শাশ্বতী কবিতায় প্রেম ভাবনার পরিচয়



ভূমিকা

আধুনিক বাংলা কবিতার জগতে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত নিঃসন্দেহে একজন স্মরণীয় কবি। দার্শনিক গভীরতা, শব্দ নির্মাণ, শব্দ প্রয়োগের দক্ষতা, কাব্যের বিষয়ভাব ও গঠন বিষয়ের সচেতনতা তার কবিতাকে এক পৃথক শিল্পসৌকর্য দান করেছে। অন্যান্য কবিদের মতোই এই কবিও প্রেমচিন্তাকে পরিত্যাগ করেননি বরং প্রেম তাঁর প্রজ্ঞার আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে।

কবিতাটির বিষয়বস্তু


শাশ্বতী কবিতার তিনটি স্তবকের প্রথমটিতে প্রাকৃতিক পরিবেশের বর্ণনা করা হয়েছে। যে পরিবেশে সহজেই প্রিয়তমার স্মৃতি জেগে ওঠে। বর্ষা ঋতুর অবসানে যখন শরতের আগমনী ধ্বনিত হচ্ছে প্রকৃতির বুকে তখন কবি মনেও যেন বিরহভার মচিত হয়ে মুকুলিত হয়েছে মিলনের শেফালী। এমনই এক পরিবেশে কবির মন চলে গেছে অতীত স্মৃতি রোমন্থনে-

"পশ্চাতে চায় আমারই উদাস আঁখি ;
একবেণী হিয়া ছাড়ে না মলিন কাঁথা।"

একবেণী হয়ে শয্যালগ্ন থাকা হলো নায়িকার বিরহের লক্ষণ। কবির হৃদয়ও যেন প্রাচীন নায়িকাদের মত বিরহে কাতর হয়ে উঠেছে।

কবিতার দ্বিতীয় স্তবক শুধু স্মৃতির উদ্ভাসন। এখানে তিনি অতীতের মিলন সুখের স্মৃতিচারণা করেছেন। আজকের এই পরিবেশের মতোই বহুকাল আগের এক রাতে-

"সে এসে সহসা হাত রেখেছিল হাতে,
চেয়েছিল মুখে সহজিয়া অনুরাগে ;"

সেদিন ফসল বিলাসী হাওয়া সেই নায়িকার পাকা ধানের মতো সোনালী চুল নিয়ে খেলায় মেতেছিল। বোঝা যায় কবির সেই নায়িকা ছিলেন বিদেশিনী। তিনি কবির হাতে হাত রেখে দৃষ্টি নত করেছিলেন। অর্থাৎ কবিকে প্রণয় নিবেদন করেছিলেন। কবিকে হয়তো একটি কথায় তার ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন। কবির হৃদয়ে জেগেছিল এক অনির্বচনীয় সুখানুভূতি। সাত-সাতটি স্বর্গবাসের মিলিত সুখও যার তুল্য নয়। তাই কবি লিখেছেন-

"একটি কথার দ্বিধাথরথর চুড়ে
ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী ;"

সেই মিলনের মুহূর্তটি কবি ভুলতে পারেন না। ক্ষণকালের মিলন হয়ে উঠেছে যেন শাশ্বত। আর সেই ক্ষনকালের নায়িকা হয়ে উঠেছেন শাশ্বতী।

কবিতার তৃতীয় স্তবকে কবি এই নায়িকাকে শাশ্বতী করে তোলার জন্যই যেন প্রকৃতির সঙ্গে নায়িকাকে এক করে তুলেছেন।ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নায়িকাকে করে তুলেছেন অতীন্দ্রিয়। পৃথিবীর অনামা -অজানা কুসুমে যেন সেই নায়িকার দেহ সৌরভ ভাসে। ভরা নদী যেন তারই আবেগের প্রতিনিধি। অমল আকাশ যেন তার হৃদয়ের প্রতিফলন। শিশির হলো তার স্বেদ, আর সেই রোমরাজির কোমলতা ঘাসে ঘাসে। নায়িকাকে প্রকৃতির অনুসঙ্গে অনুভব করার চেষ্টা করলেও কবির অন্তরে আরেকটা তথ্যও জাগ্রত হয়েছে।

"কিন্তু সে আজ আর কারে ভালোবাসে।"

নায়িকা আর কারও স্ত্রী হয়েছে আর কাউকে ভালবেসেছে জানলে নায়কের অন্তরে বেদনা জাগবারই কথা। তবে এতে কবি বেদনাহতও হন না। তার বিশ্বাস তার যেমন বিদেশিনী, স্বদেশেনী অনেক নায়িকা আছে তেমনই তার নায়িকারও বিদেশী, স্বদেশী একাধিক নায়ক থাকতেই পারে। তিনি এই নিয়ে কিছু মনে করেন না। তিনি স্মৃতিচারণার মধ্য দিয়ে ক্ষণকালের মিলনসুখকে শাশ্বত করে পেতে চান। কবিতার শেষ দুটি চরণে কবি সে কথাই উচ্চারণ করেছেন-

"সে ভুলে ভুলুক, কোটি মন্বন্তরে
আমি ভুলিব না, আমি কভু ভুলিব না ।।"

এখানে কবি কোটি মন্বন্তর শব্দগুচ্ছটি ব্যবহার করে তার নায়িকাকে আরেকবার শাশ্বতী করে তুলেছেন।

উপসংহার


সুতরাং শাশ্বতী কবিতাটির মূল বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে কবিতাটি একটি অসাধারণ প্রেমের কবিতা। প্রকৃতির অনুষঙ্গ, গভীর প্রেমানুভূতি, রস ভাবনা ও শিল্প চেতনার সমন্বয়ে শাশ্বতী একটি নিটোল প্রেমের কবিতা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। তাছাড়া এর আঙ্গিক সৌন্দর্যও পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করে।


Bonus Knowledge 🙂

শাশ্বতী কবিতাটি ১৯৩৫ সালে প্রকাশিত হয়। এই কবিতাটি অর্কেস্ট্রা কাব্যগ্রন্থে সংকলিত হয়।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কলকাতার যীশু কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা বিচার ও সংবাদধর্মীতা

মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্যের নামকরণের সার্থকতা বিচার

ঘোড়সওয়ার কবিতার সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু ও আধুনিকতার লক্ষণ