বাংলা লোকসাহিত্যে ইতিহাসচেতনা - অন্তরা মিত্র

খোকা ঘুমোলো পাড়া জুড়োলো বর্গী এল দেশে।
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেবো কিসে।

সেই কোন সুদূর অতীতে 'ত্রাহি' রব উঠেছিল বর্গি হাঙ্গামায়। নবাব আলিবর্দির শাসনকালে ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দশ বছর ধরে পশ্চিমবাংলার বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে বর্গিরা লুঠতরাজ চালায়। নির্বিচার হত্যা, অগ্নি-সংযোগ, ফসল বিনষ্টির পর নবাবের তৎপরতায় হাঙ্গামার অবসান ঘটে। কিন্তু শ্বাসরোধকারী স্মৃতিটি থাকে টাটকা। বছরের পর বছর ঘুমপাড়ানি লোকছড়া তাকে বুকে করে বয়ে চলে। এটাই লোকসাহিত্যের ইতিহাস চেতনা। কোন বিশেষ যুগের পাথুরে প্রমাণ নয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন 'আস্ত জগতের ভাঙ্গা টুকরো' লোকসাহিত্য তাই-ই জড়ো করে চলে। এটিই তার বৈশিষ্ট্য, এ-সাহিত্য অজ্ঞাত-উৎস, শ্রুতিনির্ভর, ঐতিহ্যাশ্রয়ী চলমান। সংহত সমাজমানস যেখানে সক্রিয়, সেখানেই লোকসাহিত্যের উৎসার। যে-সব ঘটনায় সমাজচৈতন্য আলোড়িত হয়, দুঃখ পায়, আনন্দে উথলে ওঠে, প্রতিবাদে মুখর হয় কিংবা শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়ে লোকসাহিত্য তার সৃষ্টির মধ্যে ধরে রাখে সেগুলি। এইভাবেই তার বিস্তৃতি ধূসর অতীত থেকে অনাগত ভবিষ্যতে। লোকবিজ্ঞানী R. M. Dawkins যথার্থই বলেছেন — It has been carried down the centuries and like a snow ball without losing its ancient care has gathered round it the spiritual and imaginative riches of a people of a much more civilized culture. (The Meaning of Folktale. P 428, 1956) অর্থাৎ সমগ্র লোকজীবনের খণ্ড বিক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরে লোকসাহিত্য। সেই চিত্রগুলিতে একদিকে যেমন ব্যক্তিনিরপেক্ষ বিভিন্ন যুগ-নির্যাস ঘনীভূত তেমনি ইতিহাস-নির্দিষ্ট স্থান-কাল-পাত্রের কিছু স্মৃতিফলকও প্রোথিত। লোকসাহিত্য মন্থন করে, লোকসাহিত্যের বিভিন্ন শাখাগুলি পর্যবেক্ষণ করে আমরা কিছু ঐতিহাসিক সূত্রানুসন্ধানের চেষ্টা করতে পারি।

সামাজিক কর্ম ও চিন্তাধারার নানা ঘাত-প্রতিঘাত প্রত্যক্ষ করা যায় ছড়ার মধ্যে। বহুবিবাহ, কুলীন প্রথা ছিল একদা বাংলাসমাজের কলঙ্ক। শিবঠাকুরের বিয়ে হলো তিন কন্যে দান'—বুড়ো শিব ঠাকুরের চরণে একই সঙ্গে তিনটি কন্যাকে বৈবাহিক সূত্রে সমর্পণ, সমাজে নারীর অবমাননাকর অবস্থানকেই চিহ্নিত করেছে। তেমনি সেঁজুতি ব্রতে ঐকান্তিক কামনা মূর্তি ধরেছে ছড়ায় ‘হাতা হাতা হাতা/খা সতীনের মাথা।' — বিবাহিত জীবন সপত্নীশূন্য নিষ্কণ্টক করার আপ্রাণ প্রয়াস!

কৌলিন্যের বিরুদ্ধে খোদ অসহায়া কন্যার শুভার্থীদের প্রতিবাদও গোপন থাকেনি।

চোখ থাক্ তোর মা-বাপ, চোখ যাক্‌ তোর খুড়ো
এমন বরে বিয়ে দিয়েছে তামাক খেকো বুড়ো

সমাজে যে কন্যাপণেরও প্রচলন ছিল তাও প্রতিবাদী কন্যার অভিমানে ধরা পড়েছে—

এত টাকা নিলে বাবা, পুরে দিলে বিয়ে।
এখন কেন কানছ বাবা গামছা মুড়ি দিয়ে।

বৃহত্তর বিদেশী শক্তি যখন আছড়ে পড়ে সমাজের ওপর, পলকে প্রলয় ঘটে। সেই সার্বিক অস্থিরতা এসেছিল তুর্কি আমলে। ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে তুর্কি-পাঠান-মোঘল শাসনকালে লোকায়ত বাঙালি হিন্দু সমাজের সঙ্গে মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের পদে পদে সংঘাত বেঁধেছে। পঞ্চদশ শতাব্দীর কবি বিদ্যাপতি কীর্তিলতা গ্রন্থে এই পারস্পরিক বিদ্বেষের আভাস দিয়েছেন।

হিন্দু তুরকে মিলন বাস।
একক ধৰ্ম্মে অওকো উপহাস।
কত ই মিলিমিস কতই ছেদ।

লোকছড়ার ছত্রে ছত্রে এই বিদ্বেষ বিষ ছড়িয়ে আছে :

আল্লা আল্লা বল ভাই আল্লা নাইক ঘরে
সোলার টুপী মাথায় দিয়া বাগুন চুরি করে।

পাল্টা আক্রমণ এসেছে মুসলমান সমাজের পক্ষ থেকে

হরি বড় দয়াময় / কথায় বটে, কাজে নয়।

বঙ্গে মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠার পর রাজানুকূল্যে এবং ধর্ম প্রচারকদের প্রচেষ্টায় বিপুল সংখ্যক হিন্দু ও বৌদ্ধ, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। ধর্মান্তরের এই প্রক্রিয়ার ফল, বহু হিন্দু মহিলার মুসলমান স্বামী গ্রহণ। লোকমনের রক্ষণশীলতা কটাক্ষ ফেলেছে ছড়ায়

ফুলকিরভিতর পাকা পান। 
ছি হিন্দুর সোয়ামি মোচরমান।

আবার বিপরীত ঘটনাও দুর্লক্ষ্য নয়। সেখানেও একই ব্যঙ্গোক্তি-

দিদিলো কইর কারে হায়,
খোকার বউ সাঁঝ দেখাতে
'চেরাগ বাতি' চায়।

ধর্মগত এই বিদ্বেষ থেকে রেহাই পায়নি বৈষ্ণবধর্মও। চৈতন্যদেবের মহানুভব ব্যক্তিত্বের কূলপ্লাবী আকর্ষণে ভেসেছিল গোটা বাংলা। লোকছড়ায় তাই কদম, ফুল, নীলমণি, মাখন চোরার আনাগোনা বারবার। 'রাধা-র ঘরে চোর ঢুকেছে চুড়োবাঁধা এক মিনসে!' কিংবা 'কদমতলায় দেখা পেলে বাঁশি কেড়ে নেব' এই জাতীয় অভিব্যক্তির নজির ভুরি ভুরি। আবার অবক্ষয়িত বৈষ্ণবধর্মকেও কটাক্ষ করেছে ছড়া—

বৈষ্ণব টোম টোম
হাঁড়ির ভেতর সুধা আছে
কচ্ছপ খাওয়ার যম।

ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারের মন্তব্য এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। গ্রন্থে তিনি জানিয়েছেন History of Bengal. "After the passing away of their Master Chaitanya, despite the lack of disciplined organisation and of control by a hierachy of priest acting under one common supreme pontiff the new Vaisnavism emerged. It had produced two wholesome fruits. Sacrifice of animal and the drinking ofstrong wine as a religious duty.” 'সুধা আর কচ্ছপ' সেই মদ্য ও মাংসাসফির দিকেই ইঙ্গিত করে।

সমাজের নানা ওঠাপড়ার সঙ্গে অর্থনীতি জড়িয়ে আছে। লোকছড়াগুলি ক্রমবর্তিত অর্থনৈতিক ক্রিয়া প্রক্রিয়ার অনেকটাই ধরে রেখেছে। বস্ত্রশিল্পে বাংলার সুনাম বহু প্রাচীনকাল থেকেই। নিদ্রা ও স্বপ্নের দূতী ঘুমপাড়ানি মাসিপিসিকে সরু সুতোর কাপড় সোব' এই প্রণামীর প্রতিশ্রুতি দেওয়া কিংবা প্রসাধনরত খোকাবাবুকে হাজার টাকার মলমলি খান পরানো— এসবই বস্ত্রশিল্পের সমৃদ্ধিরই সূচক। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদারের উক্তিটি মনে করি— Bengal maintained her reputation for textile industry throughout the ancient and medieval period. Silk, linen and cotton fabrics had all attained high degree of excellence." [History of Ancient Bengal ]

লোকমনও সরাসরি আর্থিক উপার্জন ও সমৃদ্ধির কারণ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে চরকাকে--

চরকা আমার ভাতার-পুত, চরকা আমার নাতি
চরকার দৌলতে আমার দুয়ারে বন্ধ্যো হাতি।

মুসলমান ভূমিপতিদের আমলে বেতনভোগী রাজকর্মচারীদের যে ফারসি পড়ার উপর একটু জোর দেওয়া হত, তার প্রমাণ পাই ব্রতিনীদের উচ্চারিত মন্ত্রে

আরসি আরসি আরসি
আমার স্বামী পড়ুক ফারসি।

আবার রাজাদের আরক্ষাবিভাগে যে ডোম সৈন্যের অবাধ প্রতিপত্তি ছিল তার নজির খেলাধূলার এই ছড়াটি

আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে
ঢাক মৃদং ঝাঁঝর বাজে।
বাজতে বাজতে চলল ঢুলি .....

লোকবিদ আশুতোষ ভট্টাচার্য এই পংক্তিগুলির ব্যাখ্যা দিয়েছেন— 'আগডুম অর্থ অগ্রবর্তী ডোম সৈন্যদল, বাগডুম অর্থাৎ বাগ বা পার্শ্ববর্তী ডোম সৈন্যদল এবং ঘোড়াডুম অর্থাং অশ্বারোহী ডোম সৈন্যদল।' (বাংলার লোকসাহিত্য) এই মন্তব্যের সমর্থন পাই মনীষী বিনয় ঘোষের পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি গ্রন্থের ১ম খণ্ডে—'একদিন ডোম সৈনাই বাংলার পশ্চিম সীমাস্ত রক্ষা করিত। বিষ্ণুপুর রাজনগর প্রভৃতি স্থানের সামত্ত রাজগণ ডোম সৈন্যদল রক্ষা করিতেন। মধ্যযুগের বাংলার লৌকিক সাহিত্য তাহাদের শৌর্যবীর্যের কাহিনীতে পরিপূর্ণ।' অর্থাৎ উদ্ধৃত লোক ছড়াটি বিগত দিনের জনসেনাবাহিনীর জাঁকজমকটিকেই তুলে ধরেছে।

১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দ থেকেই মোটামুটি বাংলার মানুষ পর্তুগিজদের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করে। সে পরিচয় সুখকর নয়। পর্তুগিজ জলদস্যুদের অত্যাচার বাংলার জনজীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। লোকছড়ায় তারই প্রতিক্রিয়া।

আইল রে ফিরিঙ্গি দল।
দেশটা গেল রসাতল ।

কেবল লুঠতরাজই নয় অবাধে নারীদের উপর অত্যাচার চালাত তারা। এ প্রসঙ্গে অতুল সুর বলেছেন, 'মেয়েদের ধর্ষণ করা ও জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করা বা রক্ষিতা করে রাখা পর্তুগিজদের স্বভাবে দাঁড়িয়েছিল। [ বাংলার সামাজিক ইতিহাস | এবার একটি খেলার ছড়ার বিবরণ দিই—-

উপেনটি বাইস্কোপ
নাইনটেন টাইস্কোপ। 
টুলটানা বিবিয়ানা
সাহেববাবুর বৈঠকখানা
বাবু বলেছেন যেতে
পান সুপারি খেতে।

এই সাহেববাবুদের সঙ্গে ইংরেজ এবং পর্তুগিজদের একটা মিলের আভাস পাওয়া যায়। ঐতিহাসিক অতুল সুর বাঙলা ও বাঙালী গ্রন্থে এ-ও বলেছেন, ইংরেজরা যখন কলকাতা শহরের পত্তন ক বাংলার পুরুষের ইংরেজদের অধীনে হয় দোভাষী নয়তো কেরানীর কাজ করত। আর মেয়েরা আর বা রক্ষিতার পেশা অবলম্বন করেছিল। ব্যান্ডেল তখন এই সকল মেয়ে পাঠাবার আড়তে পরিণত হয়েছিল।' অর্থাৎ বৈঠকখানায় গিয়ে সাহেবদের মনোরঞ্জন করা ঘটনাটি ইতিহাস সমর্থিত। তবে সাহেব বিদ্বেষ বাঙালির মজ্জাগত। এই বিদ্বেষ কখনো বা সশস্ত্র সংগ্রামের চেহারা

নিত। নিম্নের লোকছড়া তারই সূচক—

ঐ দ্যাখ সাহেবের গাড়ী
কপাট খোল বারুদ ভরি।

হতভাগ্য সিরাজউদ্দৌলাও লোকমনের সহানুভূতি আদায় করেছেন—

কি হলোরে জান
পলাশীর ময়দানে নবাব হারাল পরাণ।
তীর পড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি পড়ে বয়ে।
একলা মীরমদন সাহেব কত নিবে সয়ে।
_________________________________
নবাব কান্দে সিপাই কান্দে আর কান্দে হাতী
কলকাতায় বসে কান্দে মোহনলালের পূতি। 
দুধে ধোয়া কোম্পানির উড়িল নিশান। 
মীরজাফরের দাগাবাজিতে গেল নবাবের প্রাণ।।

১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে জুন পলাশির রণাঙ্গনে প্রভুভক্ত মীরমদন ও মোহনলালের আমরণ সংগ্রাম, মীরজাফরের কলঙ্কিত দেশদ্রোহিতা এবং শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার পতনের ছবিগুলি উদ্ধৃত লৌকিক ছড়ায় বিবৃত।

ছড়ায় নীল বিদ্রোহের (১৮৫৯-৬০) চিত্রও দুর্লক্ষ্য নয়। অর্থকরী ফসল নীল একসময় বাংলার কৃষকের পক্ষে অভিশাপ হয়ে দাড়িয়েছিল। বাধ্যতামূলক নীলচাষ আর বলপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণ এই দুই অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্ষোভ আছড়ে পড়েছে প্রচলিত ছড়ায়-

ভাত মারলে নীল বাঁদরে
জাত মারলে পাদরী ধরে।

ভারতের ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম যখন শেষ পর্যায়ে তখন সমগ্র বিশ্বে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধ্বংসলীলা চলেছে। একদিকে ব্রিটিশ, ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে মিত্র শক্তি, অন্যদিকে জার্মানি ও জাপানের নেতৃত্বে অক্ষ শক্তি। জাপানি বিমান-আক্রমণ কলকাতা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। জাপানি বোমার ভয়ের ছবি লৌকিক ছড়ায় এইভাবে পাওয়া যায়-

সা-রে-গা-মা-পা-ধা নি
বোম ফেলেছে জাপানি
বোমের ভেতর কেউটে সাপ
বৃটিশ বলে বাপরে বাপ।

অত্যাচারী বিদেশীশাসকের ‘বাপরে বাপ' বলার মধ্যে স্বাধীনতাকামী ভারতবাসীর ইচ্ছা চরিতার্থ হয়েছে।

এইভাবে সচল ছড়াগুলি আহরণ করেছে জীবনের তথ্য, যে জীবন ছড়িয়ে আছে ঘাটে মাঠে পথে প্রান্তরে, পল্লীর শ্যামলিমা থেকে নাগরিক প্রাসাদে লোকছড়া তাকে পর্যবেক্ষণ করেছে যুগে যুগে। এই চলমানতাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ : ইহারা অতীত কীর্তির ন্যায় মৃতভাবে রক্ষিত নহে। ইহারা — সজীব ইহারা সচল। ইহারা দেশকাল পাত্র বিশেষে প্রতিক্ষণে আপনাকে অবস্থার উপযোগী করিয়া তুলিতেছে।

——এই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার তাগিদেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিধ্বনি ওঠে ছড়ায়-

বীর বাঙালি অস্ত্র ধর
বাংলাদেশকে স্বাধীন কর।

আবার ১৯৭১-এর ২৫শে মার্চের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের নায়ক টিক্কাখানও ধিকৃত হন

ছড়ায়-

ইলিশ মাছের তিরিশ কাটা
বোয়াল মাছের দাড়ি।
টিক্কা খান ভিক্ষা করে 
বাংলাদেশের বাড়ী।

রাশিয়ান লোকবিজ্ঞানী সকোলড এই কালচেতনাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন Russian Folklore গ্রন্থে : The development of the folk rhymes respresents a most interesting process with complete meanderings and intertwinings reflecting with great fullness and diversity both the historical life with its social conflicts and the fialects of class conflict."

শুধুই কি ছড়া? ইতিহাস চেতনার পরিচয় পাওয়া যায় লোকসাহিত্যের অন্যান্য শাখাগুলিতেও।

লোকসাহিত্যের অপর সমৃদ্ধ শাখা ধাঁধা। ধাঁধা হল বুদ্ধির পরীক্ষা। একটুখানি রসের মোড়কে প্রতিপক্ষের দিকে নিক্ষিপ্ত হয় তির্যক প্রশ্নবান। উত্তর জানলে জিৎ, হারলে হেনস্তার সীমা নেই— যে না বলতে পারে সে একটা ধেড়ে ইঁদুর'। নৃতাত্ত্বিক জেমস ফ্রেজার, এম ব্লুমফিল্ড, অ্যানডুল্যাং প্রমুখেরা ধাঁধার আদান প্রদানের মধ্যে মানুষের ধর্মবিশ্বাসের আদিমতম রূপ প্রত্যক্ষ করেছেন। এছাড়াও তাঁরা বলেছেন যে সদৃশমূলক জাদুবিশ্বাস (Homeopathic magic) ধাঁধার উৎপত্তির প্রেক্ষাপটে কার্যকর। নির্ভুল উত্তর সমৃদ্ধি ডেকে আনবে— এই জাতীয় ঐন্দ্রজালিক বিশ্বাসই ধাঁধার জন্মের পশ্চাতে ক্রিয়াশীল। সেক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক বস্তুজীবনের তথ্যসঞ্চয়ের উদ্দেশ্য গৌণ। লোকমানসের সাধারণজ্ঞান পরীক্ষার একটুখানি ইশারায় যেন প্রজন্ম পরম্পরা ধরা পড়ে। লোকসংস্কৃতির কোষ গ্রন্থ Standard Dictionary of Folklore Mythology and Legend বা SDFML-এ বিজ্ঞানী পটার সাহেব বলেছেন- "Riddle is the lore of learning or common sense or mother wit of the poeple as passed down from parent or grandparent to child or grand child, and that folk knowledge must be packaged and capsulated for easier transmission down hrough the generations."

লোকজ্ঞানের বুদ্ধ্যঙ্ক পরীক্ষার নিরিখেই ধাঁধায় এসেছেন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বরা : ধর্মপ্রচারক থেকে ইতিহাসখ্যাত সম্রাটগণ, কিংবা সমাজসেবক থেকে সাহসী বিপ্লবীর দল। কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরি। বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক বুদ্ধদেব। তিনি কপিলাবস্তুর রাজপুত্র, খ্রিস্টজন্মের ৫৫৬ বছর পূর্বে (আনুমানিক) তাঁর শুভ আবির্ভাব। লোকমন ধাঁধায় ধরে রেখেছে তাঁর ধর্মের মূলমন্ত্র আর ত্যাগের চেতনাটিকে—

অহিংসা পরম ধর্ম কে প্রচার করে?
রাজঐশ্বর্য যেবা হেলায় ত্যাগ করে।

খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তক যীশুও এসেছেন তাঁর অলৌকিক সহাশক্তি আর উদার ক্ষমাপরায়ণতা

নিয়ে-

হাতে পেরেক পায়ে পেরেক গেঁথে যখন দিল।
ঈশ্বরকে বলে এদের ক্ষমা করো ভাল।।

এসেছেন মহান মুঘলসম্রাট আকবর—

নামটি চারি বর্ণে হন এক রাজা।
ধন্য তিনি, পুণ্য রাজ্য সুখে থাকে যত প্রজা। 
প্রথমাংশে এক রসাল গাছ, মানুষ সেই গাছের রস খায়। 
শেষের অংশ সেজেগুজে বিয়ে করতে যায়।

লক্ষণীয়, এখানে আকবরের মহত্ত্ব, বীরত্ব, উদার ধর্মনীতি কিছুই ধরা পড়েনি। শব্দকৌশলের মারপ্যাচে 'আকবর' নামটি নিয়েই প্রশ্নকর্তা লঘু তরল চাপলো বক্তব্য রেখেছেন। ঠিক এমনটাই ঘটেছে ঔরঙ্গজেবের ক্ষেত্রেও-

শিরে তার ডাক দেয় উদরতে রং
চরণে পকেট তার হেরিবে বরং
ইতিহাসে তার নাম পাইবে নিশ্চয়।
মোগলের শাহ তিনি নাহিক সংশয়।

প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতাবান রাজন্যবর্গের সঙ্গে সাধারণ প্রজার সচেতন দূরত্ব এই ধরনের উদাসীনতার জন্ম দিয়েছে। প্রয়োজনীয় ইতিহাস-নিষ্ঠা থেকে সরে এসেছে লোকমন। ঐতিহাসিক জ্ঞানের অভাব নয়, লোকসমাজের অসম স্তরবিন্যাস, আর্থিক অসাম্যজনিত ব্যবধান ইত্যাদি সমস্যাগুলিই যেন প্রকট হয়েছে ধাঁধার মাধ্যমে। অবশ্য বৈষ্ণবকবির ভণিতার মতোই সাংস্কৃতিক কোন কোন মনীষাকে স্বীকৃতি দিয়েছে লোকমন

নেই তাই খাচ্ছ, থাকলে কোথা পেতে।
কহেন কবি কালিদাস পথে যেতে যেতে।

কালিদাস জগদ্বিখ্যাত কবি— এই চেতনাটুকু প্রজন্ম পরম্পরায় বাঁধা পড়ে গেছে বাঁধাকার হিসেবে এই পরিচিতির মধ্য দিয়ে। ধাঁধা মূলত পরীক্ষক, জ্ঞান-বিতরণকারী শিক্ষকের ভূমিকায় সে সফল। তাই লোকমনের

গ্রহণযোগ্যতার দিকে লক্ষ রেখেই তার পরিবেশনা। এইভাবেই জাতীয় চেতনার প্রকাশ হয় অশোক স্তম্ভকে ঘিরে

কোন রাজার নামে স্তম্ভ হয়েছিল? 
ভারতরাষ্ট্রের প্রতীক তাই হয়ে গেল।

অবশ্য বিদ্যাসাগর বা ক্ষুদিরামের প্রতি ধাধাকারের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই আপনজনের স্নেহমাখানো-

বালবিধবার বিয়ে দিলেন যিনি।
দয়ার সাগর রূপে পরিচিত তিনি।

বিপ্লবী ক্ষুদিরামের আন্দোলন নিয়ে লোককবি গান বেঁধেছেন— একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি। ইংরেজ কিংসফোর্ডকে মারতে গিয়ে ভুলক্রমে অন্য গাড়িতে বোমা নিক্ষেপ করে কিশোর ক্ষুদিরাম, প্রাণ যায় দুই নিরীহ ইংরাজ ললনার, বিচারে ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়।

বোমা ছুঁড়ে ছিল কে দেখে ঘোড়াগাড়ি।
ফিরিঙ্গি মনে করে মারলো দুই নারী?

উদাহরণ আর না বাড়িয়ে এটুকু বলি, ধাঁধাগুলির ঐতিহাসিক অনুসন্ধিৎসা গাঢ় গভীর নয়। এরা পল্লবগ্রাহী। তবে দেশ এবং বহির্দেশের কিছু কিছু পরিস্থিতি সম্পর্কে যে এরা ওয়াকিবহাল তা বোঝা যায়।

এমনটি কিন্তু ঘটেনি প্রবাদের ক্ষেত্রে। প্রবাদ লোকসাহিত্যের অপর এক সমৃদ্ধ শাখা, দীর্ঘ জীবনাভিজ্ঞতার সংক্ষিপ্ত বাক্‌নির্মিতি। এই অভিজ্ঞ পর্যবেক্ষকের আছে অসাধারণ চলৎশক্তি, কঠোর বিশ্লেষণী প্রকাশ, নির্মম নিরপেক্ষতা। তাই প্রবাদের আয়নায় ধরা পড়েছে একটি জাতির সামগ্রিক রসচৈতন্য তার আচার-বিচার, বিশ্বাস-সংস্কার, বিধিনিষেধ, সর্বোপরি ঐতিহাসিক ঘটনাবলী সম্পর্কে সংরক্ষকের বিশ্বস্ত দায়বদ্ধতা। প্রবাদ জানতে চায় সাংবাদিকসুলভ দায়িত্বে, স্থান-কাল-পাত্রের বিশেষ বিবৃতিগুলি। আর এই তথ্যজ্ঞাপনের সূত্রেই অতীত ইতিহাসের কিছু ফলক আমরা পেয়ে যাই। কয়েকটি উদাহরণের সূত্রে বক্তব্য স্পষ্ট করি। প্রবাদের খবর-

ধনীর মধ্যে অগ্রগণ্য রামদুলাল সরকার।
বাবুর মধ্যে অগ্রগণ্য প্রাণকৃষ্ণ হালদার ।

বাঙালির স্বাধীন শিল্পোদ্যোগের ক্ষেত্রে রামদুলাল সরকারের নাম উল্লেখযোগ্য। কোষ গ্রন্থে পাই ‘রামদুলাল সরকার বিখ্যাত ধনী, জন্ম ১৭৫২ খ্রীষ্টাব্দ। অতি হীন অবস্থা হইতে আপন বৃদ্ধি ও অধ্যবসায় বলে বিশাল সম্পদের অধিকারী হন। ইহাকে বাঙ্গালার রথচাইল্ড আখ্যা দেওয়া হয়। কথিত আছে ১৮২৪ খ্রীস্টাব্দে মৃত্যুকালে এক কোটি তেইশ লক্ষ টাকার সম্পত্তি রাশিয়া যান। বেলগাছিয়ায় ইহার স্থাপিত অতিথিশালায় প্রত্যহ সহস্র লোকে আহার পাইত। দেখা যাচ্ছে ভূ-সম্পত্তির খাতিরে নয়, দানশীলতার সুত্রেই ধনী ব্যক্তিটিকে প্রবাদ সম্মান অর্জন করেছে।

প্রাণকৃষ্ণ হালদার ছিলেন সেকালের কোলকাতার বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। ধনগর্বীবাবু সম্প্রদায়ের অন্যতম ধারক এই ব্যক্তির বিলাসিতা, আড়ম্বরপ্রিয়তা ছাড়াও পরোপকারের খ্যাতি নজির সৃষ্টি করেছিল। এ প্রসঙ্গে 'সমাচার দর্পণ' (১৮২৫) জানাচ্ছে সং প্রতি মোকাম চা শহরের মধ্যে শ্রীযুতবাবু প্রাণকৃষ্ণ হালদার মহাশয়ের বাটিতে দুর্গোৎসব অতিবাহুলারূপে হইয়াছিল তাহা শৃঙ্খলা এবং ব্যয় দেখিয়া সকলের চমৎকার বোধ হইয়াছে স্বর্ণ ও রৌপ্যনির্মিত থাল গাড়ুঘাট বাটি ইত্যাদি সামগ্রী প্রস্তুত হইয়াছিল।

প্রাণকৃষ্ণ হালদারের দয়ালু পরোপকারী কর্মনীতিরও পরিচয় দিয়েছে ঐ সংবাদপত্রই।

সমাচার দর্পণ, ২০শে অক্টোবর, ১৮২৭ সালে প্রকাশিত সংবাদ : চুঁচুড়া নিবাসী দ্বিজমিষ্টভাবি

শ্রীযুত বাবু প্রাণকৃষ্ণ হালদার মহাশয় বহুত্তর ধন বায়পূর্বক নানা রোগের ঔষধ প্রস্তুত করিয়া

দীন দরিদ্র রোগিদিগকে ঐ ভেষজ দ্বারা আরোগ্য করিয়া দিতেছেন ... সৎকর্মের ধর্ম এই সংবাদ শুনিয়া কে না ধন্যবাদ করিবেন। সমাজসেবক প্রাণকৃষ্ণ শ্রদ্ধার্ঘ্য আদায় করে নিয়েছেন লোকপ্রবাদে। দাপটের সঙ্গে জীবনযাপন

করেছেন যে সকল ব্যক্তিত্ব প্রবাদ তাঁদের স্তাবক-

মোষের শিঙ ভেড়ার শিঙ তারে কি বলে শিঙ্
সিংয়ের মধ্যে ছিল এক গঙ্গাগোবিন্দ সিং।

এই গঙ্গাগোবিন্দ হলেন কান্দির রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ, ওয়ারেন হেস্টিংসের প্রিয়পাত্র। কোষগ্রন্থে পাই—

ইনি হেষ্টিংসের কৃপায় নানাভাবে ধন উপার্জনে সমর্থ হন। কথিত আছে যে ইনি আপনার মাতৃশ্রাদ্ধে বিশ লক্ষ টাকা ব্যয় করিয়া ছিলেন।... ফরাসী ভাষা ও রাজত্ব সম্বন্ধীয় হিসাবপত্রে বিশেষ পটু গঙ্গাগোবিন্দকে ওয়ারেন হেস্টিংস তাঁহার দেওয়ান পদে নিযুক্ত করেন। পৌত্র লালাবাবুর অন্নপ্রাশনে স্বর্ণপাত্রে খোদিত লিপি দ্বারা ব্রাহ্মণগণকে নিমন্ত্রণ করা হইয়াছিল। ইহার মোট দানের পরিমাণ হবে প্রায় নব্বই লক্ষ টাকা। বেশ কিছু ব্রাহ্মণ পণ্ডিত গঙ্গাগোবিন্দ প্রদত্ত বৃত্তিলাভের অধিকারী ছিলেন। কলকাতার পাইপপাড়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা গঙ্গাগোবিন্দ ১৭৯৩ খ্রীষ্টাব্দে পরলোকগমন করেন। নামকরা এই ব্যক্তিত্ব সমকাল ছাড়িয়ে প্রবাদে চিরস্থায়িত্ব পেয়ে গেছেন। উদ্যমী কর্মবীর কেদার রায়কেও স্মরণে রেখেছে প্রবাদ-

রেতের ঠাকুর কেদার রায়
রেতে আসে রেতে যায়

এই কেনার সম্বন্ধে হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, তাঁর গৌড়বঙ্গ সংস্কৃতি গ্রন্থে বলেছেন- 'এই কেদার রায়ের নিবাস ছিল সিউড়ি মহাম্মদাবাদের নিকটবর্তী আঙ্গারগড় গ্রামে। ইনি মুর্শিদাবাদ নবাব সরকারে চাকরি করিতেন দিবাভাগে নবাব দরবারে কার্য করিয়া রজনী যোগে অশ্বারোহণে বাটিতে প্রত্যাবর্তন করিতেন এবং রাস্তার কার্যাদি পরিদর্শন ও মজুর বিদায় করিয়া প্রাতে পুনরায় মুর্শিদাবাদ যাত্রা করিতেন। তাই জনসাধারণ তাঁহার পরিচয় দিয়াছেন রেতের ঠাকুর। সমাজমানসিকতায় যাঁরা প্রলয়ের ওলট-পালট ঘটান তারাও ঠাঁই পেয়ে যান প্রবাসে।

সেইরকমই একটি স্বীকৃত-

রঘু চৈতা বলা/এ তিন কলির চেলা

যথাক্রমে তিনজন ব্যক্তিত্বের নাম উল্লিখিত। উদ্ধৃত প্রবাদে প্রথম রঘুনাথ শিরোমণি। খ্রিস্টিয় পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে নবদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন। রঘুনাথ ন্যায়শাস্ত্রের তর্কে প্রসিদ্ধ পণ্ডিত পক্ষধর মিশ্রকে পরাজিত করে শিরোমণি' উপাধি লাভ করেন। স্বয়ং নবদ্বীপে টোল শুরু করে ঘোষণা করেন যে, উপাধিলাভের জন্য বঙ্গবাসীকে আর মিথিলায় যেতে হবে না। নবদ্বীপে রঘুনাথ শুরু করেন নব্য ন্যায়শাস্ত্রের অধ্যাপনা। তাঁর শিক্ষাদানের প্রভাবে মীমাংসানুগত যাগযজ্ঞাদি ও অন্যান্য ধর্মীর আচার-অনুষ্ঠানাদি উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। তাই সনাতন হিন্দুধর্মের রক্ষণশীল সমর্থকেরা রঘুনাথকে খুব সুনজরে দেখেন নি। প্রবাদটিতে ধরা পড়েছে সেই কটাক্ষ।

চৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩) গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের প্রবর্তক। আদ্বিজ চণ্ডালকে বিতরণ করেছেন প্রেমধর্ম। ঘোষণা করেন 'হরে নমৈব কেবলম্‌ ' নামেই মুক্তি। নানা জটিল আচার- অনুষ্ঠান অর্থহীন। গোঁড়া হিন্দুদের কাছে এই ঘোষণা বিধর্মের সামিল। সেই অপ্রীতিকর দৃষ্টিভঙ্গিই নিক্ষিপ্ত হয়েছে প্রবাদে।

সবশেষে এলেন 'বলা' অর্থাৎ বল্লাল সেন। আনুমানিক ১১৫৮ খ্রিস্টাব্দে সেন বংশীয় রাজা বিজয় সেনের মৃত্যুর পর পুত্র বল্লাল সেন সিংহাসনে বসেন। বঙ্গীয় ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য এবং কায়স্থদের মধ্যে কৌলিন্য প্রথার সৃষ্টি করেন। দানসাগর ও অদ্ভুতসাগর নামে দুটি সংস্কৃত গ্রন্থের রচয়িতা বল্লালসেন নিজের রাজ্যকে রাঢ়, বরেন্দ্র, বাগড়ী বঙ্গ ও মিথিলা- এই পাঁচটি ভাগে ভাগ করেন কিন্তু প্রবাদে তার প্রবর্তিত নতুন সমাজ-নীতির প্রতিই কটাক্ষ করা হয়েছে। অর্থাৎ কলিযুগে সনাতনসমাজ ধর্ম বিনষ্টির মূলে এই বল্লাল সেন- এমনটিই প্রতিপাদ্য।

অনুরূপভাবেই মহান দানশীলতার সূত্রে প্রবাদপ্রতিম পুরুষ হয়েছেন গৌরী সেন ——

লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন

গৌরী সেন আনুমানিক তিনশ বছর আগে হুগলির বালি নামক স্থানে সুবর্ণবণিক কূলে জন্মগ্রহণ করেন। অপরিমিত ধনের অধিকারী, সৎ, সদাশয় গৌরীসেন জাতি ধর্ম নির্বিশেষে পীয়গ্রস্ত ব্যক্তিদের সাহায্য করেছেন মুক্তহস্তে। তাঁর এই বদান্যতাই ধরা পড়েছে প্রবাদে।

দৃষ্টান্ত আর বাড়ানো নিরর্থক। এটুকু বোঝাই যায় সর্বত্রগামী দৃষ্টির প্রভাবে প্রবাদ বিশিষ্ট সমাজসদস্যদের কীর্তিকাহিনী পর্যবেক্ষণ করেছে নিষ্ঠার সঙ্গে। নিজস্ব মন্তব্য সংযোজনায় ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের সম্পর্কে শ্রোতার কৌতূহল বাড়িয়েছে।

লোকসাহিত্যের অপর এক শাখা লোককথা। লোককথার সঙ্গে ঐতিহাসিক নিদর্শনের প্রত্যক্ষ সংযোগ ঘটেছে দু'ভাবে। গল্পের কথক গল্পের আদি ডৌলটি বজায় রেখে সমসাময়িক বাস্তবতার নির্দিষ্ট উপকরণ অর্থাৎ ব্যক্তি, স্থান বা বস্তু কাহিনীর সঙ্গে যুক্ত করেন। অপরদিকে বিশিষ্ট কোন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব স্থান বা ঘটনা অবলম্বনেও রচিত হয় বিচিত্র জনশ্রুতি।

লোককথায় বারবার যে নদীটি তার বহতা স্রোত নিয়ে উপস্থিত সেটি গঙ্গা। রাক্ষসদের রাজ্য হিসেবে বারংবার উল্লেখ করা হয়েছে লঙ্কাদ্বীপের নাম। আবার দুর্দান্ত যে সকল দস্যুর আক্রমণে লোকজীবনের শান্তি বিঘ্নিত হয়েছে, তারা বারবার এসেছে লোককথায়। এরা হল ঠগী, কাসুড়ে, হার্মাদ ডাকাতের দল। নদী রাজ্য এবং ব্যক্তি— সকলেই বাস্তব অস্তিত্ব সম্পন্ন। ইতিহাসখ্যাত যে ব্যক্তিটিকে ঘিরে নানা গল্প গড়ে উঠেছে তিনি হলেন বিক্রমাদিত্য। লোককথায় ইনি কেবল সুশাসকই নন, অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হিসেবেই চিহ্নিত। William Mccullock যে-সব গল্প সংগ্রহ করেছেন তাদের একটিতে বলা হয়েছে Before his birth Vikramaditya was declared by Siva to be distinctive to hold supremacy over all Rakshasas, Yakshas Vital."

এই নৃপতি সম্পর্কে কোষগ্রন্থে বলা হয়েছে— 'চন্দ্রগুপ্ত ২য় (৩৭৬/৮০-৪১৫) প্র চন্দ্রগুপ্তের পৌত্র ও গুপ্ত সম্রাট সমুদ্রগুপ্তের পুত্র মহারাজাধিরাজ চন্দ্রগুপ্ত ৩৭৬ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি বিক্রমাদিত্য উপাধি ধারণ করিয়াছিলেন। কাহিয়েনের বিবরণ প্রমাণ করে যে তিনি সুশাসক ও প্রজাবৎসল ছিলেন।”

অপরদিকে বত্রিশ সিংহাসন, বেতালপঞ্চবিংশতি ইত্যাদি গ্রন্থগুলি সংস্কৃতে রচিত হলেও বিপুল সংখ্যক বাঙালির চিত্ত জয় করেছিল; সে তথ্যটি জানিয়েছেন ড. আশরাফ সিদ্দিষ্ট “সংস্কৃত বেতাল পঞ্চবিংশতির বিক্রমাদিত্যকে এ ধরনের নায়ক বলা যেতে পারে। একটি মাত্র বীর অসীম সাহসী চরিত্র নানারূপ অসাধ্য সাধন করে লোকচিত্ত জয় করে ধারে। লোকমুখে বিপুল বিস্তৃতির মাধ্যমে এই রোমাঞ্চকর চরিত্রটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরা Local Legend'-এর জন্ম দেয়।”

অর্থাৎ একদিকে বেতাল পঞ্চবিংশতির জনপ্রিয়তা ও অপরদিকে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সুশাসন, লোকমানসে এক দেবোপম বিক্রমাদিত্যকে সৃষ্টি করেছে, যিনি বীরত্ব ত্যাগ ও সাহসিকতার স্মারক।

কখনো আবার ঐতিহাসিক চরিত্রের নাম সম্পৃক্ত নানা দিঘি, জলাশয়, বিভিন্ন কাহিনীর জন্ম দিয়েছে। যেমন পালরাজা দ্বিতীয় বিগ্রহপালের পুত্র মহীপাল (৯৭৮-১০৩০)। তার রাজত্ব বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্ত থেকে পশ্চিমে বারাণসী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। নানা লোকহিতকর কর্মে আত্মনিয়োগ করেন মহীপাল। এই মহীপালকে সম্মান জানিয়ে বঙ্গপুরের সন্নিহিত দিনাজপুর স্থানে অবস্থিত দিঘিটির নামকরণ হয়েছে 'মহীপালের দিঘি'।

আবার ‘সিলেট' নামকরণের মূলে আছে একটি কাহিনী— হজরত শাহ জালালই সিলেটের নামকরণ করেছেন। শ্রীহট্টের রাজা গৌড়গোবিন্দ সুরমা নদীর খেয়া তুলে মূল ভূখণ্ডের চারদিকে এক পাথরের প্রাচীর খাড়া করলেন। পীর শাহজালাল প্রাচীরের কাছে গিয়ে উচ্চবোলে হাঁক দিলেন—শিলইট অর্থাৎ পাথর হটে যাও। অনেকে মনে করেন এই শিল্‌ট থেকেই শ্রীহট্টের নবনামকরণ সিলেট।

এই জনশ্রুতি অবশ্যই মুসলমান পীরের মাহাত্ম্যকীর্তন করেছে। শাহজালাল যে শ্রীহট্ট অধিকার করেন তা ইতিহাস সমর্থিত। ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার বলেছেন, “Mr Stapleton is right in fixing the date of the first invasion of Syllet by Muslem armies in 703 A. H (1703 A.D) led by Shah Jalal." [History of Bengal]

অর্থাৎ সিলেটে ইসলাম-বিজয় ঘটনাটিকেই পীর শাহজালালের অলৌকিক মহিমা প্রদর্শনের নিদর্শন হিসেবে প্রচার করে মুসলমান ধর্মের প্রতি ঐকান্তিক নিষ্ঠাই প্রদর্শিত হয়েছে।

বহু অসম্পূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনার সুষ্ঠু পরিণতি রচনা করে লোককথা। যেমন চুয়াড় বিদ্রোহের অন্যতম নেত্রী কর্ণাগড়ের রানি শিরোমণি সম্পর্কে লোকমন নিজস্ব সিদ্ধান্ত আরোপ করেছে। মেদিনীপুর জেলার কর্ণাগড়ে প্রায় ৫৬ বছর (১৭৫৬-১৮১২) রাজত্ব করেন রানি শিরোমণি ব্রিটিশ শাসকদের সঙ্গে ক্রমাগত বিরোধিতা চলতেই থাকে তাঁর। বিনয় ঘোষ, তাঁর পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি নামক গবেষণা গ্রন্থে বলেছেন-

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে ও ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমে উত্তর মেদিনীপুরে ব্যাপকভাবে চুয়াড় বিদ্রোহ হয়। ঘাটশীলার রাজা, মেদিনীপুরের কর্নাগড়ের রানী শিরোমণি বগড়ীর রাজা সকলেই বিদ্রোহীদের সঙ্গে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। ... দীর্ঘদিন ধরে গেরিলা যুদ্ধের আদর্শে বিদ্রোহ চালিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে নানাবিধ কৌশলে লড়াই করে বিদ্রোহীরা পরাজিত হয়। দলপতি গোবর্তা দিপাতি রাজবাড়ী দখল করেন। রানী নাড়াজোলের রাজা ত্রিলোচন খানের আশ্রয় নেন। কিন্তু লোকইতিহাস এই অবমাননাকর পরিণতিকে স্বীকার করে নি। তাদের মতে ইংরেজ চাটুকার গোবর্ধনের বিশ্বাসঘাতকতায় হার স্বীকার হয়েছে। কিন্তু রানী সসম্মানে অঙ্গীভূত হয়েছেন ভগবতী মহামায়ার বিগ্রহমূর্তিতে। এই মন্দির কর্ণগড়ের দক্ষিণে অবস্থিত। অর্থাৎ গুপ্তপথে জঙ্গলমহালের মধ্য দিয়ে এসে ঈশ্বরীমূর্তিতে বিলীন হওয়ার ঘটনার লোকমনের স্বস্তিই উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।"

দেখছি যে মানবজীবন সত্য সততা বীরত্ব ইত্যাদি যে যে ঘটনায় আহত হয়, সেইসব ইতিবৃত্তকেই বেদনাভারের মতো বহন করে লোককথা। তার নবনিরীক্ষায় অশুভের পরাজয় ঘটে, সত্যনিষ্ঠ মানবজীবনই উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে লোকবিদ G. K. Gomme যথার্থই বলেন – Folklore is governed by its own laws and rules which are not the aws and rules of history."

লোকমন তাদের নিজস্ব ব্যাখ্যাকে সত্যের পাথুরে জমিতে প্রতিষ্ঠা করে এইসব লোকগল্পের মধ্যে দিয়েই, হয়তো ঐতিহাসিক সত্য এতে কুণ্ঠিত হয়েছে কিছু ক্ষেত্রে, কিন্তু প্রতিপাদ্য মহান আদর্শের পরিচয়বাহী। যেমন স্বজাতি প্রীতি। দেশপ্রেমের অমোঘ টানকে প্রতিষ্ঠিত করেছে লোককথা। নির্বাচন করেছে ইংরাজস্তাবক কৃষ্ণচন্দ্রকে। শ্রদ্ধেয় কুমুদনাথ মল্লিক, নদীয়৷ কাহিনী-তে বলেছেন : “কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন নবাব অনুগৃহীত। এবং তাহারই অনুকম্পায় ও পরামর্শে ১৭৫৭ খ্রীস্টাব্দের ২৩শে জুন পলাশীক্ষেত্রে ইংরেজগণ এদেশ অধিকার করে। তাহার কৃত উপকারের নিদর্শন স্বরূপ ইংরাজ তাঁহাকে দিল্লী হইতে রাজেন্দ্র বাহাদুর উপাধি ও পলাশীক্ষেত্রে ব্যবহৃত দ্বাদশটি কামান উপহার দেন।”

কিন্তু জনগোষ্ঠী মানতে পারে নি কৃষ্ণচন্দ্রের এই ইংরাজতোষণ যা দেশদ্রোহিতার নামান্তর। সেই কারণে বিদ্রুপ ব্যক্ত হয়েছে লোককথায় কৃষ্ণচন্দ্রের কনিষ্ঠা মহিষীর সংলাপে। কৃষ্ণচন্দ্ৰ যখন গর্বভরে বলেন, 'দেখ আমাকে বিবাহ করিয়া তুমি রূপার খাটে শয়ন করিলে।' তখন রাজমহিষীর তেজস্বী উত্তর ; আর একটু উত্তর যাইলে সোনার খাটে শয়ন করিতে পারিতাম' (দ্রষ্টব্য নদীয়া কাহিনী)। একটু উত্তর, অর্থাৎ আরও একটু হীনতা স্বীকার করে মুর্শিদাবাদের নবাবের সঙ্গে বিবাহ হলে কিংবা ইংরাজ তোষণ করলে তো অঢেল সম্পদের অধিকারী হওয়াই যায় এই ব্যঙ্গ দৃপ্ত পরাধীন লোকমনের গ্লানিকেই প্রকট করেছে।

এইভাবে সত্যের সামান্য রেণুর ওপর গড়ে ওঠে— 'ইতিহাসচেতনা'। লোকমানস নিজস্ব সাংস্কৃতিক মূল্যবোধগুলিকে অনায়াসে ঐতিহাসিক ব্যক্তি অথবা নিদর্শনে আরোপ করে বিশ্বাসের নজির উপস্থিত করতে চায়। সেই কারণেই কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির কীর্তি যখন বর্ণিত হয় তারে অবলম্বন করে সমগ্র জাতিরই মানসস্তরে উপনীত হয় শ্রোতা।

লোকসাহিত্যের আরো একটি শাখার কথা না বললে আলোচনা অসম্পূর্ণ থাকে। সেটি গীতিকা, কাহিনী-নির্ভর লোকগীতি। এ কাহিনী কখনো প্রেমের, কখনো ত্যাগের, কখনো প্রতিশোধ প্রতিহিংসার কখনো অপার মহত্ত্বের। বিভিন্ন ইতিহাসনির্ভর ঘটনা নিয়ে লোককবি রচনা করেছেন গাথাগুলি, ব্যক্তি চলে গেছেন আড়ালে। সমষ্টির মনন, মতামত সিদ্ধান্ত ঐতিহাসিক ঘটনাগুলিতে নতুন মাত্রা এনে দিয়েছে।

ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দামোদরের প্রবল বন্যা, ইতিহাস প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। বাংলা ১২৩০ সালে ঘটেছিল এই ভয়াল প্লাবন।

বারশ ত্রিশ শালে, বরষা কালে ভাঙ্গলো দামোদর

এই গাথাটি প্রবাসী পত্রিকায় ১৩২০ সালের আশ্বিন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। পল্লীকবি সাংবাদিক সুলভ নিরপেক্ষতায় দামোদর নদের ধ্বংসলীলার একটি পূর্ণায়ত বিবরণ দিয়েছেন :

নদী সে দামোদরে, বড়াকরে করছে আনাগোনা।
দুধার মিশায়ে ভাঙ্গে শেরগড় পরগণা।
এল বান পঞ্চকোটে
এল বান পঞ্চ কোটে নিলেক ছুটে, ভাঙ্গলো রাজার গড়
_________________
বাজারে নৌকা চলে
বাজারে নৌকা চলে কুতূহলে প্রলয় দেখি বান
যে যেখানে আছে পলায় ছাড়ি বর্ধমান।

চলচ্চিত্রের মতো সারি সারি ছবির পর ছবি ভেসে যাচ্ছে বর্ণনায় আর সুদূর অতীতে খেয়ে আসা দামোদর তার ভয়ঙ্কর জলোচ্ছ্বাস নিয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে পাঠকের মনে।

প্রকৃতির বিদ্রোহের মতো মানববিদ্রোহের গাথা, সাঁওতাল বিপ্লবের গান গৌরীপুর মিত্রের বীরভূমের ইতিহাস গ্রন্থে বর্ণিত হয়। সাঁওতালদের একতা ধনিকসম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সংঘবদ আক্রমণ অর্থাৎ ১৮৫৫ সালে ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক বিদ্রোহ রূপ পেয়েছে গীতিকায়। এই বিপ্লব বিধ্বংসী, সমগ্র বীরভূমেই তার তাণ্ডবলীলা প্রত্যক্ষ হয়েছিল

ঘরে অগ্নি দিয়ে বেটারা কলো ছারখার।
পোড়াইল ধানের গোলা পোড়াইল ধানের গোলা
তিলজল্যা আদিজত।
গরু মহিষ ছাগল ফেঁড়া পুড়িল কত শত।

বিদ্রোহের দুই নেতা সিধু, কানুর ফাঁসি হয়। কিন্তু কবি বিদ্রোহের পরিণতি সম্পর্কে নীরব, গাথাকার বিদ্রোহের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দিতে ততটা মনোযোগী নন, তাঁর সম্পূর্ণ আগ্রহ শোষিতের পাল্টা প্রতিবাদের স্বরূপ প্রকাশে। প্রকৃতপক্ষে গীতিকাগুলির বিশেষত্বই এই। ইতিহাস-নির্ভর ঘটনার ছোঁয়া থাকে ঠিকই, তবে লোককল্পনা মিশ্রিত ভাবাতিশষ্যে বহুক্ষেত্রেই মূল ইতিহাসকে অতিক্রম করে লোকমনের নিজস্ব সিদ্ধান্তই বলবৎ থাকে।

ড. দীনেশচন্দ্র সেন, চন্দ্রকুমার দে, কবি জসীমুদ্দীন, ক্ষিতীশচন্দ্রা মৌলিক প্রমুখ সংগ্রাহকগণ যে সকল গীতিকা সংগ্রহ করেছেন সেগুলিতে অসংখ্য ঐতিহাসিক চরিত্র অথবা ঘটনা স্থান পেয়েছে। দেওয়ান ঈশা খাঁ, বারভূইয়ার অনত্যম কেদার রায় প্রমুখ প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব যেমন আছেন তেমনি চতুর্দশ শতাব্দীর বিখ্যাত ডাকাত নিজামও জাঁকিয়ে তার অস্তিত্ব জাহির করেছে। গীতিকাগুলির মধ্যে। অবশ্যই গীতিকার নিজস্ব ঢং-এ। তাই দেখি গীতিকায় ইতিহাস-খ্যাত নৃপতি মহীপাল হয়ে উঠেছেন অত্যাচারী নারীহরণকারী, অন্যদিকে দুর্দান্ত দস্যু নিজাম অনুতাপে দক্ষ এক শুদ্ধ আত্মায় পরিণত :

কাঁদিতে কাঁদিতে নেজামকি কাম করিল
ফকিরের পায়ের উপর আসিয়া পড়িল

আবার সমাজের রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে নর্তকীর প্রতি নিজ প্রেমকে স্বীকৃতি দিয়েছে যে রাজচন্দ্র 'রঙ্গমালা সুন্দরী চৌধুরীর লড়াই' পালায় সেও ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব। অর্থাৎ লিখিত ইতিহাসে বিশেষ কীর্তি না রাখলেও গীতিকা তাদের মনে রেখেছে সাহসিক প্রেমের উদ্দীপনার জোরে।

এমনই আর এক গাথা সুজা তনয়ার বিলাপ। রাজমালা গ্রন্থকার কৈলাসচন্দ্র সিংহ বলেছেন 'সুজার পত্নী' পরিবাণুর রূপ ও গুণগাথা একসময় বঙ্গের পল্লীতে পল্লীতে গীত হত। সুজার শেষ জীবন অতি অনিশ্চয়তায় দুর্বিপাকে কাটে, এ তথ্য ঐতিহাসিক। আরাকানরাজ তাঁকে আশ্রয় দেন। ইতিহাস বলে আরাকানরাজের সঙ্গেও তাঁর সু-সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। দুর্ব্যবহার জনিত নানা মতবাদ প্রচলিত। আলোচ্য গীতিকায় একদিকে যেমন অসহায়া বন্দিনী সুজা-কন্যার বিলাপ করুণরস ফুটিয়ে তুলেছে তেমনি অন্যদিকে মগেদের পোশাক, আহার অলঙ্কারাদির মধ্যে দিয়ে সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে বিশ্বস্ত তথ্য পাওয়া যায় :

আমানেরি ফুলরে ছিলাম আমানেরি ফুল।
মধ্যারাজার হাতত পড়ি দিলাম জাতি কুল।
_____________
এক সোনাই রাধেরে ভাত বাড়ী হুদা যায়
বাছনভরা নাকি : পোঁচা গিলা যেনা ধায়।

নিজ ধর্মবিশ্বাসকে কোন ঐতিহাসিক চরিত্রের কীর্তিকলাপের মাধ্যমে দৃঢ় প্রতিষ্ঠাদানের প্রবণতাও গীতিকার দুর্লক্ষ্য নয়। যেমন সোনারায়ের গান, চাঁদ রায় ও তাঁর পুত্র সোনা রায় ঐতিহাসিক চরিত্র। এই সোনা রায়ের সঙ্গে ধর্মপ্রচারক পীরের সংঘাত ও শেষ পর্যন্ত পীরের মাহাত্ম্যকথাই কর্ণনীয়—

অপুত্রার পুত্র হয় রে নির্ধনিয়ার ধন।
অন্ধ ফিরিয়া পায় দুনয়ন।

লক্ষ করার বিষয় এই আশীর্বাণী ব্রতকথার দেব-দেবী মাহাত্ম্য প্রসঙ্গেও উচ্চারিত। অর্থাৎ এখানে ধর্ম সংক্রান্ত সমন্বয়বাদের সুরটিই ধরা পড়েছে, যেটি পূর্ণমাত্রায় ঐতিহাসিক। ‘পীর দরবেশের আস্তানায় জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকলের প্রবেশ অধিকার থাকায় সেগুলি সবার পুণ্যতীর্থে পরিণত হয়। ...এই আস্তানাগুলি বিজিত ও বিজেতার মিলনস্থল। ... সামাজিক চিন্তাধারার ক্ষেত্রে এই উদারতা এক সমান অধিকারের আদর্শই ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান। [ পূর্ব পাকিস্তানে সুফী সাধক : গোলাম সাকলায়েন ]

লোকসাহিত্য এইভাবেই ইতিহাসের উপলখণ্ড সংগ্রহ করে চলে। উল্লেখ্য, প্রত্যক্ষ প্রমাণের পরিপুরণ ব্যতীত লোকসাহিত্যের বক্তব্যকে যথার্থ ঐতিহাসিক সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠানন বিপজ্জনক, এ সতর্কতা ব্যক্ত করেছেন আশুতোষ ভট্টাচার্য — “ইহার মধ্যে এককালের অতীত অতীত যুগের চিত্র যেমন প্রকাশ পাইতে পারে, তেমনি সমসাময়িক কালের নিতান্ত অর্বাচিন চিত্রও প্রকাশ পাইতে পারে, কিন্তু উভয়ই এখানে সমান অস্পষ্ট হইয়া পাশাপাশি অবস্থান করে। অস্পষ্টতাই যাহার ধর্ম, তাহার কোন ঐতিহাসিক দাবি থাকিতে পারে না।” দাবি না থাক, কিন্তু ঐতিহাসিক যুগ ও সমাজ পরিবেশের মৃত্তিকাগন্ধী উপাদান আছে, এই মতটিকেও ড. ভট্টাচার্য অস্বীকার করেন নি। তাঁর মন্তব্য: “উন্নততর সমাজ ও সমৃদ্ধতর সভ্যতার সংস্পর্শে আসিয়া নূতনতর রূপলাভ করিলেও উহার অন্তর্নিহিত পরিচয় অক্ষুণ্ণ থাকিয়া যায়।”

এই অন্তর্নিহিত পরিচয়ের মধ্যেই ধরা থাকে ঐতিহাসিক তথ্যের অবিন্যস্ত, অগ্রন্থিত কাঁচামাল। লোকসাহিত্য যে ইতিহাস ব্যক্ত করে তার সঙ্গে লোকসমাজের প্রাণসত্তার সমীকরণ ঘটে। তাদের যুক্তি, স্মৃতি, কল্পনা ও শৈল্পিক সৃষ্টিক্ষমতাই প্রকাশিত হয়। আর ইতিহাস রচনার একটি পদ্ধতিই হল অস্পষ্ট অতীত থেকে সময়ের সূত্র বেয়ে ধীরে ধীরে বর্তমানের দিকে এগিয়ে আসা, প্রত্ন-সাক্ষ্যের পদচিহ্ন অনুসরণ করে। লোকসাহিত্য সরবরাহ করে চলে সেই সব হারানো অতীতের অজস্র উপাদান। এইভাবেই লোকসাহিত্যও ইতিহাস হয়ে ওঠে পরম্পরাশ্রী সংযোগেই প্রাচীন প্রসঙ্গে বর্তমানের জ্ঞান বিস্তারের অবকাশ ঘটে। Lawrence Gomme যথার্থই বলেছেন—“Combined history and folkliterature can restore much of the picture of early times and can work through the fullness of later time with some degree of success. "

এইভাবেই লোকসাহিত্যের মাধ্যমে অতীত জগতের সুদূর অথচ নিকট পরিচয় মূর্ত হয়ে ওঠে।



প্রাবন্ধিক - অন্তরা মিত্র
প্রবন্ধ সঞ্চয়ন - প্রথম খণ্ড (সত্যবতী গিরি ও সমরেশ মজুমদার সম্পাদিত)

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কলকাতার যীশু কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা বিচার ও সংবাদধর্মীতা

মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্যের নামকরণের সার্থকতা বিচার

ঘোড়সওয়ার কবিতার সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু ও আধুনিকতার লক্ষণ