ঝাঁপান গান - বাংলার লোকউৎসব ও ঐতিহ্য
ঝাঁপান শব্দের অর্থ হল দোলানো বা লাফানো। যেমন গাজনের বিশেষ অনুষ্ঠানে আগুন ঝাঁপ, বটি ঝাঁপ; শিব বা মনসার প্রসন্নতা বা কৃপা লাভার্থে যে শের অনুষ্ঠান তাও ঝাঁপান। ওঁরাও, মালপাহাড়ীয়া সম্প্রদায়ের মধ্যেও শব্দটি অনুরূপ অর্থে প্রচলিত। ভারতবর্ষে বহুপূজিত প্রাণী সাপ সম্পর্কিত একটি বিশেষ অনুষ্ঠান বা উৎসবের নামও 'মনসার ঝাঁপান'। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত সাপ দেবতা রূপে বন্দিত। মনসার সঙ্গে সাপের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ায় কখনও সাপ মনসার বাহন কখনও বা অলংকার রূপে ভূষিত। সেই তোরণে মনসা কখনো সাপ বা সাপ কখনো নারী হিসেবে চিহ্নিত। পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া, বীরভূম, মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদে মনসার ঝাঁপানে তিনি জীবন্ত সাপ। মালদহ, দিশপুরের 'মনসারলাভান' একটি চমৎকার সর্পপূজার অনুষ্ঠান। বিষ্ণুপুরের ঝাপান অনুষ্ঠানটি একটি ঐতিহ্যপূর্ণ রোমর্ষক জীবন্ত সর্প বিষয়ক অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানটি হয় শ্রাবণ সংক্রান্তিতে। এইদিন মল্লরাজদের মন্দির চাতালে দলে-দলে বেদে-বেদেনী সাপ নিয়ে নানা রকম খেলা দেখান। ওস্তাদ-সাপুড়ের বাঁশী আর ডুগডুগির তালে বিষধর সাপের সর্পিল লতানো দেহও নৃত্যের উন্মাদনায় উত্তাল হয়ে ওঠে। দর্শকগণ ভয়ে, আতঙ্কে, বিস্ময়ে, উল্লাসে মুখর হয়ে ওঠেন।
বীরভূমে ঝাঁপান অনুষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গে মনসার ভাসান ও পালা অনুষ্ঠিত হয়। মালদহে আষাঢ় মাসে অনুষ্ঠিত হয় বিষহরির 'লাভান'। লাভান থেকে 'লাফান' আসতে পারে। আষাঢ় সংক্রান্তিতে সীজমনসার তলায় অথবা বারোয়ারী নামে এই অনুষ্ঠান হয়। এর পূজারী সর্দার সম্প্রদায়ভুক্ত। কর্দমাক্ত চাতালে ঢাক-কাঁশীর উদ্দাম বাজনার তালে তালে ভক্তা নৃত্য করেন এবং মনসার ভর বলে হাঁস বা পায়রার বাচ্চার রক্ত পান করেন। আদিবাসী বা অন্যান্য সমাজে সাপ যৌন চিহ্ন সূচক। সেই কারণেই মনসার বা সাপের বিচিত্র-মণ্ডিত আচার-অনুষ্ঠান আমাদের দেশে প্রচলিত। যদিও অধিকাংশ অনুষ্ঠান করেন তপশীলভুক্ত বর্ণ হিন্দুরা, না হয়, আদিবাসী জনগোষ্ঠী।
ঝাপান হচ্ছে মনসা পূজা উপলক্ষ্যে সর্বসমক্ষে সাপখেলা দেখানো উৎসব। ঝাপান হয় বর্ষাকালে শ্রাবণ মাসের সংক্রান্তিতে। ভরা বর্ষায় পৃথিবী তখন শস্য উৎপাদনে রত, নবজন্মদানে রত। শস্য-উৎসবের নানা বৈচিত্র্যের মধ্যে সরাসরি ঝাঁপান না পড়লেও, ঝাঁপানের মূল ক্রিয়া-উপাদান সাপ, নবজন্মের প্রতীকরূপে দেখা দিয়েছে কৃষি-নির্ভর আদিম লোকমানসে। যেখানেই নবজন্ম সেখানেই উৎসব। পুরুষ জননাঙ্গের প্রতীক উদ্যত ফণা সাপ, স্ত্রী জননাঙ্গে প্রতীক পদ্মা। সর্পপূজা, মনসাপূজা, মনসামঙ্গল, গান প্রভৃতির সঙ্গে পদ্ম ফুলের যোগ ঘনিষ্ঠ। সর্পদেবী মনসার জন্ম পদ্মবনে। সাপ কোন কোন জাতিগোষ্ঠীর 'টোটেম' অর্থাৎ কুলকেতু। কোন বিশেষ দিনক্ষণে তাদের সর্পদর্শনের রীতি আছে। বাঁকুড়া-বিষ্ণুপুরের মল্লরাজারা নাগবংশীয়। তাঁরা সর্পদর্শন করেন শ্রাবণ সংক্রান্তিতে। ঝাপান উৎসবের সূচনা লগ্নে। ঝাপান অনুষ্ঠিত হয়, মল্লরাজবাড়ীর সামনের প্রাঙ্গণে, প্রশস্ত রাস্তার উপরে।
সাপকে নিয়ে মানব-মানসিকতার বিচিত্র বিকাশ ঘটেছে। সর্পদংশনে মৃত্যুভয়, এটিই শেষ কথা নয়। লোকবিশ্বাস, সাপ অমর। মৃত্যুর সময় হলে সাপ খোলস ছেড়ে নবজন্ম লাভ করে। শিব বিষ্ণু দুর্গা প্রভৃতি শ্রেষ্ঠ দেব-দেবীদের সঙ্গে সাপের সম্বন্ধ ঘনিষ্ঠ। হিন্দু বৌদ্ধ জৈন। দেব-দেবীরা সর্পভূষণ, সর্পভূষণা। তন্ত্রেও সাপের বিশেষ মর্যাদা। কুলকুণ্ডলিনী প্রকৃত পক্ষে সর্পরূপা। সর্পতান্ত্রিকদের সাধনাও বিশেষ সাধনা। সাপ ও সাপের বিষ নিয়ে বহু মানুষের জীবিকানির্বাহ। সাপের দেশ বাংলায় যেমন বহুতর সর্পসাহিত্য, পুরাণ, প্রবচন, কিম্বদন্তী, আচারব্রত অনুষ্ঠান, উৎসব, তেমনি তার মধ্যে ঝাঁপান একটি।
আমাদের বর্ণিত ঝাঁপান উৎসব প্রধানত মল্লরাজধানী বিষ্ণুপুরের ঝাঁপান উৎসবের বর্ণনা। সমগ্র রাঢ় অঞ্চলে প্রায় এই রীতিতেই ঝাঁপান হয়। তবে বিষ্ণুপুরের ঝাপান মধ্য রাঢ়ের ঝাপান উৎসবের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।
ঝাপান হয় সর্ব সমক্ষে, বিশেষ স্থানে, বহু দর্শক সমাগমের মধ্যে। বিভিন্ন দল, সাপুড়ের ও বিষবৈদ্যদের দল, নিজ নিজ প্রধান গুরু-গুণিনের পরিচালনায় আসেন ঝাপান খেলায় যোগ দিতে। সর্বসমক্ষে ঝাঁপান হওয়ার নেপথ্যে থাকে দীর্ঘ প্রস্তুতি, আচার পালন। সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালানোর আগে সকালে সলতে পাকানোর মতো।
মনসা মাসে অর্থাৎ মনসা দেবীর মন্দিরে শ্রাবণ সংক্রান্তির সকাল থেকেই বিভিন্ন অনুষ্ঠান। তারও আগে 'খইধারা'। শ্রাবণ মাসের শেষ নাগাদ মাঠের কাজ, ধান রোয়ার কাজ শেষ হয়ে যায়, তাই 'খইধারা'। ঐ দিন নতুন হাঁড়ি কড়ায় রান্না, ভাজা পোড়া, নিরামিষ খাওয়ার রীতি এবং 'ফলারের নিয়ম। তারপর 'ধার পালন' বা 'বার কামানো'। শ্রাবণ সংক্রান্তির আগের দিন। দাড়ি নখ কামিয়ে স্নান করে শুদ্ধ হতে হয় এবং উপবাস পালন করতে হয়।
শ্রাবণ সংক্রান্তির দিন 'মাখল দিন'। খলরূপিণী দেবী মনসার দিন। অথবা মা-ক্ষণ, মায়ে ক্ষণ, মায়ের সময়, মায়ের দিন। ঐ দিন সকাল থেকে সর্প-গুণিনেরা পূজা দেন মনসা মন্দিরে। ষোল আনার পূজা সর্ব সাধারণের পূজা সাঙ্গ হলে, প্রধান গুণিন অনেকগুলি সাপের পেড়ি (ঝাপি) সহ শিষ্যদের নিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করেন। রুদ্ধ দ্বার মন্দিরে মনসাকে সাপ খেলা দেখান। অতীতে কোন এক সময়ে বনের সব রাখাল মিলে মা মনসার পূজা করেছিল, সেই কাহিনী বর্ণিত হয় গানে গানে, চাপা স্বরে। 'বিষম ঢাকি' বাজে, ঢগ্ ঢুগ্ করে।
এইভাবেই তারা ঝাপানের জন্য প্রস্তুত হন। গতকাল থেকে তাঁরা উপবাস করে আছেন। মা মনসার আশীর্বাদ প্রার্থনা অনুমতি লাভের পর তাঁরা উপবাস ভঙ্গ করেন। স্নান খাওয়া সেরে ঝাপান যাত্রার জন্য প্রস্তুত হন। সাঙ্গ হয় গভীর গোপন প্রস্তুতি পর্ব।
লোকে লোকারণ্য ঝাপান উৎসবক্ষেত্র। সবাই উৎসুক, কখন আসবে ঝাঁপানের দল। উজ্জ্বল প্রখর রৌদ্রে সাপ ফনা তুলে দাঁড়াবে না, তাই দেরী হয় তাঁদের আসতে। অবশেষে দল আসা শুরু হয়। গাড়ীর পিঠে সাজানো মনসা মূর্তি আসে। গোরুর গাড়ীতে বা ছোট মোটরযানের উপর মাচান' বেঁধে তাতে চেপে আসেন গুণিনদের দল। কোন মাচানের উপর থাকে বাঘমূর্তি। বাঘ-ঝাঁপান খুব কঠিন ব্যাপার। সর্বত্র হয় না, বড় গুণিন ছাড়া পারেন না। বাঘের পিঠে সেই দলের প্রধান গুণিন গুরু বসে থাকেন। পুরুষ গুণিনদের সঙ্গে নারী গুণিনও মাচায় ওঠেন, সাপখেলা দেখান, গান করেন, মন্ত্র পড়েন, বাণ মারেন। অন্য দলের উদ্যত ফণা সাপকে নিস্তেজ করে দেওয়া হয়, মন্ত্র পড়ে, ধুলো পড়া ছুঁড়ে।
জোড়া ঢাক বাজে বাজে নানা বাদ্যি-বাজনা। তারই সঙ্গে বাজে মাচানের গুণিনদের হাতে হাতে 'বিষম ঢাকি'। ঝাপানে যোগদানকারী দলগুলি গান গায়। গান চলে, নানা উত্তেজনার মধ্যে। মল্লরাজ বংশতিলক এসে দাঁড়ান ঝাপান তলায়। ঝাঁপি-খোলা উত্থিত ফণা সৰ্প তিনি দূর থেকে দর্শন করেন। তারপর তিনি রাজবাড়ীর ভিতরে চলে যান। রাজার সর্পদর্শন সমাপ্ত হয়েছে, যথাবিধি শুরু হয়ে যায় ঝাপান। 'বাড়ুক বিষম ঢাকি চলুক ঝাঁপান'।
গোখরো, শিয়রচাঁদা, খরিস, কেউটে, কালাচ প্রভৃতি সাপই পেড়ি করে আনা হয়। কারণ এরাই তেজী, এরাই ফোঁস করে ফণা তুলে দাঁড়ায়। অবশ্য লাউডগা, ময়াল প্রভৃতি বিচিত্র দর্শন ছোট বড় সাপও আসে। একদল পেঁড়ির ঢাকনা খুলে একাধিক সাপকে দাঁড় করায় মাচানের উপরে। ফণা বিস্তার করে সাপেরা দুলতে থাকে। অন্য দলগুলিও মাচার উপর দাঁড়িয়ে তখন খেলা দেখাতে থাকে। ফণা তুলে দাঁড়ানো সাপেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। খুব নাটকীয় ব্যাপার। ভয়ে বিস্ময়ে জয়পরাজয়ের ভাবনায় দর্শকদের বুকের মধ্যে শ্বাস রুদ্ধ হয়। নিম্ন কণ্ঠে গান চলে। বিষম ঢাকি বাজে। মাতৃ আহ্বানের গান। 'এসো এসো গো মা জয় বিষহরি'। আন্তরিক আবেগে কাঁপে গানের গলা। চাপা উত্তেজনা সঞ্চারিত হয় মাচানে মাচানে।
দেবী এসো গো মা আমার আসরে।
ধুলায় পড়ে ডাকি তোমায় কাতরে।।
এই আকুল প্রার্থনাগীতের সঙ্গে সমবেত কণ্ঠে ধুয়া ধরেন দলের গুণিনেরা – 'নম নম নমো মাগো নমো নারায়ণী'। শুধু গান নয়, গালাগালও চলে। এক দল ব্যঙ্গ করেন অন্য দলকে, যাঁদের সাপ ফনা তুলে দাঁড়াতে পারছেন না তাঁদেরকে। 'বাখান' করেন সাপকেও, 'চ্যাংমুড়ী কানী' মনসাকেও মন্ত্রপড়া ধুলামুঠি ছুঁড়ে মারেন এক দলের গুণিন অন্য দলের গুণিনের দিকে, সাপের দিকে 'বাণ' মারেন। কেউ কেউ মন্ত্রবাণের ক্রিয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যান, অজ্ঞান হয়ে পড়েন। এ ভাবে চলে দলগুলির মধ্যে পারস্পরিক 'আড়াআড়ি', চলে 'খাওয়া খাওয়ি'।
কোন মাচান থেকে গুণিন প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন অন্য মাচানের দিকে, গানের সুরে -
শুন শুন গুণী ভাই ইতিহাস বল।
কোথায় গরুড়ের দর্প চূর্ণ হয়েছিল।।
উত্তর প্রত্যুত্তরের মাঝখানেই গানের ভাষায় আত্মপরিচয় দেন কোন গুণিন—
কালীপদ বিদ্যাবাগীশ আমার গুণিনের নাম।
বাজুক বিষম ঢাকি চলুক ঝাঁপান।।
যে দল সাপখেলায়, সর্প সৌন্দর্যে ও বৈচিত্র্যে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হন, সেই দল বকশিশ পান রাজার কাছে। মেলা ভেঙে গেলে, এক এক দল রাজ-অন্তঃপুরে প্রবেশ করেন, রাজাকে ও রাণীমায়েদের সাপখেলা দেখান।