ঘোড়সওয়ার কবিতার সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু ও আধুনিকতার লক্ষণ
ঘোড়সওয়ার কবি বিষ্ণু দে'র অসাধারণ সার্থক একটি কবিতা। কবিতাটির মধ্যে বৈপ্লবিক পটভূমিকা নির্মাণ করেছেন কবি। কবি চিত্তের অভিপ্রায় অজস্র সুখ ও সীমাহীন ভালোবাসা দিয়ে গড়া শোষণমুক্ত নতুন এক পৃথিবীর জন্ম হবে। বুর্জোয়া শ্রেণি জন জোয়ারের আতঙ্কে আতঙ্কিত। শুনেছে তারা জনসমুদ্রের জোয়ারের পদধ্বনি। সমাজব্যবস্থাটা চোরাবালির ন্যায় ভিত্তিহীন। সেই পুরাতন ব্যবস্থাকে ভেঙে নতুন করে গড়ে তোলার একটি অভিপ্রায় কবি চিত্তে জেগে উঠেছে। আলোচ্য কবিতায় যে দূর দেশের বিশ্ব বিজয়ী দীপ্ত ঘোড়সওয়ারের অশ্বক্ষুরধ্বনি বার বার শোনা যায়, সে হল বিপ্লবের পথে মুক্তির প্রতীক। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা কবির মতে -
"চোরাবালির মতো ভিত্তিহীন। ঢেউয়ের ঘোড়ায় চড়ে বিপ্লবরূপী রাজপুত্র আসছে বন্ধ্যাত্বের শৃঙ্খলে বন্দিনী চোরাবালিকে উদ্ধার করতে।"
ঘোড়সওয়ার কবিতায় যে সমুদ্রের কথা বলা হয়েছে, তা সাধারণ প্রাকৃতিক সমুদ্র নয়। তা হল জনসমুদ্র। ঘোড়সওয়ারও এখানে এক দেশনায়কের প্রতীকী চরিত্র। বিপ্লব আসবে বন্ধ্যা রক্ষণশীল সমাজের বুকে। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন মানুষের প্রস্তুতি। সেই প্রস্তুতির জন্য বৈপ্লবিক ভাবনার উজ্জীবন ঘটিয়ে বিদ্রোহাত্মক দৃষ্টিকোণ থেকে দেশ নায়ককে উদ্বুদ্ধ করে তাই কবি লিখেছেন -
"জনসমুদ্রে জেগেছে জোয়ার,হৃদয়ে আমার চড়া।চোরাবালি আমি দূরদিগন্তে ডাকি –কোথায় ঘোড়সওয়ার ?"
ঘোড়সওয়ার কবিতার মধ্যে নিছক বৈপ্লবিক পটভূমিকা নির্মাণ করা হয়নি। কবিতাটিকে প্রচার সর্বস্ব না করে রসোত্তীর্ণ শাশ্বত আবেদনে ভরপুর করে গড়ে তোলার জন্য রোমান্টিক প্রেমভাবনার দিকটিকেও সংযোজন করা হয়েছে। সেই কারণে প্রেম মিলনের প্রসঙ্গে এসেছে আসঙ্গ লিপ্সার ইঙ্গিত। এই রোমান্টিক চেতনা কবিতাটিকে অনেক বেশি সজীব ও প্রাণবন্ত করে তুলেছে। তাই কবিকে আমরা বলতে শুনি -
"আমার কামনা ছায়ামূর্তির বেশেপায়ে-পায়ে চলে তোমার শরীর ঘেঁষেকাঁপে তনুবায়ু কামনায় থরো থরো।কামনার টানে সংহত গ্লেসিআর।"
আধুনিক কবিদের মধ্যে বিষ্ণু দে এমন একজন কবিশিল্পী, যার মধ্যে আমরা একই সঙ্গে বৈপ্লবিক ভাবনা ও রোমান্টিক ভাবনা প্রত্যক্ষ করি। ঘোড়সওয়ার কবিতায় বিপ্লব সমর্থিত জনসমুদ্রের জোয়ার, দীপ্ত বিশ্ব বিজয়ীর বর্শা তোলা, তার নির্ভীক হওয়া, জনসমুদ্রের উন্মাদ কোলাহল, ভীরুতার দ্বার ভেঙে দেওয়া প্রভৃতির মাধ্যমে স্পষ্টরূপে প্রকাশ পেয়েছে বৈপ্লবিক চেতনা। অন্যদিকে রোমান্টিক প্রেম ভাবনা প্রসঙ্গে চাঁদের আলোর প্রসঙ্গ, হালকা হাওয়ায় হাত ধরার কথা, প্রিয়তমের প্রসঙ্গ, অধীর কামনায় কম্পমান দিক, তনুবায়ুর থরো থরো করে কাঁপার প্রসঙ্গ, গ্লেসিয়ারের কথা প্রভৃতি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
'ঘোড়সওয়ার' কথাটির অর্থ তাৎপর্যপূর্ণ। সেকালে ঘোড়সওয়ারের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। অশ্বারোহী বাহিনী জীবন-মরণ সংগ্রামের মধ্যদিয়ে এগিয়ে চলত। তাই ঘোড়সওয়ার কথাটির মধ্যে যেন যুদ্ধ ও সংগ্রামের ইতিহাস কিছুটা প্রচ্ছন্নভাবে আছে। আমরা সকলেই জীবনযুদ্ধের ঘোড়সওয়ার। প্রবল আত্মবিশ্বাস নিয়ে আমরা জীবনের লক্ষ্যপথে ছুটে চলি। যে চলার পথে পিছনে ফিরে তাকানোর কোনো সময় নেই। তাই অন্তরে যতই সন্দেহ বা সংশয়ের দোলা থাক না কেন তথাপি সংগ্রাম থেকে পিছিয়ে আসার কোনো উপায় নেই। তাই বলা যায় যে, ঘোড়সওয়ারের মধ্যদিয়ে কবি বিষ্ণু দে জীবনের গতিশীল রূপকে পরিস্ফুট করতে চেয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথ 'বলাকা' কাব্যগ্রন্থে গতিবাদ তত্ত্বকে এগিয়ে চলার বানীমন্ত্রে প্রকাশ করেছেন এইভাবে -
“হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোথা, অন্য কোন্খানে।”
ঘোড়সওয়ার কবিতার মধ্যে সেই চলমান জীবনের সংগ্রামী রূপের অপরূপ পরিচয় প্রতিভাত হয়েছে।
যাইহোক, আলোচ্য কবিতাটিতে কবি একই সঙ্গে বৈপ্লবিক চেতনার বহ্নিকণা যেমন জ্বেলেছেন, তেমনই রোমান্টিক প্রেম ভাবনার দিকটিকেও অসাধারণ ভাবে তুলে ধরেছেন। সুতরাং একথা বলা যায় যে, আধুনিক কবিতাটিতে আধুনিকতার লক্ষণ পরিপূর্ণভাবে বর্তমান।