প্রিয়তমাসু কবিতার নামকরণের সার্থকতা ও কবিতায় বর্ণিত স্বদেশপ্রীতি


প্রিয়তমাসু কবিতার নামকরণের সার্থকতা


যেকোনো সাহিত্যের নামকরণ নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ সাহিত্যের মর্মবস্তু তার শিরোনামের মধ্য দিয়েই পাঠকের কাছে প্রাথমিকভাবে উন্মোচিত হয়। তবে সেই নামকরণের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট থাকে। প্রিয়তমাসু কবিতাটির মধ্যে উদ্ভাসিত সেই প্রেক্ষাপটের আলোকে কবিতাটির নামকরণের যাথার্থ্য অনুধাবন করতে হবে। 

প্রিয়তমাসু কবিতাটি সুকান্ত ভট্টাচার্যের ঘুম নেই কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। ফলে প্রাথমিকভাবে এটা বোঝাই যায় যে তার কাব্যগ্রন্থের মূল সুরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কবিতাটি সংকলিত হয়েছে। আর এটা খুব সহজেই অনুমেয় যে, ওই কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত প্রিয়তমাসু কবিতাটিতে কবির উদ্বেগপূর্ণ দুর্ভাবনার চিত্র বা মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায়। আলোচ্য কবিতাটির আঙ্গিক অভিনব। এই কবিতাটিকে পত্রকাব্যের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। 

কবিতাটির বক্তব্য বিষয় একটি চিঠির প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে। কবি এই কবিতাটিতে প্রবাসী এক সৈনিকের মনোবাসনা ব্যক্ত করেছেন তার প্রেয়সীকে লেখা এই পত্রের মাধ্যমে। আর সেই মনোবাসনার প্রেক্ষাপটটি হল এক বিশেষ সময়ের পটভূমি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান পর্যায়ে যুদ্ধরত সৈনিক সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে এসে স্বদেশকে প্রিয়তমাসু বলে সম্মোধন করেছেন। তবে আলোচ্য কবিতাটির ক্ষেত্রে লক্ষণীয় যে কবিতাটিতে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী দেশকে মাতৃরূপে গ্রহণ না করে প্রিয়তমা রূপে গ্রহণ করা হয়েছে। 

কবিতাটিতে বীর সৈনিকের আত্মকথনের মাধ্যমে কবি আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন প্রকৃত বীর বা যোদ্ধাদের আত্মত্যাগের অমরকথা, যারা বিদেশের নির্যাতিত মানুষদের সঙ্গে সঙ্গে স্বদেশের নিপীড়িত জনগণের প্রতি সমবেদনা প্রদর্শন করে। তাই সাম্রাজ্যবাদীদের উৎখাত করতে তারা সচেষ্ট হন, তা সে বিদেশের মাটিতেই হোক বা স্বদেশের জন্মভূমিতেই হোক, এক সৈনিকের জবানীতে সেই ঐকান্তিক বাসনা নিবেদিত হয়েছে অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে। প্রিয়তমার সুখ দুঃখের সঙ্গে প্রেমিক যেমন একাত্মতা বোধ করেন, এখানে সৈনিকও স্বদেশকে প্রিয়তমারূপে কল্পনা করে সেইরকমই সহমর্মিতা বোধ করেন। আর সেই বোধ অকপট চিত্তে প্রকাশ করেছেন লিপির মাধ্যমে। 

যে স্বদেশভূমি পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ, যার আত্ম-অবমাননা এবং দুঃখ-যন্ত্রণার শেষ নেই। তার সেই কলঙ্ক ও দুঃখ মোচনের অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছে প্রেয়সীকে পাঠানো লিপির সাহায্যে। আসলে সৈনিকের জবানীতে কবি নিজেই যেন তার স্বদেশের জন্য আর্তি ও প্রেমাবেগটিকে তুলে ধরতে চেয়েছেন, প্রিয়তমাকে চিঠি লেখার অনুষঙ্গ রচনা করে। 

প্রিয়তমাসু নামকরণ পাঠকের কাছে দুটি ইঙ্গিত দেয়। প্রথমত, কবিতাটি আসলে একটি পত্র বা চিঠি। সৈনিক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে এই পত্রটি লিখেছে। দ্বিতীয়ত, চিঠিটি লেখা হয়েছে কোনো এক নারীর উদ্দেশ্যে। যে নারী মাতৃরূপা নন, প্রিয়তমা। আসলে এখানে স্বদেশকেই প্রিয়তমা নারীরূপে কল্পনা করা হয়েছে। দেশমাতৃকার চরণে আত্মবলিদানের জন্য কবি কখনও স্বয়ং সংকল্প করেন, কখনও বা দেশের আপামর মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে দেশসেবায় অনুপ্রাণিত করেছেন। 

বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় প্রমুখের সাহিত্যে দেশকে মাতৃরূপেই বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু এখানে দেখা যায় যে দেশকে মাতৃরূপে গ্রহণ না করে প্রিয়তমা রূপে গ্রহণ করা হয়েছে। দেশপ্রেমের সেই তীব্র আবেগ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য সাফল্যের সঙ্গে সঞ্চারিত করতে পেরেছেন বলেই কবিতাটির নামকরণ সার্থক হয়েছে।

প্রিয়তমাসু কবিতায় কবির স্বদেশ প্রীতির পরিচয়


প্রিয়তমাসু কবিতাটিতে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য যুদ্ধের রক্তাক্ত পথ অতিক্রম করে একজন বীর সৈনিকের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের কাহিনি দীপ্ত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তুলে ধরেছেন। কবি বলেছেন - 

সীমান্তে আজ আমি প্রহরী।
অনেক রক্তাক্ত পথ অতিক্রম ক’রে
আজ এখানে এসে থমকে দাড়িয়েছি-
স্বদেশের সীমানায়।

তার যুদ্ধের বর্ণনা দিতে গিয়ে পরের স্তবকেই কবি বলেছেন, যুদ্ধের প্রবল তাড়নায় তিনি তিউনিসিয়া থেকে ইতালি, ইতালি থেকে ফ্রান্স, ফ্রান্স থেকে বর্মায় ছুটে গেছেন রাইফেল হাতে দুর্নিবার গতিতে।

যুদ্ধের অবসরে শুরু হয় তার স্মৃতিচারণ। মনে পড়ে স্বদেশকে। যুদ্ধ জয়ের ফাঁকে ফাঁকেই তাকে পীড়া দিয়েছে স্বদেশবাসী ও আপনজনের মর্মবেদনা। অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হয়েছে তার হৃদয়। কেবলই তার মনে হয়েছে দারিদ্র্য, মহামারী, বন্যা, দুর্ভিক্ষ পীড়িত স্বদেশবাসীর কথা। অথচ স্বদেশের এই সংকটাপন্ন অবস্থাতেও তিনি বিশ্বকে বিপদমুক্ত করতে ছুটে বেড়িয়েছেন। কবির মনে সংশয় জেগেছে, তার স্বদেশ আজও অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে কি না। এক অজানা আশঙ্কায় তিনি আজ দোদুল্যমান। 

এইসব ভাবনার বৃত্তে আলোড়িত হতে হতেই কবি আশাবাদী হয়ে স্বদেশের উদ্দেশ্যে এই চিঠি লিখেছেন। কারণ তার ঘরে ফেরার সময় হয়েছে। বাড়ি ফেরার জন্য তার হৃদয় উন্মুখ হয়ে উঠেছে। কিন্তু দেশ ও দেশবাসীর কথা চিন্তা করে পরক্ষণেই তার হৃদয় নৈরাশ্যের অন্ধকারে ভরে গেছে। যুদ্ধজয়ী সৈনিকের জন্য কেউ প্রতীক্ষা করে বসে নেই। মালায়, পতাকায়, প্রদীপে, মঙ্গল ঘটে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য কেউ প্রস্তুত হয়ে নেই। তবুও যুদ্ধ জয়ের পর স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের সংবাদে তার আপনজন বা প্রেয়সীর হৃদয় নেচে উঠবে ঠিকই। সেটাই কবির কাছে একমাত্র আনন্দের কথা। আর তিনি যুদ্ধ চান না। ইন্দোনেশিয়ার দিকে আর যাত্রা নয়। এবার তার ঘরে ফেরার পালা। কবি বলেছেন - 

পরের জন্যে যুদ্ধ করেছি অনেক,
এবার যুদ্ধ তোমার আর আমার জন্যে।

সৈনিক কবির মন একান্তভাবেই পড়ে আছে স্বদেশের দিকে। পরের জন্য তিনি অনেক যুদ্ধ করেছেন, এখন স্বদেশের জন্য যুদ্ধই হবে তার জীবনের একমাত্র ব্রত। বাইরে বাইরে যুদ্ধ করে তার ফলপ্রাপ্তির হিসাব মিলাতে গিয়ে কবি বলেছেন, সাম্রাজ্যবাদীদের হাত থেকে তিনি তিউনিসিয়াকে ছিনিয়ে নিয়েছেন, ইতালি ও ফ্রান্সকে শত্রুমুক্ত করে জনগনের বন্ধুত্ব ও মুক্তির মন্ত্রলাভ করেছেন। শেষে বর্মাকে শত্রুমুক্ত করে ঘরে ফেরার তাগিদ অনুভব করেছেন। স্বদেশের কথা মনে হতেই তার মন বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে।

বেদনাহত কবি নিজেকে বাতিওয়ালার সঙ্গে তুলনা করেছেন। কারণ বাতিওয়ালার কাজ হল রাজপথে বাতি জ্বালিয়ে চারদিক আলোকিত করা। অথচ তার নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার - 

আমি যেন সেই বাতিওয়ালা,
সে সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে
অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য,
নিজের ঘরেই জমে থাকে দুঃসহ অন্ধকার।।


বিশ্বের মুক্তির জন্য সৈনিক কবি অসম সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে জয় ছিনিয়ে আনলেও তিনি স্বদেশের পরাধীনতার শৃঙ্খল বা দারিদ্র্যের কালিমা ঘুচাতে পারেন না কিছুতেই। কবির এই অন্তর্বেদনাই অকপটে উচ্চারিত হয়েছে এই কবিতায়।

স্বদেশের কল্যাণের জন্য তিনি সৈনিক কবি। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাত থেকে তার স্বদেশভূমিকে রক্ষা করাই হল তার প্রধান কাজ। স্বদেশের বুকে এখনও ঘোর অন্ধকার। সেই অন্ধকারের বুকে আলো জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্যই কবির কর্তব্যবোধ সচেতন হয়ে উঠেছে। তাই এবারের লড়াই বিদেশের মাটিতে নয়, সে লড়াই পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করার জন্য স্বদেশভূমির বুকে। সমাজতান্ত্রিক, স্বদেশপ্রেমিক কবির এই ঐকান্তিক বাসনাই মূর্ত হয়ে উঠেছে এই কবিতাটিতে।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কলকাতার যীশু কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা বিচার ও সংবাদধর্মীতা

মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্যের নামকরণের সার্থকতা বিচার

ঘোড়সওয়ার কবিতার সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু ও আধুনিকতার লক্ষণ