কলকাতার যীশু কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা বিচার ও সংবাদধর্মীতা


সাহিত্য রচনার নামকরণে বিশেষভাবে কবিতার নামকরণ পাঠকের কাছে অনেক সময় ইঙ্গিতবাহী ও ব্যঞ্জনাধর্মী তাৎপর্য বহন করে আনে। তাছাড়াও এই নামকরণের মধ্যদিয়ে কবি বা সাহিত্যিক পাঠকের কাছে সাহিত্য বা কবিতার ভাববস্তু সম্পর্কে একটা প্রাথমিক আভাষ তুলে ধরতে চান। সেইক্ষেত্রে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কলকাতার যীশু কবিতাটির নামকরণ যথেষ্ট ব্যঞ্জনাধর্মী হয়ে উঠেছে বলা যায়। 

কলকাতার যীশু কবিতায় কবি প্রায় সাংবাদিকের ভূমিকায় কলকাতার চৌরঙ্গী অঞ্চলের ব্যস্ততম অঞ্চলের একটি ঘটনাকে প্রতিবেদনের মতো করে উপস্থাপিত করেছেন পাঠকদের সামনে। প্রতিদিনের মতো কর্মব্যস্ত চৌরঙ্গী পাড়ার রাজপথে সেদিন ছুটে চলেছিল অজস্র যানবাহন। দুরন্ত তাদের গতি। সেই গতিকে প্রয়োজনবোধে থামানোর জন্য থাকে লালবাতির সিগন্যাল। কিন্তু সেই লালবাতির সিগন্যাল না থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় চলমান রাস্তায় দুরন্ত গতিতে ছুটে আসা সমস্ত যানবাহন। তখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছিল একটি সদ্য হাঁটতে শেখা শিশু। সে সমস্ত ট্রাফিককে যেন মন্ত্রবলে থামিয়ে দেয়। জনতার তীব্র আর্তনাদকে উপেক্ষা করে সে এগিয়ে চলে তার গন্তব্যে। তাকে রক্ষা করার জন্য চারদিক থেকে ছুটে আসে পথচারী ফেরিওয়ালা। কিন্তু সেদিকে তার কোনো খেয়ালই নেই। 

বৃষ্টিভেজা কলকাতা শহরের বুকে তখন নেমে এসেছিল দীর্ঘ বল্লমের মতো সূর্যের মায়াবী আলো - 

মেঘের হৃৎপিণ্ড ফুঁড়ে
নেমে আসছে;
মায়াবী আলোয় ভাসছে কলকাতা শহর।

সেই মায়াবী মুহূর্তটি সংবেদনশীল কবিমনকে এক অন্যতর অনুভবে আন্দোলিত করেছিল। কবি এই ঘটনাটির মধ্যে আবিষ্কার করেছিলেন মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক ভিন্নতম তাৎপর্য। 

কলকাতার রাস্তায় ভিখারি মায়ের এই নগ্ন শিশুটির মধ্যে কবি আবিষ্কার করলেন এই কলকাতার যীশুকে। অধ্যাপক বার্ণিক রায় বলেছেন - 

প্রচলিত ঈশ্বর সাধনায় নয়, ভিখিরি মায়ের সম্পূর্ণ উলঙ্গ শিশুর মধ্যেই কবি কলকাতার যীশুকে দেখতে পেয়েছেন।

কলকাতার যীশু সেই মানবতারই পূর্ণপুরুষ। যে মৃত্যুকে জয় করতে উদ্যত মৃত্যুর মাঝখান দিয়ে এগিয়ে গেছে। তার যাত্রা ও অন্ধকার থেকে আলোর পথে। নগ্ন শিশুটির ভয়হীনভাবে রাজপথ পার হওয়ার ছবিটি সেই মুহূর্তে কবির মনে যীশুর কাহিনির সঙ্গে সমান্তরাল সংবেদন সৃষ্টি করে। সদ্য হাঁটতে শেখা ভিখারি মায়ের শিশুটির হাঁটার ছন্দ কবির কাছে পবিত্রতম বলে মনে হয়। এই শিশুটি সকলের দৃষ্টির সামনে দিয়ে হেঁটে চলেছিল। কিন্তু কেউ তাকে অতিক্রম করার সাহস পাচ্ছিল না। এই দৃশ্যটি সমান্তরালভাবে বহু পুরাতন একজন মানুষের ভাবছবিকে পরিস্ফুট করে তোলে। সেই শিশুটি হলেন বেথলেহেমের জ্যোতির্ময় পুরুষ যীশু। যীশু একদিন এমনি ভাবেই মৃত্যুকে উপেক্ষা করে আত্মিক শক্তিতে পৃথিবীর উপর আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

মূলকথা হল, যন্ত্রণাকে জয় করে মৃত্যুঞ্জয়ী হতে পারলেই আসে পূর্ণতা। বলতে দ্বিধা নেই এটাই কবির আকাঙ্খিত। এই কবিতাটিকে তাই আমরা অনায়াসে এক মানবিকতাবোধের উত্তরণের কবিতা বলে চিহ্নিত করতে পারি। প্রচলিত ঈশ্বর সাধনায় নয়, বাস্তব জীবনের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে ভিখারি মায়ের এই শিশুটির মধ্যে যীশুর ছবি দেখা এককথায় তা মানবিকতাবোধেরই উত্তরণ। 

কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এই সংবাদধর্মী কবিতাটির যে কলকাতার যীশু নামকরণ করেছেন, তা শুধু বাইরের চমক আনে না, তা সার্থকভাবে ব্যঞ্জিতও করে এই সুগভীর অনুভবকে। তাই সবদিক বিবেচনা করে বলা যায় কবিতাটির নামকরণ যথার্থ এবং সার্থক হয়েছে।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্যের নামকরণের সার্থকতা বিচার

ঘোড়সওয়ার কবিতার সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু ও আধুনিকতার লক্ষণ