোকসমাজের খাদ্যপানীয়ের তালিকায় রয়েছে ভাত, ভাল, চিড়ে, মুড়ি, নানা ধরনের নাড়ু ও পিঠে, দই, দুধ, ঘোল, খেজুর বা তালের রস প্রভৃতি। ধুতি, শাড়ি যেমন পরিধান বস্তু, তেমনি সিঁদুর, আলতা চন্দনের বা কাঁচপোকার টিপ, ফুলের সাজ এসবই বাংলার লৌকিক প্রসাধন সামগ্রী। লাঙল, মই, কোদাল, নিরানি, দুনি ইত্যাদি কৃষিসরঞ্জামের নিদর্শন। বিভিন্ন ধরনের জাল, ছিপ, ফাঁদ, তীর-ধনুক, বর্শা শিকার সরঞ্জাম হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। চাটাই, মাদুর, তক্তাপোশ, পিঁড়ে, আসন, প্রদীপ, পিলসুজ, ধামা, কুলো, চালুনি, এসবই গৃহস্থালি দ্রব্য। গরুর গাড়ি, মোষের গাড়ি, এক্কা, পাল্কি, ভুলি, ডিঙি, নৌকা ইত্যাদি যানবাহনের দৃষ্টান্ত। ঢাক, ঢোল, করতাল, খঞ্জনি, ডুগডুগি, একতারা, বাশি প্রভৃতি লোকবাদ্যের তালিকায় পড়ে। মাটি কাঠ, বেত-বাঁশের তৈরি শিল্পসামগ্রীও বস্তুকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতির উদাহরণ।

বিশ্বাস-অনুষ্ঠানকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতি বলতে লোকবিশ্বাস, লোকসংস্কার, লোক প্রথা, লোকঅনুষ্ঠান, লোক-উৎসবকে বোঝায়। বিশ্বাস ধারণা মাত্র। যেমন, 'আমে ধান তেঁতুল রান'। লোকবিশ্বাস যে বছর আমের ফলন বেশি হয়, সে বছর ধানের উৎপাদন বেশি হয়। আর তেঁতুল বেশি হলে সে বছর বন্যা হয়। এয়োস্ত্রীর পুত্রের মৃত্যু হলে মৃত্যু হয়েছে বলতে নেই, বলতে হয় এয়োতির পুত্র খেলতে যায়' অর্থাৎ খেলতে গেছে। আবার ফিরে আসবে। এ হল লোকসংস্কার, এভাবে সুভাষণের মাধ্যমে অশুভ বা অমঙ্গলজনক ব্যাপারকে পরিহার করা হল। লোক-বিশ্বাস যখন আচরণে কার্যকর হয়, তখনই তাকে লোকসংস্কার বলে। বিয়ে, অন্ত্যেষ্টি প্রভৃতি লোকপ্রথা। শিশুর জন্মের ষষ্ঠ দিবসে একটি লোক অনুষ্ঠান পালিত হয়, তাকে বলে 'যে ঠ্যারা' বা 'যেটেরা'। একুশ দিনের দিন পালিত হয় লোক-অনুষ্ঠান 'একুশ্যা'। বিয়ের গায়ে-হলুদের অনুষ্ঠানও লোক-অনুষ্ঠান। সই পাতানোর অনুষ্ঠানও লোক-অনুষ্ঠান। নবান্ন, গাজন ইত্যাদি লোক-উৎসবের উদাহরণ।

লোকসমাজে প্রচলিত বহুবিচিত্র খেলাধুলাকে আশ্রয় করে খেলাধুলাকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতির উদ্ভব। খেলাধুলা দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যরক্ষায় সহায়তা করে। খেলাধুলার প্রয়োজন তাই অস্বীকার করা চলে না। বাংলার লোকসমাজে আগডুম বাগডুম, লুকোচুরি, কানামাছি, হা-ডু- ডু, এক্কাদোকা, হুক্কাপাঞ্জা, ডাংগুলি, বুড়োবুড়ি প্রভৃতি অজস্র খেলার প্রচলন দেখা যায়। শেষোক্ত খেলাটি অভিনয়ধর্মী। লক্ষণীয় লৌকিক খেলাধুলায় প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, ক্ষিপ্রতা, সাংসারিক জ্ঞান ইত্যাদিও শিক্ষা দেওয়া হয়। অভিনয়ধর্মী খেলাগুলিকে লোকনাট্যের একটি সম্ভাব্য উৎস বলা চলে। লাঠিখেলা বা নৌকা বাইচ খেলায় শক্তিমত্তার প্রকাশ ঘটে। প্রশ্নোত্তরমূলক খেলাগুলিতে উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়।

বাক্ কেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতির ধারাটি মৌখিক ঐতিহ্যনির্ভর। স্মৃতিবাহিত ও শ্রুতিনির্ভর লোকসংস্কৃতির যে ধারাটি মুখে মুখে রচিত, মুখে মুখে প্রচলিত, সেই ধারাটিই বাককেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতি। ছড়া, বাঁধা, প্রবাদ, গীত, গীতিকা কথা ইত্যাদি এই ধারার অন্তর্ভুক্ত। ছড়া আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক উভয় শ্রেণীরই হতে পারে। ব্রতের ছড়া, বিয়ের অনুষ্ঠানে নাপিত কথিত ছড়া, জাদুমূলক বা মন্ত্রধর্মী ছড়াগুলি আনুষ্ঠানিক ছড়া। পারিবারিক ছড়া, ব্যক্তি প্রসঙ্গ শ্রিত ছড়া, স্থানাশ্রয়ী ছড়া প্রভৃতি অনানুষ্ঠানিক ছড়া। ধাঁধায় বুদ্ধির পরীক্ষা : সমস্যার সৃষ্টি করে তার উত্তর অনুসন্ধানের প্রয়াস। সব কিছুই ধাঁধার বিষয়মর্যাদা লাভের অধিকারী হয় না। সুপরিচিত কোনো কোনো পৌরাণিক প্রসঙ্গ ও চরিত্র, বিশেষ বিশেষ গৃহস্থালি দ্রব্য, নিসর্গ জগৎ ইতর প্রাণী প্রভৃতি ধাঁধার উপজীব্য বিষয় হয়ে থাকে। প্রবাদ হল ব্যবহারিক অভিজ্ঞতার সংক্ষিপ্ত রসাভিব্যক্তি। পরিচিত জীবনের বিভিন্ন দিক প্রবাদে প্রতিফলিত হয়। আত্মীয়-স্বজন সম্পর্কিত প্রবাদ যেমন পাওয়া যায়, তেমনি পাওয়া যায় বিভিন্ন সম্প্রদায় আর পেশাভুক্ত মানুষজন আশ্রিত প্রবাদ। প্রবাদে স্বাস্থ্যরক্ষার বিধি-নিয়ম যেমন নির্দেশিত হয়, তেমনি বিবিধ বিশ্বাস-সংস্কার, আচার-অনুষ্ঠান, প্রথা-উৎসব ইত্যাদির অবতারণা ঘটে। প্রবাদে সমগ্র সমাজ যেভাবে প্রতিফলিত হয়, লোকসাহিত্যের আর কোনো শাখায় তেমনটি হয় না। গীতিসমূহকে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক দু'ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। বাংলার লোকসমাজে প্রচলিত ভাঁজো, ভাদু, করম, টুসু, জারি প্রভৃতি আনুষ্ঠানিক গীতি। বিবাহ-গীতিগুলিও এ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে, সারি, ঝুমুর, ভাওয়াইয়া, ভাওয়ালি, চটকা ইত্যাদি অনানুষ্ঠানিক গীতি। গীতিকা হল গল্পনীতি। গীতিকায় গীতের মাধ্যমে গল্প পরিবেশিত হয়। সে-গল্প নাট্যলক্ষণযুক্ত। গীতিকা বস্তুনিষ্ঠ রচনা। কথা অর্থাৎ কাহিনী। রূপকথা, পশু-পাকিথা, ব্রতকথা, ইতিকথা (Legend), পুরাকথা (Myth), ভূতের গল্প, বোকাদের গল্প, হাসির গল্প ইত্যাদি কথার নিদর্শন। বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিনাম, স্থাননাম, নক্ষত্র গণনার পদ্ধতি প্রভৃতিও থাককেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতির পর্যায়ভূক্ত।

অঙ্গভঙ্গিকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতিতে অঙ্গভঙ্গি প্রাধান্য পায়। লোকনৃত্যগুলিকে অঙ্গভঙ্গিকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতির নিদর্শন রূপে গণ্য করা চলে। কালীকাচ, রাক্ষসনৃত্য, বুড়োবুড়ি নৃত্য, বাউল ও ফকিরি নৃত্য, গাজন নৃত্য, পাতা ও কাঠি নৃত্য ইত্যাদি স্মরণযোগ্য। ইংগিত, ইশারা, আশীর্বাদ, শ্রদ্ধাজ্ঞাপন বা লজ্জা প্রকাশের ভঙ্গি প্রভৃতিও এ পর্যায়ে পড়ে।

লিখন বা অঙ্কনকেন্দ্রিক লোকসংস্কৃতি বলতে বোঝায় লিখন বা অক্ষন সংশ্লিষ্ট লোকসংস্কৃতি। আল্পনা, দেওয়ালচিত্র, মাটির ঘট বা সরার ওপর অঙ্কিত চিত্র, পটচিত্র, পিঁড়িচিত্র, কাঁথা ও রুমালে অঙ্কিত বহুবিচিত্র নকশা, কাঠের ওপরে খোদিত নানা ধরনের কারুকাজ এ শ্রেণীর লোকসংস্কৃতির উদাহরণ।

উনিশ শতকের ইয়োরোপে লোকসংস্কৃতির চর্চা ক্রমশ প্রসার লাভ করে। এর ফলে লোকসংস্কৃতির অনুশীলনের বিভিন্ন পদ্ধতি গড়ে ওঠে। এগুলি তুলনামূলক, ঐতিহাসিক- ভৌগোলিক, জাতীয়তাবাদী, নৃতত্ত্বমূলক, মনোসমীক্ষামূলক, ঐতিহাসিক বস্তুবাদী, টাইপ- মোটিফ গঠনতত্ত্বগত পদ্ধতি নামে পরিচিত।

তুলনামূলক পদ্ধতি-র সূচনা জার্মানিতে। দুই ভাই জেকব ল্যুডউইগ কার্ল গ্রিম ও উইলহেলম কার্ল গ্রিমের সুবিখ্যাত রূপকথা সংকলন Kind- Und Hans-Marchen-এর দুটি খণ্ড। আলোচ্য সংকলনের বহু গল্পের কথান্তর পাওয়া গেল পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে। গবেষকেরা বিস্মিত হলেন। পৃথিবীর নানা অঞ্চলে একই ধরনের গল্প কীভাবে চালু হল? স্বভাবতই গল্পগুলিকে পাশাপাশি রেখে তুলনামূলকতার প্রয়াস দেখা গেল। সমজাতীয় গল্পের উৎস বা উদ্ভবভূমি সম্পর্কে প্রশ্ন জাগল। বিখ্যাত জার্মান পণ্ডিত ম্যাক্সমুলর বললেন, আদিতে এগুলো ছিল গ্রহ- নক্ষত্র-আশ্রয়ী গল্প। ভারতীয় পুরাণ হচ্ছে এগুলোর উৎস। আরও চাঞ্চল্যকর মন্তব্য করলেন আর একজন জার্মান পণ্ডিত থিওডোর বেনফে। ভারতীয় পঞ্চতন্ত্রের গল্পগুলির অনুবাদ করে (১৮৫৯) ইউরোপীয় গল্পগুলিকে সেগুলির পাশাপাশি রেখে তিনি দেখালেন যে, ভারতীয় লোককথা কালে কালে বণিক-পরিব্রাজক যোদ্ধা প্রভৃতির মুখে মুখে কীভাবে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে। বেশ বোঝা গেল, লোককথাও দেশ বেড়াতে ভালবাসে। বেনকে তুলনামূলকতার মাধ্যমে লোককথার পরিভ্রমণতত্ত্বের জন্ম দিলেন। লোককথা পৃথিবীর এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পরিভ্রমণরত, এটাই এ-তত্ত্বের মূলকথা। তুলনামূলক পদ্ধতিতে এ-তত্ত্ব জোরদার করল। আলোচ্য পদ্ধতির লক্ষ্য হল পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত একই ধরনের গল্পের মধ্যে তুলনা করে গল্পের উৎসভূমিটি খুঁজে বের করা।

ঐতিহাসিক-ভৌগোলিক পদ্ধতি বস্তুতপক্ষে তুলনামূলক পদ্ধতিরই সম্প্রসারিত রূপ। ফিনল্যান্ডের জুলিয়াস ক্রন এবং তাঁর পুত্র কার্লে ক্রন এই পদ্ধতির কথা শোনালেন। এ পদ্ধতিতে বলা হল (১৯২৬) লোককথার বিষয়বস্তু পাত্রপাত্রী নতুন নতুন ভৌগোলিক পরিবেশে পালটে যায়। সমজাতীয় লোককথার মধ্যে প্রতিতুলনাসূত্রে ওই পরিবর্তনের ইতিহাসটি অনুসন্ধান করতে হবে। নতুন নতুন ভৌগোলিক পরিবেশে একটি গল্পের যে পরিবর্তন ঘটছে তার ইতিহাস অনুসন্ধানই এ পদ্ধতির লক্ষ্য। ওই ইতিহাসকে ভিত্তি করে গল্পের প্রাচীনতম মৌলরূপ অর্থাৎ Urtype বা Archetype-টি খুঁজে পাওয়া সম্ভব। সে যাই হোক, তুলনামূলক এবং ঐতিহাসিক-ভৌগোলিক পদ্ধতির সীমাবদ্ধতার দিকটিও মনে রাখতে হবে। দুটি পদ্ধতিতেই মনে করা হয়, দুটি দেশে বা দুটি অঞ্চলে এক ধরনের গল্প প্রচলিত থাকলে একটি গল্প অন্যটির প্রভাবজাত। সব ক্ষেত্রেই তা সত্য নাও হতে পারে। দুটি গল্পই দুটি অঞ্চলে স্বাধীন, স্বতন্ত্রভাবে রচিত হতে পারে। দ্বিতীয়ত, দুটি গল্পের মধ্যে তুলনা করে কোন গল্পটি কোন্ অঞ্চল থেকে কোন্ অঞ্চলে গেছে তা সবসময় সঠিকভাবে বলা কি সম্ভব? একটি গল্পের বেশ কিছু কথান্তর হয়তো সংগৃহীত হল, আবার বেশ কিছু কথান্তর সংগৃহীত হল না, সেই অসংগৃহীত কথাস্তরগুলির মধ্যেই হয়তো সংযোগসূত্রটি রয়ে গেল, এমনও তো হতে পারে।

তুলনামূলক পদ্ধতি যদি আমাদের ঘরছাড়া করে, তবে জাতীয়তাবাদী পদ্ধতি করে ঘরমুখী। জাতীয়তাবাদী পদ্ধতির উদ্দেশ্য লোকসংস্কৃতির অনুশীলনকে একটি জাতি বা দেশের আন্তর স্বরূপ উদ্‌ঘাটনে কাজে লাগানো। দেশের মাটি-জল-মানুষের মধ্যে লোকসংস্কৃতির যে সমস্ত উপকরণ ছড়িয়ে আছে সেগুলি সংগ্রহ ও সমীক্ষা করে দেশীয় লোকসংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ, দেশের উচ্চতর সংস্কৃতিতে তার প্রভাব পরিমাপ, দেশের জনগণকে স্বাজাত্য ও স্বাদেশিকতাবোধে উদ্বুদ্ধকরণের মনোভাব এ জাতীয় লোকসংস্কৃতি অনুশীলনে প্রাধান্য পায়। ফিনল্যান্ড আর আয়ারল্যান্ড এ পদ্ধতি প্রয়োগ করে জাতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য-ভাণ্ডারটি গড়ে তুলতে সমর্থ হল। ফিনল্যান্ডে ১৮০২ থেকে ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই উদ্দেশ্যে প্রবাদ ধাধা নীতি সম্পর্কিত পুস্তকাবলী প্রকাশিত হয়। ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে 'ফিনিস লিটারারি সোসাইটি'- প্রতিষ্ঠা ঘটে। সোসাইটি দেশের সমস্ত অঞ্চলের লোকসাহিত্য সংগ্রহ করে পাঠানোর জন্য জনগণের কাছে মুদ্রিত আবদেনপত্র প্রেরণ করে। এর ফলে ১৮৪৬ থেকে ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত লোকসাহিত্যের বিপুল পরিমাণ উপকরণ সংগৃহীত হয়। ১৮৮৪-তে হেলসিঙ্কি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে ফোকলোর বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়। এলিয়াস লনরট, জুলিয়াস ব্রুন, কার্লে ক্রন, অ্যান্টি আর্নে প্রমুখের পরিশ্রম ও গবেষণায় লোকসংস্কৃতির অনুশীলনে ফিনল্যান্ডের তৎপরতা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে আয়ারল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত হয় 'আইরিশ ফোকলোর কমিশন'। কমিশনের সুপারিশে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে আয়ারল্যান্ডে 'ফোকলোর ইনস্টিটিউট' স্থাপিত হয়। এই ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে লোকসাহিত্য সংগৃহীত হতে থাকে। ১৯৪২-এ ও সুলিভান Handbook of Irish Folklore নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। তাতে তিনি লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদান-উপকরণ সংগ্রহের নির্দেশ দেন। ওই পুস্তিকার কপি দেশের বিভিন্ন স্কুল- কলেজে পাঠানো হয়। দেশের বহুস্থানে সংগ্রাহক নিয়োগ করা হয়। স্বভাবতই বিপুল পরিমাণ উপাদান-উপকরণ সংগৃহীত হয়। একটি ঘুমন্ত জাতি এতে জেগে ওঠে স্বাজাত্যবোধ ও স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়। আয়ারল্যান্ডে Irish Literary Revival-এর সূচনা ঘটে। এ পদ্ধতির উদ্দেশ্যমূলক প্রয়োগ ঘটলো হিটলারের জার্মানিতে। জার্মানরাই পৃথিবীর সবচেয়ে সভ্য জাতি, জার্মানিই সমগ্র ইউরোপের লোকসংস্কৃতির জন্মদাতা ইত্যাদি উক্তি শোনা গেল। লোকসংস্কৃতির সহায়তায় উগ্র জাতীয়তাবোধের জন্ম হল। হেন্‌ হন্যাগুমান, এডলফ বাচ প্রমুখের তৎপরতায় জাতীয় ঐতিহ্যের গৌরব নানাভাবে ঘোষিত হল। অধ্যাপক ইয়ানগাতির নেতৃত্বে জাপানে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে লোকসংস্কৃতি আন্দোলনের সূচনা হয়। এক্ষেত্রে জাপান জাতীয়তাবাদী পদ্ধতির অনুসরণ করে। লোকসংস্কৃতির উপাদান-উপকরণসমূহ সংগৃহীত হতে থাকে। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ৮ এপ্রিল টোকিওতে লোকসংস্কৃতি গবেষণা-কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বিপর্যস্ত জাতি লোকসংস্কৃতির মাধ্যমে নতুন প্রেরণা লাভ করে। জাতীয়তাবাদী পদ্ধতির আশ্রয়ে লোকসংস্কৃতির অনুশীলনে এভাবে কোনো কোনো দেশ ও জাতি যে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠলো তাতে সন্দেহ নেই। অবশ্য এ পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা অনস্বীকার্য। পদ্ধতিটির মধ্যে এক ধরনের সংকীর্ণতা আছে।

নৃতত্ত্বমূলক পদ্ধতি-র উদ্ভব ই. বি. টাইলারের Primitive Culture (1871) এবং এল এইচ মর্গানের The Ancient Society (1877) গ্রন্থ আশ্রয়ে এবং প্রসার অ্যান্ড্রু ল্যাং-এর Social Origins (1903) ও জে জি ফ্রেজারের The Golden Bough (1907-15) গ্রহ সহায়তায়। এ পদ্ধতিতে মানুষের সভ্যতা-সংস্কৃতিকে দেখা হল নৃতত্ত্বের দিক থেকে। বলা হল, ভিন্ন ভিন্ন দেশের মানুষের জীবনাচরণে ও সৃজনধর্মিতায় যে মিল তা নিছক পারস্পরিক প্রভাবের ফল নয়, তার পেছনে রয়েছে মানুষের জৈব স্বভাব ও মনন-চিন্তনের সমধর্মিতা। একই ধরনের সমাজ-অবস্থা একই ধরনের গল্প প্রথা বা বিশ্বাসের জন্ম দিতে পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ তাই সর্বপ্রাণাবাদে বিশ্বাসী, জাদুবিশ্বাস জাদু সংস্কার পৃথিবীর সব দেশের লোকসমাজেই বিদ্যমান, টোটেম (Totem) ট্যাবুর (Tabu) প্রচলনও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লোকসমাজে রয়েছে। বলাবাহুল্য, এ পদ্ধতিতে লোকসংস্কৃতিকে দেখার একটি নতুন দৃষ্টিকোণ খুঁজে পাওয়া গেল। তুলনামূলক বা ঐতিহাসিক-ভৌগোলিক পদ্ধতির বিপরীতেই এ পদ্ধতির অবস্থান। এ পদ্ধতি প্রভাব অন্বেষণ না করে সদৃশ পরিস্থিতিতে সদৃশ সংস্কৃতির আবির্ভাবের কথা বলে থাকে। ফ্রাঞ্জ বোয়াজ, রুথ বেনেডিস্ক, পারসন্স, হারাসকোভিটস প্রমুখ এ পদ্ধতিতে লোকসংস্কৃতিবিদ্যার চর্চা করেছেন।

মনোসমীক্ষামূলক পদ্ধতি-র প্রবর্তক সিগমুন্ড ফ্রয়েড। ফ্রয়েড তাঁর The Interpretation of Dreams (1900) গ্রন্থে মানুষের অবচেতন মন ও অবদমিত আশা-আকাঙ্ক্ষা জীবনাচরণে কীভাবে প্রভাব বিস্তার করে তার উদাহরণ দিতে গিয়ে লোকসংস্কৃতির সাহায্য নিলেন। মানুষের অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি করে রূপকথার অলীক জগৎ, তার বহুবিচিত্র বিশ্বাসে প্রতিফলিত হয়। অবচেতন মনের নানা রহস্য। সচেতন মনের (Conscious mind) পাশাপাশি অবচেতন মন (Unconscious mind), অবদমন (Supression), যৌনাবেগ (Libido) ইত্যাদির সহায়তায় স্বপ্নের নতুন ব্যাখ্যা দিলেন তিনি। এ পদ্ধতি অনুযায়ী বিখ্যাত 'স্নো হোয়াইট' গল্পের নিম্নোক্ত ব্যাখ্যা দেওয়া যেতে পারে। স্নো হোয়াইটের শুভ্র বর্ণ নিষ্পাপ কৌমার্যের প্রতীক : লাল আপেলে কামড় শৈশব সারল্য সাঙ্গ হওয়ার ইংগিত ; রাজকুমারের স্পর্শে বেঁচে ওঠায় পূর্ণায়ত নারীত্বের বিকাশ দ্যোতিত : আয়নাতে রানির বারংবার মুখ দেখায় আত্মরতির প্রকাশ সপত্নী-কন্যার প্রতি ঈর্ষায় সদ্য যৌবনার প্রতি চলিষ্ণু যৌবনার ঈর্ষার অভিব্যক্তি ; আর সাত বামন হল অপূর্ণ পৌরুষের প্রতীক। ফ্রয়েডের মতের অনুবর্তীরা হলেন ইয়ুং, আব্রাহাম, কুহন, আর্নেস্ট জোন্‌স, এরিক ফ্রম প্রমুখ। এ পদ্ধতিতেও সীমায়তি আছে। পদ্ধতিটি লোকসংস্কৃতির সমস্ত রহস্যভেদে সমর্থ নয়। তাছাড়া এ পদ্ধতিতে যৌনতা প্রাধান্য পেয়েছে।

ঐতিহাসিক বস্তুবাদী পদ্ধতি-কে মার্ক্সবাদী পদ্ধতিও বলা হয়। মার্ক্স তার A Contribution to the Critique of Political Economy গ্রন্থের বিভিন্ন স্থানে লোককথা সম্পর্কিত আলোচনায় যে দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ করেছেন, সেই দৃষ্টিভঙ্গির আশ্রয়েই এ পদ্ধতির উদ্ভব। পরবর্তীকালে পল লাফার্ক তাঁর Sketches of the History of Primitive Culture গ্রন্থে এবং গোর্কি তাঁর বিভিন্ন আলোচনায় এ পদ্ধতি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছেন। এ পদ্ধতিতে বলা হল, শ্রমের সঙ্গে সংস্কৃতির নিবিড় যোগ রয়েছে। কোনও দেশের সংস্কৃতির মধ্যে সেই দেশের মেহনতি মানুষের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা, সাফল্য ও ব্যর্থতার প্রতিফলন ঘটে। দ্বিতীয়ত, উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর সংস্কৃতি নির্ভরশীল। উৎপাদন ব্যবস্থা হল মৌল-কাঠামো (Basis) এবং সংস্কৃতি হল অধি-কাঠামো (Super structure)। মৌল কাঠামো উন্নত হলে সংস্কৃতিও উন্নত হবে। তৃতীয়ত, এ পদ্ধতিতে সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে সংস্কৃতির সম্পর্ক নির্ধারণ করা হল। চতুর্থত, গুরুত্ব দেওয়া হল শ্রেণী-দ্বন্দ্বকে। শ্রেণী দ্বন্দ সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। পশুচারণজীবীর সঙ্গে কৃষিজীবীর দ্বন্দ্ব তাই সমাজ- সংস্কৃতির বিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। জমির মালিক ও ভূমিদাস, সামন্তপ্রভু ও প্রজাসাধারণ, কারখানার মালিক ও শ্রমিক- এদের দ্বন্দ্বের ইতিহাসই সমাজ-সংস্কৃতির ইতিহাসকে নিয়ন্ত্রণ করে চলছে। লোকসংস্কৃতি সম্পর্কেও একথা সত্য। সাম্যবাদী রাশিয়া লোকসংস্কৃতির অনুশীলনে সাধারণ মেহনতি মানুষের সৃজনধর্মী মনটিকে আবিষ্কার করলো। প্রিঝোড, বিকোভ, খড়িয়াকোভ আর সকোলড ছড়ায়-গীতিকায় শ্রমসংগীতে শ্রেণী-সংগ্রামের পরিচয় খুঁজে পেলেন। লোকসংস্কৃতিকে লোকশিক্ষা ও উৎপাদনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করল রাশিয়া। গোর্কি বললেন, পরিশ্রমী মানুষের কান্নায় পৃথিবীর সব দেশের লোকসংস্কৃতি চিরকাল মুখর। ঐতিহাসিক বস্তুবাদী পদ্ধতিটি লোকসংস্কৃতির অনুশীলনে সাড়া জাগালেও লোকসংস্কৃতির সামগ্রিক স্বরূপ নির্ধারণ এ পদ্ধতিতে করা সম্ভব কি না তাতে সন্দেহ রয়েছে।

ঐতিহাসিক ভৌগোলিক পদ্ধতির আলোচনা সূত্রেই টাইপ-মোটিফ পদ্ধতি-র উদ্ভব। ফিনল্যান্ডের অ্যান্টি আর্নে বিশ্বের লোককথার মেজাজ ও চরিত্র আশ্রয়ে উদ্ভাবন করলেন টাইপপঞ্জী। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হল Types of the Folktale in World Literature. উক্ত গ্রন্থে টাইপের লক্ষণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বললেন 'Every single tale or story as particular plot and its unified composition বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত লোককথাগুলিকে প্রথম বৈজ্ঞানিক শৃঙ্খলায় বিন্যাসকরণে প্রয়াসী হলেন তিনি। আর্নে লোককথার ঘটনা, চরিত্র ও মেজাজের লক্ষণ বিবেচনা করে কাহিনীর সুনির্দিষ্ট ছক আবিষ্কার করলেন। এক-একটি ছক হল এক-একটি ধরন বা type। আর্নে প্রতিটি টাইপের সূচক-সংখ্যা নির্দেশ করলেন। যেমন, জীবজন্তু সম্পর্কিত কাহিনীগুলির ক্রমিক সূচক-সংখ্যা : ১-২৯৯। রূপকথা, ফেয়ারি টেল, মারলেন ধরনের কাহিনীগুলির ক্রমিক সূচক-সংখ্যা-৩০০-১১৯৯। হাসিঠাট্টার কাহিনীগুলির ক্রমিক সূচক সংখ্যা : ১২০০-১৯৯৯। অতি সাধারণ কাহিনীগুলির ক্রমিক সূচক সংখ্যা : ২০০০-২৩৯৯। আর অনির্ধারিত শ্রেণীর কাহিনীগুলির ক্রমিক সূচক সংখ্যা হল : ২৪০০-২৪৯৯। তালিকা অনুযায়ী বাংলার 'নীলকমল লালকমল' আর ইউরোপের ‘Jack the Dragon Slayer গল্পের টাইপের সূচক হল ৩০০। বাংলার 'ঘুমন্ত পুরী' ও ইউরোপের Sleeping Beauty' গল্পের টাইপের সূচক সংখ্যা হল ৪১০। টাইপ পদ্ধতি সম্পূর্ণতা পেল মোটিফ পদ্ধতির আবিষ্কারে। মোটিফ পদ্ধতির আবিষ্কারক হলেন মার্কিনী লোকসংস্কৃতিবিদ স্টিথ টমসন। ৬ খণ্ডে প্রকাশিত তাঁর Motif Index of Folk Lituative (1932-1936) গ্রন্থ লোকসংস্কৃতির অনুশীলন গবেষণায় বিশেষ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করল। মোটিফ হল প্রসঙ্গ-উপকরণ। কাহিনীর ক্ষুদ্রতম উপাদান। এগুলির সমন্বয়ে কাহিনী গড়ে ওঠে। দেশকাল নিরপেক্ষ এগুলি। মোটিফের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে টমসন বলেছেন: A motif is the smallest element in a tale having a power to persist in tradition. In order to have this power it must have something unusual and striking about it. মোটিফের কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন সন্ন্যাসী-প্রদত্ত দৈব ওষুধে রানির সন্তান লাভ, অদৃশ্য হয়ে কারও হেঁটে যাওয়া, মৃতের সঙ্গে জীবিতের বিয়ে, বাকশক্তিসম্পন্ন পাখি ইত্যাদি। টমসন তাঁর গ্রন্থে মোটিফগুলিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেছেন, যেমন A. Mythological Motifs : B. Animals; C. Tabu; D. Magic; E. The Dead; F. Marvels; G. Ogres H. Tests; J. She Wise and the Foolish ; K. Deceptions: 1. Reversal of Fortune : M. Ordaining the Future: N. Chance and Fate P. Society ; Q. Rewards and Punishments; R. Captives and Fugitives; S. Unnatural Cruelty; T. Sex; U. She Nature of Life; V. Religion; W. Traits of Character; X. Humor; Z. Miscellaneous groups of Motifs মোটিফের আবিষ্কারের ফলে লোককথার আরও সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ সম্ভব হল, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লোকমানসের সাদৃশ্যটুকু খুঁজে পাওয়া গেল। বলাবাহুল্য, টাইপ-মোটিফ পদ্ধতির প্রয়োগ লোককথার বিশ্লেষণেই সীমাবদ্ধ। এ পদ্ধতি লোকসংস্কৃতির একটি অংশকে আলোকিত করে মাত্র। লোকসংস্কৃতির সমগ্র জগৎটি এ পদ্ধতিতে বিশ্লেষণযোগ্য নয়।

রাশিয়ান, লোকসংস্কৃতিবিদ ভলাদিমির প্রশ্নের Morphologya Skazki প্রথম লোককথার গঠনগত দিকটি নিয়ে আলোচনা দেখা গেল। গ্রন্থটি রাশিয়ান ভাষায় রচিত। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটি Morphology of Folktale নামে ইংরেজিতে অনূদিত হয় এবং সমগ্র বিশ্বে প্রচার লাভ করে। লোককথার আলোচনায় এর ফলে নতুন একটি মাত্রা যুক্ত হল। গঠনতত্ত্বগত পদ্ধতির উদ্ভব ঘটল। প্রপ দেখালেন, লোককথার পরিভ্রমণের সময় বহুক্ষেত্রে বিষয়ের পরিবর্তন সাধিত হলেও, কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য অপরিবর্তিত থাকে। তাঁর মতে, লোককথার ক্রিয়াশীলতা অপরিবর্তনীয়। ক্রিয়াশীলতা বলতে তিনি চরিত্রে সম্পাদিত কাজকে বুঝিয়েছেন। তিনি লোককথার চরিত্রদের ক্রিয়াশীলতাকে একত্রিশটি ভাগে ভাগ করেছেন। প্রত্যেক ক্রিয়াশীলতার আবার উপবিভাগ রয়েছে। গঠনতত্ত্বগত আলোচনায় ফরাসি নৃতত্ত্ববিদ ক্লদ লেভি স্ট্রসের নামটিও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণযোগ্য। তাঁর Structural Study of Myth লোককথার বিশ্লেষণে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছে। তাঁর মতে, Myth হল এক ধরনের Code প্রত্যেক Myth আবার কয়েকটি সূক্ষ্মতম এককের সমন্বয়। তিনি এই এককগুলির নামকরণ করেছেন Mytheme। এগুলির সহায়তায় Myth-এর গঠনপ্রকৃতি আলোচনায় তিনি নতুন পন্থা আবিষ্কার করেছেন। আমেরিকান লোকসংস্কৃতি শ্যালান ডাণ্ডেস নিয়ে এলেন Motifere-তত্ত্ব। Motif-এর সূক্ষ্মতম বিভাগ হল Motifeme। লোককথার ক্ষুদ্রতম একক। Motifeme কীভাবে Motif গড়ে তোলে তিনি তা দেখালেন।

একথা ঠিক, অধিকাংশ পদ্ধতির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে লোককথার সাহায্য নেওয়া হয়েছে। কোনো কোনো পদ্ধতির প্রয়োগ- যাথার্থ্য বোধ করি লোককথাচর্চার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু বেশ কয়েকটি পদ্ধতি রয়েছে, লোকসংস্কৃতির অন্যান্য শ্রেণী ও বর্গের অনুশীলনে যেগুলির প্রয়োগ স্বচ্ছন্দে করা যেতে পারে। সত্যি কথা বলতে কী, কোনও একটি বিশেষ পদ্ধতির সাহায্য নিয়ে সামগ্রিকভাবে লোকসংস্কৃতির অনুশীলন সম্ভব নয়। সেজন্য প্রয়োজনমতো বিভিন্ন পদ্ধতির কথাই ভাবতে হবে। অনুশীলন তাতে হবে নানামুখী। অনুশীলনে ব্যাপ্তি ও বৈচিত্র্য ঘটবে।

প্রাবন্ধিক - মানস মজুমদার
প্রবন্ধ সঞ্চয়ন - প্রথম খণ্ড (সত্যবতী গিরি ও সমরেশ মজুমদার সম্পাদিত)

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কলকাতার যীশু কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা বিচার ও সংবাদধর্মীতা

মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্যের নামকরণের সার্থকতা বিচার

ঘোড়সওয়ার কবিতার সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু ও আধুনিকতার লক্ষণ