বাংলা ভাষার উদ্ভবের ইতিহাস আলোচনা
ভাষা নদীর প্রবাহের মতোই গতিশীল এবং নিয়ত পরিবর্তনশীল। এই পরিবর্তনের জন্যই এক ভাষা পরবর্তী কালে এক বা একাধিক ভিন্ন ভাষায় পরিণত হয়। তবে পরিবর্তনশীল হলেও তার ধ্বনিগত ও রূপগত পার্থক্য হয়ে চলে নিরন্তর। স্বল্প সময়ের মধ্যে সেটা বোঝা না গেলেও দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে তা বোঝা যায়। ভাষায় এরকম পরিবর্তন ঘটে বলেই এক ভাষা থেকে একাধিক ভাষার জন্ম হয়। ভাষার ইতিহাসবিদগন ১২ টি আদি ভাষা বংশের অস্তিত্ব অনুমান করতে পেরেছেন। এই ভাষা বংশগুলির অন্যতম হলো ইন্দো-ইউরোপীয় বা আর্য ভাষা বংশ। এই ভাষা বংশ থেকে জাত ইউরোপ ও এশিয়ার বহু আধুনিক ভাষা এখন উৎকৃষ্ট ভাষা হিসেবেই গণ্য হয়। এই ভাষা বংশের প্রাচীন ভাষা হল সংস্কৃত, গ্রীক, লাতিন ইত্যাদি। তাই আর্য ভাষা বংশই হলো বাংলা ভাষার আদি উৎস। তবে আর্য ভাষার ঠিক পরবর্তী ধাপই বাংলা ভাষা নয়। মধ্যবর্তী অনেকগুলি স্তরের মধ্যদিয়ে বিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষা জন্ম লাভ করেছে।
বাংলা ভাষার উদ্ভব অষ্টম শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে। খ্রীষ্টপূর্ব ১৫০০ সালের কাছাকাছি সময়ে আর্যরা যে ভাষা মুখে নিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছিল, সেই ভাষা মানুষের মুখে মুখে পরিবর্তিত হয়ে খ্রীষ্টপূর্ব ৬০০ সালের কাছাকাছি সময় থেকে প্রাকৃত বা পালি ভাষার রূপগ্রহণ করে। এই প্রাকৃত ভাষা আবার বিবর্তিত হয়ে অপভ্রংশ বা অবহট্ঠ রূপলাভ করে খ্রীষ্টীয় চতুর্থ শতকের কাছাকাছি সময়ে।
প্রাচীন আর্যভাষার কথ্যরূপ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন রকমের প্রাকৃতের রূপলাভ করে। যেমন দক্ষিণ-পশ্চিমের ভাষা থেকে হল সৌরসেনী ও মহারাষ্ট্রীয়, উত্তর-মধ্য ভারতে অর্ধ মাগধী এবং পূর্ব ভারতে মাগধী প্রাকৃত জন্মলাভ করে। এই মাগধী প্রাকৃত থেকেই জন্ম নেয় মাগধী অপভ্রংশ। অষ্টম-নবম শতাব্দীতে তাই মাগধী অপভ্রংশ ভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক ও রূপতাত্ত্বিক স্বাতন্ত্র্য এতটাই ঘটে গেল যে একটি পৃথক ভাষারূপে তাকে গণ্য করতে হল। এই ভাষাটি হল বাংলা ভাষা।
অষ্টম-নবম শতাব্দীতে উৎপত্তি হলেও, সাহিত্য রচনার উপযোগী ক্ষমতা লাভ করতে এই ভাষার আরও কিছু সময় লাগাটাই স্বাভাবিক। প্রাচীন বাংলা ভাষার একমাত্র প্রাপ্ত নিদর্শন চর্যাপদের পদগুলি- নবম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে গঠিত বলেই পণ্ডিতদের অনুমান। শুধু বাংলা ভাষা নয় হিন্দি, মৈথিলী, মারাঠি, গুজরাটি, পাঞ্জাবী, উড়িয়া প্রভৃতি নতুন ভাষাগুলি সবই এই অষ্টম-নবম শতাব্দীতে জন্মলাভ করছে। এইসব ভাষাকে বলা হয় নব্য ভারতীয় আর্য ভাষা। অর্থাৎ নব্য ভারতীয় আর্য ভাষাগুলির অন্যতম হল বাংলা ভাষা। অর্থাৎ মাগবী অপভ্রংশ থেকে তাঁর জন্ম। অনেকের ধারনা যে সংস্কৃত হল বাংলা ভাষার জননী কিন্তু এই ধারণা বোধ হয় ঠিক নয়। কারণ সংস্কৃত ভাষা আসলে একটি কৃত্রিম লেখ্য ভাষা বা সাহিত্যিক ভাষা। তা কোনকালেই জীবন্ত বা মুখের ভাষা ছিল না। তাই তার বিবর্তন ও সম্ভব নয়। সেই জন্য এই সংস্কৃত ভাষার পক্ষে, কোনো ভাষার জননী হওয়াও সম্ভব নয়। যদি বাংলা ভাষার জননী কাউকে বলতেই হয়, তবে বলা যায় মাগধী অবহট্ঠ ভাষাই হল সেই জননী। তবে এই জননী স্থানীয় ভাষার কোন বিশ্বাসযোগ্য নিদর্শন পাওয়া যায়নি।
আনুমানিক নবম শতাব্দীতে যে বাংলা ভাষার জন্ম, ১২০০ বছর বয়সে তা আজ যথেষ্ট শক্তিশালী। প্রথম অবস্থা থেকে আজ পর্যন্ত অনেক বিবর্তন ঘটে গেছে, ধ্বনিতাত্ত্বিক এবং রূপতাত্ত্বিক পার্থক্য ঘটে গেছে বিস্তর। শব্দ ভাণ্ডারও সমৃদ্ধ হয়েছে যথেষ্ট। সেই ধ্বনিতাত্ত্বিক ঔ রূপতাত্ত্বিক পার্থক্যের উপর নির্ভর করে বাংলা ভাষার বিবর্তনকে তিনটি স্তরে ভাগ করা যায়। যেমন - প্রাচীন বাংলার সময়কাল আনুমানিক ৯০০-১৩৫০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত। মধ্য বাংলা, যার সময়কাল ১০৫০-১৮০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত।
১৮০০ থেকে সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত এই ভাষার সময়কাল এখনও এর বিবর্তন অব্যহত রয়েছে । ধ্বনিতাত্ত্বিক এবং রূপতাত্ত্বিক পরিবর্তন ঘটেই চলেছে। যার ফলে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে পাঁচটি উপভাষার সৃষ্টি হয়েছে। প্রাণীর মতো ভাষাও যেমন অন্য ভাষা থেকে জন্মায় তেমন অন্য ভাষার জন্মও দেয়। তার যেমন উদ্ভবের উৎস আছে তেমনি সেও অন্য ভাষার জন্মের উৎস হয়ে ওঠে। বিবর্তনের ফলেই আজকের বাংলা ভাষা থেকে সুদূর ভবিষ্যতে অন্য ভাষার জন্ম হবে ।