বাঁকুড়া জেলার ডিহর, পোখন্না, মেদিনীপুর জেলার তমলুক, ২৪ পরগণা জেলার চন্দ্রকেতু গড়, দিনাজপুরের বাণগড়, রাজসাহী জেলার পাহাড়পুর প্রভৃতি অঞ্চলের বেশ কিছু সংখ্যক স্তূপ ও ভগ্নস্তূপ উৎখননের ফলে যে সব প্রাচীন মৃৎমূর্তি পাওয়া গেছে সেগুলি আমাদের দেশের পুতুল-ঐতিহ্যের আদি নিদর্শন হিসাবে স্মরণীয়।
দেববিশ্বাস, লোকাচার, উপাচার ও মানতের সঙ্গে পুতুল যে কিভাবে যুক্ত তার বিস্তৃত উদাহরণ আছে পুরুলিয়া,বাঁকুড়া ও বীরভূম জেলায়। বৃক্ষতলে, গ্রাম থানে, লৌকিক দেব-দেবীর 'মাড়ে' মাটির ঘোড়া, হাতি সাজিয়ে দেবার রীতি আজও প্রচলিত আছে। লোক বিশ্বাসের এই উৎস ও স্রোত মুসলমানদের দরগা, আদিবাসী সাঁওতাল মুণ্ডাদের দেওয়া থানে বিস্তৃত। বোঙা হাতি আদিবাসীরা সেই কারণে তৈরি করে। মাটির ঘোড়ার চারুকলার শ্রেষ্ঠত্ব বাঁকুড়া জেলার পাঁচমুড়ায় দেখা যায়। তাছাড়া রাজগ্রাম, স্যান্দরা, মুরলু, সোনামুখী, কেয়াবতী অঞ্চলেও বিচিত্র গড়নের মাটির ঘোড়া দর্শনীয় বস্তু। কাঠের বা পাথরের ঘোড়াও এখানের পুতুলশিল্পের আধুনিক নমুনা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। মাটির ভাদু পুতুল রাঢ় অঞ্চলের প্রায় সর্বত্র দেখা যায়। বিশেষ দর্শনীয় 'কোলে-পো কাঁখে-পো যষ্ঠী' পুতুল। প্রাগৈতিহাসিক মাতৃকা পুতুলের সঙ্গে এর গড়নের খুবই মিল আছে।
কৃষ্ণনগর (নদীয়া) ঘূর্ণি অঞ্চলের পুতুল নির্মাণ রাজৎসাহে আরম্ভ হয়। আজ তার বিশ্বজোড়া খ্যাতি। বাঁকুড়ার পুতুল মূলত ভাবধর্মী বা প্রতীকধর্মী কৃষ্ণনগরের পুতুল হুবহু অনুকরণ। এখানের নানা জীবিকার মানুষ, কীটপতঙ্গ, পশু-পাখি, দেব-দেবীর মুখ, খাদ্যসম্ভার মিষ্টান্ন প্রভৃতি মৃৎশিল্পের বিচিত্র ও অত্যাশ্চর্য পরিকল্পনা। সবই মনে হয় জীবন্ত ও বাস্তব।
এককালে হুগলী জেলার তারকেশ্বর অঞ্চলে কাঠের মমি পুতুল তৈরি হত অজস্র পরিমাণে। ৮/১০ ইঞ্চি পরিমাপের এই নারী ও পুরুষ পুতুলগুলি যৎসামান্য বর্ণ রঞ্জনেই নয়নলোভন হয়ে উঠতো। কাঠের প্যাঁচা, বুড়ো-বুড়ী, ঝুমঝুমি, চুষি কাঠি, সন্দেশের ছাঁচ, থালা বাটি বালতি তারকনাথের মন্দিরের চার পাশে বহু দোকানে বিক্রয় হত। আর ছিল পোড়ামাটির টেপা পুতুল। কাঁচা এবং পোড়া মাটির টেপা পুতুলের চল ছিল এবং এখনও আছে। বাংলার টেরাকোটা মন্দিরের বিচিত্র পৌরাণিক লৌকিক পুতুলগুলি এই ধারারই মধ্যযুগীয় অনবদ্য নিদর্শন। টেপা পুতুলের একটি রকমফের বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুরের হিঙ্গল পুতুল। টেপা পুতুলগুলি পোড়ানোর পর গরম থাকতে থাকতে গালার কোটিং দিয়ে পুতুলগুলি গড়া হয় – সবুজ ও লাল রঙে। এদের বলে 'বর কনে' পুতুল। বিবাহের পর স্বামীগৃহে যাবার সময় কনেকে নানা দান সামগ্রীর সঙ্গে হিঙ্গুল পুতুল দেবার রীতি আছে। এখানেই রেলগাড়ী পুতুলও দর্শনীয়।
গালার পুতুল ও অলংকার তৈরি হত বীরভূম জেলার দুবরাজপুর, ইলামবাজার অঞ্চলে। ইংরাজ শাসকদের দেশবিদেশ ব্যাপী চাহিদা এই শিল্পকে উন্নতি দান করেছিল। লাল, কালো, হলুদ, সবুজ রঙের গালা দিয়ে তৈরি হত নানা সামাজিক পুতুল। বহরমপুরের হাতির দাঁতের পুতুল রাজকীয় মর্যাদা নিয়ে আজও বর্তমান। সোলা শিল্প বাংলার সর্বত্র এখনও আছে শৌখিন শোলার পুতুল মুর্শিদাবাদ, কৃষ্ণনগর, সোনামুখী, বিষ্ণুপুর, বারুইপুর, কাটোয়া, বহরমপুর, কুমারটুলি অঞ্চলে দেবদেবী, গৃহসজ্জা, মণ্ডপ সজ্জার প্রয়োজনে তৈরি হয়। পাথরের পুতুল তৈরি করেন বাঁকুড়ার শুশুনিয়া পাহাড় অঞ্চলের শিল্পীরা সুপ্রাচীনকাল থেকেই।
ঢোকরা পিতলের পুতুলও গ্রামজীবনের সঙ্গে পুরাকাল থেকে যুক্ত। বাঁকুড়ার বিগনা গ্রামে এবং বর্ধমানের দরিয়াপুর গ্রামের ডোকরা শিল্পীদের পুতুল ও মূর্তি যেমন নয়নালোভন তেমনি বিচিত্র। ডানা মেলা প্যাঁচা, বাইসন, বিস্তৃত ফণা সাপ থেকে আরম্ভ করে নানা মানব মূর্তি ও দেবদেবীর মূর্তির সৌন্দর্য পুরাকৃতির মতো আকর্ষণীয়। গৃহস্থ সজ্জার কাজে এই সব পুতুল বিশেষ আদর পেয়ে থাকে। এ শিল্পও এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে।
পুতুল এখন শুধু ছেলের হাতের খেলনা নয়, শুধু লোকশিল্পের উদাহরণ নয়, আধুনিক শিল্পবোধ ও শিল্পদক্ষতা পুতুলকে নিয়ে বৃহৎ শিল্পের বা কারখানা শিল্পের দিকে চলেছে। পাট, সোলা কাপড়, কাগজ, গালা দিয়ে পুতুলকে চমৎকার রূপ দেবার সাধনায় বিজ্ঞানের সহযোগিতা গ্রহণ করা হচ্ছে। দার্জিলিং জলপাইগুড়ির পাটের পুতুল আর গালার মুখোশ যেমন লোকশিল্পের ধারাকে বহন করে চলেছে তেমনিই কলকাতার নানা পুতুল সংস্থার কারুকলা জাপানের পুতুলশিল্পকে অনুসরণ অনুকরণ করছে। কোন কোন সংস্থা পুতুল প্রদর্শনীকে চিত্রকলা প্রদর্শনীর পর্যায়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে চলেছেন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন