"সংস্কৃত বাংলা ভাষার জননী" - সহজ ব্যাখ্যা

সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে বাংলা ভাষার সম্পর্ক :

যে কোনো ভাষা মাত্রেরই একটা অতীত ঐতিহ্যের অনুসন্ধান করা দুরূহ নয়। প্রায় সহস্র বর্ষের বাংলা ভাষার ইতিহাস বা ঐতিহ্য সূত্র বেশ প্রাচীন। ভাষাতাত্ত্বিকগণ প্রমাণ করেছেন বাংলা ভাষার মূল পৃথিবীর প্রধান ভাষাগোষ্ঠীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভাষাগোষ্ঠী ইন্দো ইউরোপীয়র কাল মোটামুটি ভাবে খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০-২০০০ অব্দ। এই ভাষাগোষ্ঠীর অন্যতম শাখা ইন্দো-ইরানীয় গোষ্ঠী। খ্রিস্টপূর্ব ২০০০-১৫০০ অব্দে ইন্দো-ইরানীয় থেকে ইন্দো বা আর্য শাখা স্বতন্ত্র ভাবে ভারতে (পরবর্তীকালের দেশ') চলে আসে। সিন্ধু নদীর তীরবর্তী সমভূমি অঞ্চলে আর্য ভাষাভাষীরা কখনো সাময়িক ভাবে, পরে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করে। এদের মুখের ভাষা ৬০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ নাগাদ পরিবর্তিত হয়ে যায়।

এদেশে ব্যবহৃত বৈদিক ভাষার পরিবর্তন ঘটার সময় থেকে বিস্তীর্ণ এলাকায় এই জনগোষ্ঠী ছড়িয়ে পড়ে, ক্রমশ ভাষা ও আঞ্চলিক উপভাষিক রূপ নেয়; ভাষার ব্যবহারেই দেখা দেয় বিভিন্ন ধ্বনিগত ও ব্যাকরণগত পরিবর্তন। বস্তুত বৈদিক ভাষায় বিকৃতির উপর ভিত্তি করে তক্ষশিলা অঞ্চলের মনীষী ব্যাকরণবিদ পাণিনি তাঁর ব্যাকরণ "অষ্টাধ্যায়ী (৫০০ খ্রি. পূর্বাব্দ) রচনা করেন। সংস্কারগত বৈদিক ভাষার নাম হয় 'সংস্কৃত'। সংস্কৃত থেকে অঞ্চলভেদে কয়েকটি প্রাকৃত ভাষার জন্ম হয়। বিভিন্ন প্রাকৃত পাল্টে গিয়ে পালি রূপে আত্মপ্রকাশ করে। এরপর পরিবর্তিত স্তরে এগুলো অপভ্রংশ রূপ লাভ করে খ্রিস্টিয় ষষ্ঠ শতাব্দী নাগাদ। অপভ্রংশ ও কথ্য রূপে অবহট্ঠ ভাষাগুলো নব্য ভারতীয় আর্য ভাষা রূপে আত্মপ্রকাশ করে নবম বা দশম শতকে। যাদের অন্যতম "বাংলা ভাষা"। বৈদিক ভাষা ও বিবর্তিত সংস্কৃত ভাষা স্তর প্রাচীন ভারতীয় আর্য, পরবর্তী (প্রাকৃত-পালি > অপভ্রংশ-অবহট্ঠ) মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষা পরিবর্তিত হয়ে নব্য ভারতীয় আর্য ভাষাগুলোর জন্ম দেয়। বাংলা ভাষা মগধ অঞ্চলে জাত মাগধী অপভ্রংশ, কারও কারও মতে অর্ধ মাগধী ও অন্যান্য অপভ্রংশ ভাষার মিশ্রণে জন্ম নেয়। এক কথায়, সংস্কৃত > প্রাকৃত > অপভ্রংশ > বাংলা ভাষার জন্ম। এই সম্পর্ক বা ঐতিহাসিক সূত্রের অনুসরণে বিচার্য বাংলা ভাষার জননী কি সংস্কৃত ভাষা?

সংস্কৃত বাংলা ভাষার জননী কিনা?

উত্তর এক কথায় 'হ্যাঁ' এবং 'না' উভয়ই। বাংলা ভাষার জন্মের উৎস সূত্রে সংস্কৃত জননীত্বের অন্যতম দাবীদার। কিন্তু সংস্কৃতের জঠর থেকে বাংলা ভাষা জন্ম নেয়নি, কালের ব্যবধানে বিবর্তিত স্তর থেকে বাংলা জন্ম নিয়েছে—এ বিষয়ে দ্বিমত নেই।

বস্তুত সংস্কৃতের প্রবহমান ধারা বিবর্তিত হয়ে নানা আধুনিক ভারতীয় ভাষার, যেমন বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে। আর এই সংস্কৃত ভাষা অনভিজাত জনগণের অশিষ্ট কথা সংস্কৃত ভাষা। সাহিত্যে প্রথম দিকে এই কথ্য নয়, প্রায় সংস্কৃতাশ্রয়ী 'সাধু' বা শিষ্ট বা সাহিত্যিক রীতি স্থান পেয়েছে। প্রথমাবস্থায় শুধু সংস্কৃত প্রভাব বা সংস্কৃত থেকে বিবর্তিত শুধু নয়, এদেশীয় দ্রাবিড়-অস্ট্রিক কোল প্রভৃতি ভাষাগোষ্ঠীর শব্দাবলী, ব্যাকরণ ভাবনারও প্রভাব বাংলা ভাষার উপর পড়েছে।

স্বভাবতই সংস্কৃতকে ব্যাপকার্থে বাংলা ভাষাসহ আধুনিক ভারতীয় আর্য ভাষাগুলোর জননী বা জননী স্থানীয় বলা যায়। আর ক্ল্যাসিকাল সংস্কৃত বাংলা ভাষার সহযোগী দুটি ধারা রূপে গ্রহণীয় হবার যোগ্য। কেউ কেউ সংস্কৃতকে 'জোর করে' মৃত ভাষা বলতে চাইলেও বাস্তবত নয়। সংস্কৃতের কথ্য রূপের ব্যাপক বদলে, বিবর্তনে যেমন বাংলা প্রভৃতি নতুন ভাষা জন্ম নিয়েছে, তেমনি দ্বাদশ শতকে রচিত জয়দেবের “গীতগোবিন্দ” প্রভৃতি রচিত হয়েছে এবং “গীতগোবিন্দে”-ও বিবর্তিত সংস্কৃতের ব্যাপক বদলের ইঙ্গিত স্পষ্ট রূপে ধরা পড়ে।

সম্পর্কের প্রশ্নে শেষ কথা এই যে, সংস্কৃত বা লৌকিক সংস্কৃতের সঙ্গে বাংলার সাক্ষাৎ সম্পর্ককে সরাসরি গ্রহণযোগ্য করতে দ্বিধা হয়। সংস্কৃত থেকে প্রাকৃত অপভ্রংশ (খ্রি. পূর্ব ৬০০ খ্রিস্টীয় ৬০০ অব্দ) ভাষার মৌখিক বিবর্তনের মধ্যে দিয়েই বাংলা ভাষা জন্ম নিয়েছে। অন্য দিকে লৌকিক সংস্কৃত কারও কথ্য ভাষা ছিল এমন প্রমাণও মেলে না। বরং ক্ল্যাসিক সংস্কৃত বা বৈদিক সংস্কৃতের বিবর্তিত ধারার সঙ্গে বাংলা ভাষার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অস্বীকার্য নয়। বাংলা ভাষাতে হুবহু সংস্কৃত ও তা থেকে নানা ভাবে বিবর্তিত বা পরিবর্তিত বাংলা শব্দভাণ্ডারের শব্দ বাহুল্য সে প্রমাণ দেয়। তাই একথা অত্যুক্তি নয়—বাংলা ভাষা ও সংস্কৃত ভাষার সম্পর্ক সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন নয়; আবার সংস্কৃত ভাষা থেকেই বাংলা ভাষা প্রত্যক্ষ ভাবে জন্মগ্রহণ করেনি। তবে সংস্কৃত যে বাংলা প্রভৃতি আধুনিক ভারতীয় ভাষাসমূহের মাতৃসম বা মাতৃস্বরূপা, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কলকাতার যীশু কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা বিচার ও সংবাদধর্মীতা

মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্যের নামকরণের সার্থকতা বিচার

ঘোড়সওয়ার কবিতার সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু ও আধুনিকতার লক্ষণ