বাক্যগঠনের তিনটি সূত্র কী কী? সহজ আলোচনা
বাক্য গঠনের নিয়ম বা লক্ষণীয় বিষয় :
বাক্য গঠনে প্রথমেই দুটো বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হয় — (১) বাক্যে যুক্ত পদের ক্রম এবং (২) প্রযুক্ত পদসমূহের মিল বা সঙ্গতি। এছাড়া আরও তিনটি বিষয়ের—যথাক্রমে বাক্যে পদের অবস্থান, ক্রম, পারস্পরিক সঙ্গতি নির্ভর করে। অর্থাৎ বাক্য গঠনের প্রধান তিনটি শর্ত হল- (ক) আকাঙ্ক্ষা, (খ) যোগ্যতা, (গ) আসত্তি।
(ক) আকাঙ্ক্ষা (Expectancy) :
কোনো উক্তি বা বাক্যের উদ্দেশ্য গ্রহণে শ্রোতার আগ্রহ বা আকাঙ্ক্ষা থাকে। এই আকাঙ্ক্ষা যতক্ষণ না মেটে বা যতক্ষণ অর্থপূর্ণ না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত বাক্যে অন্য পদের প্রয়োজন থাকে। বাক্যের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ীই পদের অবস্থান হয়। কোথাও পূর্বে সংশ্লিষ্ট বাক্যের সঙ্গে সঙ্গতি থাকাতে একটি পদেই বাক্যের অর্থ সম্পূর্ণ হয়। তবে সাধারণত শুধু উদ্দেশ্য বা বিধেয় দিয়ে তাদের আংশিক পূর্ণতার মাধ্যমে আকাঙ্ক্ষা সম্পূর্ণ হয় না, অন্য পদেরও প্রয়োজন হয়। যেমন: সে বাড়ি গিয়ে এটুকু বললে অর্থ পূর্ণ হয় না, বা আকাঙ্ক্ষা নিবৃত্ত হয় না। "ঘরে পড়তে বসবে'— বসালেই অর্থ সম্পূর্ণ হয়। আবার 'কর্ণকে বধ করে অর্জুন বক্রাসুরকে বধ করার পর ইন্দ্র যেমন, তেমনি শোভা পেতে লাগলেন'— এই শব্দ সমষ্টি বা পদগুচ্ছে বা বাক্যে কোনো একটি পদ বর্জন করলেই, বাক্যটি সাকা ঙ্ক্ষ হয়ে পড়ে। কাজেই বাক্যস্থিত পদের আবশ্যকতা ও অবস্থানও আকাঙ্ক্ষার উপর নির্ভরশীল।
(খ) যোগ্যতা (Compatibility) :
বাক্যে ব্যবহহৃত শব্দগুলোর অর্থসঙ্গতি আবশ্যিক। অন্যথায় বাক্য গঠন সঙ্গতির অভাবে ত্রুটিপূর্ণ হয়ে যায়, মূর্খের বা পাগলের প্রলাপে পরিণত হয়। তাই বাক্যের পদগুলোর অবশ্যই অর্থগত ও ভাবগত সঙ্গতি থাকা চাই। এরূপ অর্থগত বা ভাবগত বাধার ক্ষেত্রে পদগুলোকে পরস্পরের সঙ্গে সঙ্গত করে বসালেই বাধ্য হবে না। যেমন : জলের উপর হেঁটে যাচ্ছে, রাত্রে রৌদ্র হয় বাক্য দুটো ব্যাকরণ সঙ্গত। কিন্তু অর্থানুসারে বাক্য নয়। অবশ্য বিশেষ উদ্দেশ্যে শ্লেষ বা ব্যঙ্গচ্ছলে এমন অসঙ্গত প্রলাপ বাক্যে ব্যবহৃত হতে পারে। যেমন : রৌদ্রময়ী নিশা। গেরুয়া রঙের সুরে। দিনের সঙ্গীত শেষ হলো ইত্যাদি বাক্য কাব্য-সাহিত্যে ব্যবহার সিদ্ধ। এমনই যোগ্যতার সূত্রে বাংলা বাক্যের ক্রমও সাধারণ ভাবে নির্দিষ্ট হয়। 'শ্যাম লিচু খায়' বাক্যের যোগ্যতা উল্টে 'লিচু শ্যাম খায়' বললে যোগ্যতার অভাব স্পষ্ট হয়।
(গ) আসত্তি বা নৈকট্য (Proximity) :
বক্তার কথা সুচারু ভাবে তুলে ধরতে পদগুলোকে অর্থানুসারে সাজানো প্রয়োজন, যাতে পদগুলোর সম্বন্ধ (অর্থানুসারে) থাকে। ভাষায় যে নিয়ম স্বাভাবিক, সেই নিয়মে পরপর প্রযুক্ত হয়। অর্থাৎ তাদের আসত্তি বা নৈকট্য রক্ষিত হয়। যেমন—'আমি কাল কলকাতার বাড়ি থেকে এসেছি, আবার যদি বলা যায়— 'কাল থেকে কলকাতার এসেছি বাড়ি আমি'—তাহলে আসত্তি রক্ষিত না হয়ে বাক্যটি হবে নিরর্থক। অর্থাৎ আসত্তি বা নৈকট্য রক্ষার জন্যে বাক্যে ব্যবহৃত পদগুলোর মধ্যে ব্যাকরণ অনুমোদিত সঙ্গতি থাকা চাই। বাক্য হতে গেলে-- তাকে খাওয়ান, স্থলে 'তাকে খেল,' 'তুমি এলেন', 'সে খাবি' ইত্যাদি অর্থহীন বা ব্যাকরণ গত অপপ্রয়োগ চলবে না।
উল্লেখ্য, বাক্যরীতিতে ব্যাকরণ অর্থাৎ শব্দ ও ধাতু রূপের পরেই সর্বাপেক্ষা অধিক আবশ্যক পদের ক্রম-সঙ্গতি ও নৈকট্য।