মধ্যযুগের মন ও মানুষ - নন্দগোপাল সেনগুপ্ত
মধ্যযুগের মন ও মানুষ
উনিশ শতকে ইংরেজশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় আমাদের দেশে যে নূতন শিক্ষাদীক্ষা প্রবর্তিত হয়েছিল, তার ফলে যে নূতন জীবন ও মননধারা আত্মপ্রকাশ করেছিল, তাকে রেনেসাঁস বা নবজাগরণ নাম দিয়েছেন অনেকেই। তা এক ধরনের জাগরণ ঠিকই, কিন্তু ইউরোপীয় রেনেসাঁসের সঙ্গে তার একটি মূলগত পার্থক্য আছে। ইউরোপের মানুষ সামন্তযুগের অশিক্ষা-কুশিক্ষায় যে পুরোনো গ্রিকো-রোমক সংস্কৃতির উত্তরাধিকার হারিয়ে ফেলেছিল, তাকেই নূতন করে আবিষ্কার করেন এবং তা-ই তাঁদের মধ্যে জাগায় বৈজ্ঞানিক সন্ধিৎসা ও ঐতিহাসিক বস্তুবোধ, আর এ-দুটোকে আশ্রয় করেই মানুষ নূতনভাবে তৈরি করে নেন তাঁর সংস্কৃতি—যা আসলে তাঁদের পুরুষানুক্রমিক সংস্কৃতিরই নূতন অনুবৃত্তি।
কিন্তু ভারতবর্ষ উনিশ শতকে যে সংস্কৃতিকে পেল, তা হল বাইরের জিনিস এবং তা বস্তুত ভারতীয় জীবন ও মননের সঙ্গে কোনোরকমেই সম্পর্কিত নয় এবং আধুনিক শিক্ষাপ্রাপ্ত শহুরেদের বাইরে গোটা দেশের অন্তর্লোককে তা স্পর্শও করল না। ফলে সর্বতোভাবে নূতন একটা জীবনচেতনায় মূর্ত হল না তা। দেশের বৃহৎ একটা শ্রেণি রইলেন নিষ্ঠার সঙ্গে পুরোনোকে আঁকড়ে, আরও একটা শ্রেণি সমস্ত পুরোনো মূল্যমান খুইয়ে ঐতিহ্যভ্রষ্ট আধুনিকে রূপান্তরিত হলেন। আর এই দুই শিবিরের যুদ্ধই চলল আবর্তিত হয়ে পুরো এক শতাব্দী ধরে আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও জীবনচর্চার প্রত্যেক ক্ষেত্রে। তাই একদিকে যখন দেখি রামমোহন বিদ্যাসাগর অক্ষয়কুমারকে অন্যদিকে তখনই দেখি রাধাকান্ত রামকৃষ্ণ ভূদেবকে। বঙ্কিম কেশব বিবেকানন্দ চেষ্টা করেছেন দুইয়ের মধ্যে জোড়াতালি দেওয়ার। কিন্তু ফল হয়নি। এই বিরোধের জের চলেছে আজও।
এর তুলনায় আমাদের মধ্যযুগীয় ইতিহাসে যে সমন্বয়মূলক নবজাগৃতির একটি আন্দোলন হয়েছিল, তাকে অনেকের কাছে বেশি নিকটের মনে হবে। অবশ্য আমাদের ধর্ম সমাজ সাহিত্য শিল্পকলা ও জীবনচর্যার বহিরঙ্গকে প্রভাবিত করলেও সত্তার অন্দরকে তাও বিশেষ ছুঁতে পারেনি এবং তা পারেনি বলেই রক্ষণশীলতার যে অনড় অণ্ডাবরণের মধ্যে হিন্দু মানসিকতা হাজার বছর পাক খাচ্ছে, মুসলিম মানসিকতা খাচ্ছে সাত আটশো বছর, তা ভেঙেচুরে একটা একাত্মিক জীবন ও রাষ্ট্রবোধ গড়ে ওঠেনি। তবু স্বীকার করতেই হবে যে জিনিসটা উঠেছিল এই মাটি থেকেই এবং তার বৈজিক উত্তরাধিকার আমরা সবাই অল্পাধিক পেয়েছি। উনিশ শতকের জাগৃতির বেলা এটা হয়নি, তা দেশের চাষি কারিগর ও দেহশ্রমী মানুষদের বরাবরে একেবারেই পৌঁছোয়নি। দুইয়ের মধ্যে এই মৌলিক পার্থক্যটা না বুঝলে, ইউরোপীয় রেনেসাঁসের এবং তার সমসাময়িক মধ্যযুগের ভারতীয় রেনেসাঁসের আসল তাৎপর্যটাই বুঝব না আমরা। সেইজন্যেই বিশদ আলোচনা দরকার বিষয়টির। কারণ এই উপলব্ধির উপরই মধ্যযুগের ধর্ম সমাজ সাহিত্য ও কলাকৃষ্টির সার্বিক উপলব্ধি নির্ভর করছে।
ইউরোপের ইতিহাসে মধ্যযুগের গোড়ার পর্বটা অন্ধকার যুগ বলে অভিহিত হয়েছে। শার্লেমাঁর সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ার পর উত্তর থেকে ভ্যান্ডাল, গথ, ভিসি গথ, নানান বর্বর জাতির মানুষরা এসে পশ্চিমি দেশগুলোকে তছনছ করে দিয়েছে। তারপরে ধীরে ধীরে উঠল ছোটো ছোটো নগররাষ্ট্র এবং চাকরানভোগী সামস্তদের নিয়ে এক এক জন খুদে যোদ্ধা এরাই এক-একটি মুল্লুকে শাসনকর্তা হয়ে বসলেন। কালে তাঁরাই হলেন রাজা। এইসব নগররাষ্ট্রই পরে কিন্তু বর্তমান ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর জন্ম দিয়েছে। এইসব রাষ্ট্রে রাজা, সামন্ত এবং শ্রেষ্ঠী তিনকেই চালাত খ্রিস্টান গির্জা। শিক্ষা সংস্কৃতি ধর্ম সমাজ ও ব্যক্তিক আচার-আচরণ সবই নিয়ন্ত্রিত হত পাদরিদের নির্দেশে, আর তাঁরা ছিলেন বেশির ভাগই নিরক্ষর এবং এঁদের যথাসম্বল ছিল কিছু বাইবেলি বিদ্যার সঙ্গে রকমারি তুকতাক ও ম্যাজিক বা কৃশ্ববিদ্যা।
এই অন্ধকারকে ভেদ করে ফুটল রেনেসাঁস বা নবজাগৃতির আলোক। গ্রিকো- রোমক সংস্কৃতির মধ্যে গুহায়িত ছিল যে জীবনদর্শন, যে বলিষ্ঠ ভাবস্বাতন্ত্র্য ও আত্মপ্রত্যয়, তাকে নতুন করে মানুষ আবিষ্কার করলে খ্রিস্টীয় গির্জার দাপটকে একান্তে সরিয়ে ফেলে। সেই আত্মাবিষ্কার চিত্রকলা, সাহিত্য, বিজ্ঞান—সব দিকেই মূর্ত হয়ে গড়ে তুলল নূতন ইউরোপকে এবং সেই ইউরোপ এশিয়া আফ্রিকা ও আমেরিকা তিন মহাদেশে প্রতিষ্ঠিত করল নিজেকে। রেনেসাঁসের পর রিফর্মেশন বা সংস্কার, তারপর শিল্পবিপ্লব, ফরাসিবিপ্লব, রুশবিপ্লব তাকে ধাপে ধাপে আজকের দরজা পর্যন্ত টেনে এনেছে। এই ইউরোপের ইতিহাসে হানাহানি, জাতিদ্বন্দ্ব, অনাচার ও বেলেল্লামি আছে, আছে দুর্বল ও অনগ্রসরকে শোষণ করে স্ফীত হওয়ার বর্বরতা। সেইসঙ্গেই আবার আছে, মানুষের সামূহিক আত্মপ্রকাশ এবং অগ্রযাত্রার মহত্ত্বও। ইউরোপের সঙ্গে তুলনায় ওইসময়ের ভারতে ইতিহাসের ধারাও মোটামুটি একই। হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর তাঁর বৃহৎ সাম্রাজ্য ভেঙে গেল এবং উদ্ভব হল। ছোটোবড়ো বহু নরপতির। রাজকীয় সমর্থনের অভাবে বৌদ্ধধর্মের ইমারত ধ্বসে পড়ল এবং হিন্দু নাম নিয়ে ক্ষমতাবানেরা নানা বিকট ও বিকৃত পূজাপদ্ধতির পৃষ্ঠপোষকতা করতে লাগলেন। শ-দেড়েক বছরের মধ্যেই উদ্ভব হল কুমারিল ভট্ট ও শংকরাচার্যের এবং তাঁরা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের নূতন ধর্মাদর্শ দিয়ে করলেন জোটবন্দ, আর নিম্নবর্ণের মানুষদের দিলেন সমাজের বাইরে ঠেলে, কপালে অঙ্গুতের মার্কা দাগিয়ে দিয়ে। ১২শ শতকে আগত মুসলিম শাসকরা এই অদ্ভুতদের অসস্তোর ভাঙিয়েই গড়ে তুললেন বৃহৎ এক মুসলমান সমাজকে এবং ভারতবর্ষে নূতন একটি সংস্কৃতির জন্ম হল যার নাম ঐসলামিক সংস্কৃতি। এর পরের ইতিহাসে দেখি একদিকে মুসলিম শাসনের স্বাধিকার প্রমত্ততা, অন্যদিকে হিন্দুর আত্মরক্ষামূলক সংকোচন। দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় বা সমঝোতা হতে পারল না, ইসলামের কাঠামোতে অন্য ধর্মের স্বীকৃতি অনুমোদিত নয় বলে।
তবু ইতিহাস নিষ্ক্রিয় থাকেনি; বাইরে থেকে এসেছিলেন সুফিরা, তাঁদের মধ্যে যে অংশ জ্ঞানবাদী, তারা প্রচার করলেন আনাল হক বা অহংব্রহ্মের তত্ত্ব। যাঁরা ভক্তিবাদী, তাঁরা উদ্ঘাটিত করলেন মধুর ভাবাশ্রিত সাধনপ্রণালী, যা বৈপ্লবীয় রাগমার্গের সাধনার অনুকল্প। বলা নিষ্প্রয়োজন যে হিন্দু-মুসলিম ভাবমিলনেরই একটা প্রয়াস করেছিলেন এঁরা। তা করেছিলেন চিত্তি ও দরবেশ সম্প্রদায় — মারফতিরাও। তাঁরা আত্মা ও মোক্ষের অর্থাৎ হকিক ও তৌহিদের তত্ত্বে বিশ্বাসী এবং নাহুত লাহুত মালকুত ও হাউতে ধাপে ধাপে উন্নীত হওয়াকেই বলেছেন সাধনার লক্ষ্য। এই ধাপগুলি হল যথাক্রমে দেহময় মনোময় ও জ্ঞানময় সত্তারই ঐসলামিক বিকল্প। শাজাহানপুত্র দারা লিখেছিলেন মজমে উল বাহেরিন বা দুই সাগরের মিলন, যাতে উপনিষদ ও কোরান-এর মূল তত্ত্বগুলির মিলন দেখানো হয়েছে এবং প্রেমাত্মক আরাধনার মহিমা বর্ণিত হয়েছে। এই সমন্বয়ের বাণীই প্রচার করেছিলেন রামানন্দ নানক দাদু কবির রজ্জবালি প্রমুখ সম্ভরা। এদের মধ্যে কবির ও রজ্জবালি ছিলেন মুসলমান, কিন্তু উভয়েরই শিষ্যরা ছিলেন হিন্দু-মুসলমান। যেমন নানক ও দানুর ছিল হিন্দুর সঙ্গে মুসলিম শিখাও। যেমন হরিদাস নিয়েছিলেন চৈতন্যের শিষ্যত্ব। এই সম্ভ-সাধকদের প্রভাবে সমাজের নীচুতলায় ধীরে ধীরে একটা একীকরণের
প্রয়াস শুরু হয়েছিল, যদিও মুসলিম রাজশক্তি ছিল সেই প্রয়ামের উপর খড়্গহস্ত। মধ্যযুগের এই সম্ভ-সাধকদের জীবন ও সাধনপ্রণালীও এক ধরনের রেনেসাঁস ঘটিয়েছে। এঁদের সম্বন্ধে বাঙালি পাঠকদের প্রথম অবহিত করেছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন আজ থেকে বহু বছর আগে, তাঁর ভারতীয় মধ্যযুগের সাধনার ধারা বই প্রকাশ করে। বইটি মূল্যবান এবং প্রকৃতপক্ষে এ বিষয়ে আজও এটিই আমাদের প্রধান প্রামাণ্য বই, যদিও মূল বিষয়ের কোনো কোনো বিভাগ নিয়ে ইতিমধ্যে বিশদতর বই বা প্রবন্ধাদি লিখেছেন আরও কেউ কেউ। সেইসব বইপুথির কোনো কোনোটার কথা এই আলোচনায় উল্লেখ করার দরকার হতে পারে। মোটের উপর পাঞ্জাব উত্তরপ্রদেশ রাজস্থান গুজরাট মহারাষ্ট্র জুড়ে গোটা ভারতেই যে সমন্বয় পন্থী সম্ভরা আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাদের জীবন ও সাধনার কথা বইটিতে বলা হয়েছে এবং সংক্ষিপ্ত হলেও আলোচনা তথ্যসমৃদ্ধ এবং সুলিখিত।
একটা কথা মনে রাখতে হবে, সত্ত-সাধকদের মধ্যে কয়েকজন সুপণ্ডিত ও জ্ঞানী পুরুষ থাকলেও বেশির ভাগই ছিলেন নিরক্ষর সাধারণ মানুষ। তাই তারা জ্ঞানগর্ভ তত্ত্বকথাও বলেননি, শাস্ত্রীয় নির্দেশমতো জটিল সাধন-ভজনের পথও দেখাননি। তাঁরা দাস্য বাৎসল্য ও মাধুর্য-আশ্রিত সহজ-সাধনের কথাই বলেছেন এবং সেই সাধনে ধর্মগ্রন্থ ও ধর্মায়তনের প্রাধান্য অস্বীকার করে মানবিক স্বাধিকারকেই বড়ো করে দেখাতে চেয়েছেন। শংকরের অদ্বৈততত্ত্ব সমাজে একটা জ্ঞানমার্গীয় আভিজাত্য সৃষ্টি করেছিল। রামানুজ ও নিম্বার্ক দ্বৈত আরাধনার মাধ্যমে সেই নির্বিশেষ তত্ত্বজ্ঞানকে যুগল আরাধনার পথে এগিয়ে দিয়েছিলেন, আর এই যুগল আরাধনাভিত্তিক ভক্তিতত্ত্বই হল সম্ভপন্থার বীজস্বরূপ এবং লক্ষণীয় যে সারা ভারতেই এর রূপ মোটামুটি এক। এই ঐক্যসূত্রটি ক্ষিতিমোহন সেন ধরে দিতে চেষ্টা করেছেন।
আগেই বলা হয়েছে যে সত্ত-সাধকদের সাধনার ধারা সারা ভারতেই মোটামুটি এক ছিল। কেউ হয়তো রামসীতার, কেউ রাধাকৃষ্ণ বা লছমি-নারায়ণের উদ্দেশে পূজা নিবেদন করতেন। কেউ করতেন আল্লা বা নিরুপাধিক পরমেশ্বরের উদ্দেশে। কিন্তু মূল তত্ত্বটি তাঁদের অভিন্ন ছিল। তা হল সৃষ্টিকর্তার এবং মানবজাতির একত্ব, আর জীবনে সিদ্ধিলাভের উপায় প্রেমভক্তি বিবেক বৈরাগ্য ও সেবার পথ অনুসরণ। বলা নিষ্প্রয়োজন যে এই প্রচারণার মধ্যে প্রভুত্বের বিরুদ্ধে, ভেদাভেদের বিরুদ্ধে যেমন একটি বিদ্রোহের সুর ছিল, তেমনই ছিল সর্বমানুষে একটি সাম্যের সুরও। তাই আউল বাউল দরবেশ ফকির অবধৃত প্রভৃতি নানা নামে এই মতাবলম্বীদের প্রতিষ্ঠা হয়েছে সমাজগণ্ডির বাইরে এবং নানা পথার অনুগামী সংস্থাও তৈরি হয়েছে ভারতবর্ষে এঁদের পৃষ্ঠপোষকতায়। বাংলায় গৌড়ীয়, আসামে মহাপুরুষিয়া, উড়িষ্যায় ভাগবতী, গুজরাটে ভগত, নানা নাম তাঁদের।
আগেই বলেছি এঁদের সাধনভজনের প্রণালী ছিল সহজ সরল। কেউ বিধিবন্ধ কেতাবের মধ্যে আপন প্রত্যয় বেঁধে দেননি। অকপট প্রেম ও আর্তি-সংবলিত গানেই অভিব্যক্ত হয়েছে সকলের অন্তরের কথা। এই সমস্ত গানই ধর্মগ্রন্থসুলভ মর্যাদায় গৃহীত হয়েছে ভক্তদের সমাজে। বাংলায় বৈস্নব মহাজনদের পদ, অসমিয়াতে শংকরদেব ও মাধবদেবের, মারাঠিতে তুকারাম ও নামদেবের, গুজরাটিতে নরসী ভগতের, রাজস্থানিতে মীরার (রানা কুম্ভের পত্নী বলে কিংবদন্তি থাকলেও এবং বৃন্দাবনে সনাতনের সঙ্গে এঁর সাক্ষাৎ হওয়ার গল্প বহুল প্রচারিত হলেও, আসলে ভোজরাজের পত্নী কিংবা বৃন্দাবনের জনৈকা ভক্তিমতী নর্তকী) ভজনাবলি, পাঞ্জাবিতে জপজি গীতিমালা অসীম মর্যাদায় গৃহীত হয়েছে। হয়েছে দক্ষিণি আলোয়ারদের পদাবলি তিরুবন্নুবর অল্পর পত্তিনত্তর প্রমুখের ভজন, যা কবিরের দোঁহা ও তুকার অভঙ্গেরই দক্ষিণি অগ্রজ। দক্ষিণিদের প্রসঙ্গটি বাদে সেন মহাশয় এঁদের অনেকের কথাই বলেছেন এবং বলেছেন পরিপাটি করেই, যদিও কারও রচনার নিদর্শন বা বিস্তৃত বচন উদ্ধৃত হয়নি তাঁর আলোচনায় ।
দক্ষিণি আলোয়ারদের প্রসঙ্গ ও রচনা বাঙালি পাঠককে সংক্ষেপে উপহার দিয়েছেন বহুদিন আগে নলিনীমোহন সান্যাল শাস্ত্রী এবং তাঁর পরে পূর্ণতররূপে দিয়েছেন যতীন্দ্রদাস রামানুজ দাস। আর মীরা ও কবির সম্বন্ধে পূর্ণতর বই লিখেছেন হিন্দিতে অধ্যাপক শ্যামদাস। আলোয়ারদের প্রসঙ্গ সমধিক প্রণিধানযোগ্য এই কারণে যে গৌড়ীয় বৈষ্ণববাদের উদ্ভব তা থেকেই হয়েছে এমনই অনুমান করা হয়। তাঁদের গানে যে আত্মবিস্মৃত আত্মবিসর্জনের সুরটি পাওয়া যায়, বিরহাবেশজনিত দশার যে ছবি তাঁরা এঁকেছেন, সেটাই অনেকের মতে গৌড়ীয়দের রচনায় নবভাবে মূর্তি নিয়েছে। তবে তাঁদের ভাবভুবনে রাধা নেই, আছেন গোদাদেবী বা নাপ্পিনাই। এই শব্দটির অর্থ নাকি আরাধনাকারিণী; জানি না তা থেকেই গৌড়দেশে রাধা নামের উৎপত্তি কি না। যাই হোক দক্ষিণি পণ্ডিতরা এঁদের একটা দার্শনিক অনুক্রমে বাঁধার চেষ্টা করেছেন। বলেছেন এঁরা রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদকে প্রেরণা হিসাবে অনুসরণ করেছেন, যেমন গৌড়ীয় তত্ত্বেরও বিচার করা হয়েছে এবং হয় অচিন্ত্যভেদাভেদের ছকে ফেলে। বস্তুত চৈতন্য নিজে দার্শনিক মনোভাবাপন্ন হলেও এবং অচিন্ত্যভেদাভেদতত্ত্ব তাঁর হাত দিয়ে প্রবর্তিত হলেও, তাঁর দক্ষিণ হস্ত নিত্যানন্দ কিন্তু ছিলেন অবধূত এবং তাঁর পন্থা সম্ভদের মতোই সহজপন্থা ছিল। আর তাঁর (নিত্যানন্দের) ছেলে বীরভদ্রই গৌড়ীয় সংস্থার আদি সংগঠক। নাড়ার শিষ্য ন্যাড়ানেড়ি নামধেয় সহজিয়াদের নাকি তিনিই বৈস্নব গোষ্ঠীভুক্ত করেছিলেন। এইজন্যেই চৈতন্যজীবনীতে নিত্যানন্দের স্থান এত উঁচু। বৈয়ব দুনিয়ায় তিনি সেন্টপল স্বরূপ!
মধ্যযুগের এই মরমিয়া সাধকরা জ্ঞানমার্গ ও ভক্তিমার্গে, উচ্চবর্ণ ও অনুচ্চবর্ণে, হিন্দু ও মুসলমানে একীকরণের যে মন্ত্র প্রচার করেছিলেন, যাকে আমি ভাবগত রেনেসাঁস বলব, তার পর্যাপ্ত ঐতিহাসিক মূল্য আছে এবং সে মূল্য খুঁজতে হবে আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসেই। বলা বাহুল্য সামাজিক স্তরেও এই চিন্তা-সমন্বয় কর্মের মধ্যে দিয়ে সার্থক হলে আমাদের জাতীয়তার গড়নই অন্যরকম হত। ছশো বছরব্যাপী মুসলিম শাসন ও দুশো বছরব্যাপী ইংরেজ শাসনের পর তাহলে কিন্তু এক ভারতবর্ষ তিনটে হত না এবং ভারতের সমাজজীবনে এমন ছুত-অজ্জুতের সীমারেখা টানা থাকত না আজও। অবশ্য তা বলে এই সমন্বয়বাদ ষোলো আনা নিষ্ফল হয়নি। সর্বধর্ম সমবায়ের সুন্দর একটি আদর্শের সঙ্গেই মানবতাবাদের এক উজ্জ্বল অনুপ্রেরণা রূপে তা আমাদের মর্মকে স্পর্শ করেছে। এই সেদিনও রবীন্দ্রনাথ, গান্ধি ও নেহরুর চিন্তারই মধ্যে আমরা এর প্রতিধ্বনি শুনেছি। শুনেছি হাদি হোসেন ও মৌলানা আজাদের কথার মধ্যেও। সেই মহৎ বাণীর আদি স্রষ্টা এবং বাহকদের অনেককেই চোখের সামনে তুলে ধরেছেন ক্ষিতিমোহন সেন তাঁর ছোটো সুন্দর বইয়ে। সংক্ষিপ্ততা, অসম্পূর্ণতা ও দু-একটি তথ্যগত ভ্রান্তি সত্ত্বেও বইটির উপযোগিতা তাই এত বছরেও কমেনি।
বইটি পড়তে পড়তে এই ভেবে অবাক লেগেছে যে যেদিন আধুনিক যানবাহন ছিল না, তীর্থযাত্রী বণিক ও ভ্রাম্যমাণ সাধুর বিরল আনাগোনা ছাড়া ভারতের এক প্রান্তের সঙ্গে অন্য প্রান্তের চেনাজানাও প্রায় ছিল না বললেই চলে, সেদিন সারা ভারতের প্রাণবীণা প্রায় এক সুরে বেজেছিল, সর্বত্র এক ধরনের সাধনভজন চলিত হয়েছিল, একই প্রাণধর্ম সংবলিত গান রচিত হয়েছিল, এই অনুকূল লোকমানস তৈরি হয়েছিল কী করে? শুধু ভারতেই বা বলছি কেন? ইরানি সুফিদের এবং ক্যাথোলিক খ্রিস্টানদের মধ্যেও তো এইরকম মরমিয়া রীতির সাধনা ও সাহিত্যের দেখা পাই। হাফিজ জামি রুমি ও শাবিস্তারির অথবা সেন্ট অগাস্তিন ও সেন্ট তেরেসার রচনাবলির কথা বলছি। রাগাত্মিকা মূর্তিতে মারি মাদলিনের আত্মসমর্পণের অথবা নয় কুমারীর বাসকসজ্জা, প্রতীক্ষা ও বিরহের মধ্যে সুরগত ঐক্য লক্ষ করেই কি ব্রজেন্দ্রনাথ শীল বৈরবধর্মের উৎস হিসাবে খ্রিস্টধর্মের নাম করেছিলেন? তা হোক বা না হোক, বোঝা যাচ্ছে সমগ্র পূর্বাঞ্চলীয় পৃথিবীতেই একদা চলিত ছিল। একটা ভাবিক ঐক্য, যা ভূগোলের ব্যবধানের উপর জয়ী হয়েছিল।