বিসর্জন নাটক সম্পর্কে কয়েকটি অভিমত - সুখময় মুখোপাধ্যায় (সম্পাদিত)
→ রবীন্দ্রনাথ : শান্তিনিকেতনে অধ্যাপনাকালে
'বিসর্জন' এই নাটকের নামকরণ কোন ভাবকে অবলম্বন করা হয়েছে? আমরা দেখতে পাই যে নাটকের শেষে রঘুপতি প্রতিমা বিসর্জন দিলেন, এই বাইরের ঘটনা ঘটল। কিন্তু এই নাটকে এর চেয়েও মহত্তর আর এক বিসর্জন হয়েছে। জয়সিংহ তাঁর প্রাণ বিসর্জন দিয়ে রঘুপতির মনে চেতনার সঞ্চার করে দিয়েছিল। সুতরাং প্রতিমাবিসর্জন এই নাটকের শেষ কথা নয়, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হল জয়সিংহের আত্মত্যাগ; কারণ, তখনই রঘুপতি সুস্পষ্টভাবে এই সত্যকে অনুভব করতে পারল যে, প্রেম হিংসার পথে চলে না, বিশ্বমাতার পূজা প্রেমের দ্বারাই হয়। এই মৃত্যুতে সে বুঝতে পারল যে, সে যা হারালো তা কত মূল্যবান। ছাগশিশুর পক্ষে প্রাণ কত সত্যজিনিষ সে কথা অপর্ণাই বুঝেছিল কিন্তু রঘুপতির পক্ষে তা বুঝতে সময় লেগেছিল।
এই নাটকে বরাবর এই দুটি ভাবের মধ্যে বিরোধ বেধেছে— প্রেম আর আর প্রতাপ। রঘুপতির প্রভুত্বের ইচ্ছার সঙ্গে গোবিন্দমাণিক্যের প্রেমের শক্তির দ্বন্দ্ব বেধেছিল। রাজা প্রেমকে জয় করতে চান, রাজপুরোহিত নিজের প্রভুত্বকে। নাটকেরশেষে রঘুপতিকে হার মানতে হয়েছিল। তার চৈতন্য হল, বোঝবার বাধা দূর হল, প্রেম হল জয়যুক্ত।
অপর্ণা এসে জয়সিংহের মনকে চঞ্চল করে দিল। যে-জীবকে অপর্ণা কোলে করে পালন করেছে তারই রক্তধারা মন্দিরের সোপান বেয়ে পড়েছে। জয়সিংহ মন প্রথার বন্ধনে আবদ্ধ ছিল; সে এই প্রথম আঘাত পেল; তারপর ক্রমে তার মনের মধ্যে এই সংগ্রাম বর্ধিত আকার ধারণ করল।
রঘুপতি মনে দয়ামায়া নেই, সে নিষ্ঠুর প্রথাকে পালন করে এসেছে এবং এমনিভাবে শক্তিলাভ করে বড়ো হয়ে উঠেছে। একদল লোক বাহ্যশক্তি ও প্রাচীন প্রথাকে চিরন্তন করে রাখতে চায়; অন্যদল বলছে, প্রেমই সবচেয়ে বড়ো জিনিষ। জয়সিংহ এই দোটানার মাঝখানে পড়ল এবং কোনটা শ্রেষ্ঠ পথ তা চিন্তা করে বার করবার চেষ্টা করতে লাগল।
কিন্তু যে শক্তি এই নাটকে জয়ী হয়েছে অপর্ণা তাকেই প্রকাশ করেছে। বাইরে থেকে তাকে দুর্বল বলে মনে হয় কিন্তু কার্যতঃ তারই জয় হোল। ক্ষুদ্র বালিকার বেশে সত্য প্রেমের দ্বার দিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করে, বিশ্বমাতার মূর্তিকে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে গেল।
শান্তিনিকেতনে অধ্যাপনাকালে
প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় :
“বিসর্জনে'র মধ্যে বিচিত্র চরিত্রের দ্বন্দ্বচিত্র এমনভাবে ফুটেছে যা ইতিপূর্বে রবীন্দ্রনাথের কোন গ্রন্থে প্রকাশ পায় না। রাজার সর্বাপেক্ষা বড় সংগ্রাম রানীর সঙ্গে। এখানে 'রাজা ও রানী'র সহিত মেলে এবং মেলে নাও বটে। গোবিন্দমাণিক্য ও গুণবতীর প্রেম গভীর। অথচ যে-অহিংসাকে রাজা সত্যধর্ম বলে বুঝতে পেরেয়াছেন তার জন্য রানীর প্রেম তাঁকে বিচলিত করতে পারে না, সেখানে সে অচল অটল, বা অসত্যের সহিত কোন প্রকার আপোস দর কষাকষি করতে নারাজ।
জয়সিংহ ও অপর্ণার প্রেমের মধ্যেও বিরোধ। জয়সিংহ সংস্কার-আবদ্ধ, ধর্মান্ধ, আচারসর্বস্ব গুরুর নিকট হতে আনুষ্ঠানিক ধর্মে অভ্যস্ত। আর অপর্ণা ভিখারিণী; কোন প্রকার সংস্কার তার চিরবহমান জীবনকে বাঁধতে পারে না।
'বিসর্জনে'র মধ্যে রবীন্দ্রনাথের বিপুল সৃষ্টিশক্তির পরিচয় পাই। রবীন্দ্রনাথ গোবিন্দমাণিক্যের প্রেমের ধৈর্যে সত্যের প্রতি অচলা নিষ্ঠার মাহাত্ম স্বীকার করেন। রঘুপতি জটিল মানব মনের একটি অপরূপ সৃষ্টি।
ডক্টর উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য :
এই নাটকের মূল দ্বন্দ্বটি হচ্ছে—ধর্মের অর্থহীন, অন্ধসংস্কার ও চিরাচরিত যুক্তিহীন প্রথার সঙ্গে নিত্যসত্য মানবধর্ম বা হৃদয়ধর্মের, মিথ্যা ধর্মবোধের সঙ্গে উদার মনষ্যত্বের; মানুষের রচিত আচারবিধির সঙ্গে হৃদয়ের পরম সত্য প্রেমের, হিংসার সঙ্গে অহিংসার। রঘুপতির মধ্যে এই মিথ্যা ধর্মবোধ ও অন্ধ সংস্কার তার প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে রূপায়িত, রাণী গুণবতীর স্বার্থ-বিজাড়িত সংস্কার ও প্রথামূলক ধর্মবোধ তার সাহায্যকারী, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নক্ষত্র রায়ের রাজ্য লাভ। কিন্তু মানুষ্যত্বের হৃদয়ধর্মের প্রেরণা তাকে বিচলিত করেছে। এই আচার-নিষ্ঠা ও বিবেকের দ্বন্দ্বে তার চিত্ত একবার এপক্ষের আর একবার ওপক্ষের মধ্যে দোলায়িত হয়েছে।
অপর্ণাই প্রকারান্তরে 'বিসর্জন' নাটকের মূল দ্বন্দ্বের কারণ। জয়সিংহের আত্মবিসর্জনের প্রচণ্ড আঘাতে রঘুপতির সমস্ত বিরুদ্ধতা ধুলিসাৎ হয়েছে। আনুষ্ঠানিক ধর্মের উপর দৃঢ়নিষ্ঠা, ব্রাহ্মণ্যের গর্ব, আত্মাভিমান ও ক্ষমতার দত্ত এবং বুদ্ধি ও ব্যক্তিত্বের বিরাট শক্তির আড়ালে লুকানো ছিল একটি দুর্বল স্থান। সে স্থানটি জয়সিংহের প্রতি অকৃত্রিম পুত্রস্নেহ। সেই স্থানে প্রচণ্ড আঘাত লাগায় তার শক্তির ও ব্যক্তিত্বের অভ্রভেদী প্রাসাদ চূর্ণ হয়ো ধুলিসাৎ হয়ে গেল।
পূর্ব হতেই রাজার চরিত্র একটি মহৎ ধর্ম ও আদর্শের বাহনরূপেই কল্পিত হয়েছে; তাই তাঁর চিত্তে কোনো তরঙ্গোদ্বলতা নাই, কর্মের মধ্যে চাঞ্চল্য নাই, দ্বন্দ্ব নাই। প্রত্যক্ষ নাটকের ক্ষেত্রে এই পরিণতিতে দুধর্ষ রঘুপতির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে রাজাকে যেন কতকটা দুর্বল দেখায় এবং নাটকীয় রসও খানিকটা চমৎকারিত্ব হারায়। রঘুপতির পরিবর্তনের পর রাজার বৈরাগ্য ঘটালে অনেকটা ভাল হত।
→ ডক্টর আশুতোষ ভট্টাচার্য : রবীন্দ্রনাট্য পরিক্রমা
নাটক হিসাবে 'বিসর্জন'ই রবীন্দ্রনাথের শক্তিশালী রচনা। তাঁর অন্যান্য নাটকের তুলনায় এর মধ্যেই সর্বাধিক নাট্যিক গুণের সমাবেশ দেখতে পাওয়া যায়। বিশেষতঃ একটি সমসাময়িক অতি জনপ্রিয় আধ্যাত্মিক বোধের বাহন ছিল বলে এটা শিক্ষিত জনসাধারণের মধ্যে অতি সহজেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সমর্থ হয়।
অতি-নাট্যিক ঘটনার সমাবেশে এই বিয়োগান্তক নাট্যকাহিনীর পরিকল্পনা করা হয়েছে। নিবিড় ঘটনা-প্রবাহের ক্ষিপ্র ও স্বচ্ছল গতি এই নাটকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। দৃশ্যের পর দৃশ্যে ঘটনার স্রোত এত দ্রুত সঞ্চরণ করেছে যে এর মধ্যে কোথাও কোন গভীর বিচ্ছেদের রেগ পড়বার অবকাশ পায় নি। কাহিনী-পরিকল্পনায় এই নাটকের ত্রুটি সর্বাপেক্ষা অল্প। এর মধ্যে অনাবশ্যক চরিত্র, প্রয়োজনাতিরিক্ত দৃশ্যসমাবেশ ও বাগবাহুল্য প্রায় নেই বললেই চলে।
পাশ্চাত্য শিক্ষাদীক্ষার সংস্পর্শে আসবার পর থেকেই এদেশের শিক্ষিত জনসাধারণ নিজেদের সামাজিক ব্যবস্থাগুলির সম্বন্ধে সর্বপ্রথম সজাগ হতে আরম্ভ করিল। সংস্কারের জড়ত্ব হতে মুক্তির সর্বপ্রথম প্রয়াস তখনই এদেশের সমাজের মধ্যে দেখা দিল। এই গতিশক্তিহীন নির্জীব সমাজ-ব্যবস্থার অচলায়তনকে রবীন্দ্রনাথ প্রথম হতেই আঘাত করতে আরম্ভ করেছিলেন। পাশ্চাত্য জীবনের আধ্যাত্মিক আদর্শ হতে আমরা love এবং faith সম্বন্ধে যে নূতন চৈতন্যলাভ করেছিলাম, তা আমাদের সমাজের আধ্যাত্মিক সাধনার সম্মুখীন করে নিয়ে নুতনভাবে বিচার আরম্ভ করবার ফলে আমাদের হৃদয়হীন কুপ্রথাগুলির ভয়াবহ স্বরূপ প্রকট হয়ে উঠতে লাগল। 'বিসর্জন'-এর মধ্যে তারই একটির পরিচয় দেওয়া হয়েছে মাত্র। এটাই রবীন্দ্রনাথের সর্বাধিক জনপ্রিয় নাটক।
রবীন্দ্রনাথের নাটকমাত্রই এক একটি ভাবের বাহন, 'বিসর্জন'-এর মধ্যেও তার কোন রকম ব্যতিক্রম দেখতে পাওয়া যায় না। এর ভিতর দিয়ে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত সহজভাবেই বলেছেন 'প্রেমের পথ ও হিংসার পথ এক নয়, প্রেমেই দেবতার পূজা, হিংসার নয়।
রঘুপতির অন্তরের একমাত্র অবলম্বন ছিল জয়সিংহের প্রতি স্নেহ। তার অন্তরের সেই স্থানটা যে-মুহূর্তে রিক্ত হয়ে গেল, সেই মুহুর্তেই এই নাটকের ট্র্যাজেডি দেখা দিল। কারণ, রঘুপতির জীবনের মর্মমূল কক্ষচ্যুত হয়ো যাবার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর জীবনের অন্যান্য অলীক বস্তু—স্বপ্নের মতো অদৃশ্য হয়ে গেল। গোমতীর জলে প্রতিমা বিসর্জন বাইরের একটা লৌকিক ব্যাপার মাত্র, অন্তরের বেদীতে রঘুপতি কোনদিনই দেবীর প্রতিষ্ঠা করেন নাই।
→ ডক্টর অজিতকুমার ঘোষ :
বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস দ্বিতীয় খণ্ড হিংসার উপর প্রতিষ্ঠিত যুক্তিহীন ধর্মাচার কখনো প্রকৃত ধর্মের অঙ্গ হতে পারে না, এটাই নাটকের প্রতিপাদ্য তত্ত্ব। রবীন্দ্রনাথের মানস সত্তা সৃষ্টির শাস্তি ও কল্যাণের মধুর দিবটাই বরাবর উদ্বোধন করে এসেছে। বুদ্ধদেবের অহিংসাতত্ত্ব তার জীবনদর্শনকে বিশেষ প্রভাবান্বিত করেছে—ধর্মের নামে আমাদের দেশে অহিংস ব্যাপার ঘটে আসছে, কবি তা কোনো দিন সমর্থন করতে পারেন নি। কবির ধর্ম বিশেষ করে তাঁর গভীর মনবতাবোধ হতে উদ্ভূত, সর্বব্যাপী প্রেম এবং কল্যাণের উপর এর প্রতিষ্ঠা • বিসর্জনের মধ্যে শুধু বলিদানের বিরুদ্ধে নয়, প্রতিমা পূজার বিরুদ্ধেও যেন একটা প্রচ্ছন্ন প্রতিবাদ রয়েছে। গোবিন্দমাণিক্য কেবল যে বলিদান বন্ধ করেছেন তা উপরে চাপিয়ে তাঁকে বিসর্জন দিয়ে যেন সর্বদোষমুক্ত হলেন, শান্তিলাভ করলেন, দেবীর প্রতি তাঁর আজন্ম বিশ্বাস এবং ভক্তি মিথ্যা বলে বুঝঝলেন।
→ চারুচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় বিসর্জন সম্বন্ধে লিখেছেন :
'বিসর্জন' ও একখানি নাট্যকাব্য। রবীন্দ্রনাথের প্রাথমিক নাটকগুলির মধ্যে এইখানি সর্বশ্রেষ্ঠ। এতে কবির সৃজনী শক্তি, হৃদয়ের উদারতা ও সত্যনিষ্ঠা আকার ধারণ করেছে। নাটকের পাত্র ও পাত্রীগণের মধ্যে মহারাজা গোবিন্দমাণিক্য, মহারাণী গুণবতী ও যুবরাজ নক্ষত্র রায় ঐতিহাসিক ব্যক্তি। মুর্শিদাবাদের নবাবের সাহায্যে যুবরাজ নক্ষত্র রায়ের ছত্রমাণিক্য নামে ত্রিপুরার সিংহাসন অধিকার ও গোবিন্দমারিএক্যর স্বেচ্ছায় রাজ্যত্যাগ ঐতিহাসিক ঘটনা।
রবীন্দ্রনাথ 'বিসর্জন' নাটকে দেখিয়েছে যে, প্রথা প্রেমকে বিনাশ করতে চাইলে প্রেম প্রথার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। অপর্ণা এতটুকু মেয়ে কিন্তু তার শক্তি অপরিমেয় সে জয়সিংহকে মন্দির ছেড়ে যেতে ডাকছে, রঘুপতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করিছে, রাজাকে সত্যদৃষ্টি দিয়ে সত্যপথে তাকে অটল দৃঢ় করে তুলেছে। রঘুপতির ভয় গোবিন্দমাণিক্যকে নয়, তাঁর ভয় ঐ ছোট্ট মেয়েটিকে। প্রেম ও মনুষ্যত্ব সকলকে সমস্ত মিথ্যা ও সংকীর্ণতা হতে অব্যাহতি দিল।
মানুষের চিরন্তন মনোবৃত্তি প্রেম মায়া মমতা দরদ প্রভৃতির দিকে লক্ষ্য না করে কতকগুলি। বিধিনিষেধ ও আচারের শুষ্ক শাসন মাত্র মেনে চললে জয়সিংহের মতন মহাপ্রাণকে বিসর্জন দিতে হয়।"
ইংরেজ কবি শেলী যেমন Spirit of Universal love দ্বারা জগতের সর্ব অমঙ্গল ও পাপ দূর করবার কল্পনা করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথও তেমনি প্রেমের দ্বারা সর্ব অকল্যাণ মোচন করতে চেয়েছিলেন। সেই ভাবের প্রতীক হচ্ছে অপর্ণ....
→ ডক্টর সুকুমার সেন :
'বিসর্জন' নাট্যরস জমেছে অন্ধসংস্কার, মূঢ়কর্তব্যনিষ্ঠা ও ভ্রান্ত অধিকারবোধের সঙ্গে গভীর হৃদয়বৃত্তি, উদার জ্ঞান ও নিরাসক্ত জীবনবোধের সংঘর্ষে। এই দ্বন্দ্বের তীব্রতা সবচেয়ে প্রকট নায়ক জয়সিংহের মনে। অন্যথা একপক্ষে রঘুপতি ও গুণপতি অপরপক্ষে গোবিন্দমাণিক্য ও অপর্ণা। গোবিন্দমাণিক্যের ও অপর্ণার মনে সংশয় নেই, তারা গভীর ইমোশনে'র মধ্য দিয়ে সত্যের আলোক পেয়েছে। রঘুপতির চরিত্রদৃঢ়তার প্রতিষ্ঠা তার নিষ্ঠায়। গুণবতীর চিত্ত বারে বারে দোল খেয়েছে প্রেম ও সংস্কারের মধ্যে। সে সন্তানবিহীন স্বামীর উপর কতৃত্বহানির আশঙ্কায় অভিমানিনী। তার এই স্বাভাবিক দৌর্বল্যের ছিদ্রপথে কাহিনীটি নাটকীয় পরিণতির দিকে উৎসারিত হয়েছে। আবাল্য মাতৃপিতৃহীন জয়সিংহ মানুষ হয়েছে দেবীমন্দিরে রঘুপতির আশ্রয়ে। ব্রহ্মণচারী তপস্বী পূজারী রঘুপতিকে অবলম্বন করিয়া তার শিশু-হৃদয় বিকশিত। একটু বড় হে দেবীভক্তি তার মন অধিকার করল। আরও বড় হলে গোবিন্দমাণিক্যের চরিত্রমাধুর্য তার কিশোর মনে শ্রদ্ধা ও প্রীতি আকর্ষণ করল। গোবিন্দমাণিক্য দেবীপূজায় বলি নিষেধ করেছেন শুনে জয়সিংহ হৃদয়ে প্রথম আঘাত পেল। দেবীর উপর তার ভক্তি এবং রঘুপতির প্রতি নিষ্ঠা তার দৃঢ়তর হইল। জয়সিংহের মনে দ্বিতীয় এবং প্রচণ্ডতর আঘাত লাগল রাজরতের জন্য রঘুপতির ভ্রাতৃহত্যার ষড়যন্ত্রে। এতে যুগপৎ দেবীর মাহাত্ম্য ও রঘুপতির অভ্রান্তরের প্রতি তার সংশয় জাগল, সংস্কার ও সদ্বুদ্ধির দ্বন্দ্ব বাধল। রঘুপতিকে সে ভ্রাতৃহত্যার পাপে অংশ গ্রহণ করতে দেবে না। রাজরক্ত সে নিজেই এনে দেবে। রাজরক্তপাতের পূর্ব মুহূর্তে গোবিন্দমাণিক্য যখন রঘুপতির ছলনা ধরিয়ে দিল, তখন যেন জয়সিংহের পারের তলা হতে মাটি সরে গেল। তার পর জীবন বিসর্জন ছাড়া গত্যন্তর রহল না।
দেবীর নিষ্ঠাবান সেবক রঘুপতি। ব্রাহ্মণের অধিকার সম্বন্ধে তার বোধ অত্যন্ত সচেতন। চিরাচিত প্রথা অনুসারে দেবীপূজাই তার একমাত্র কর্তব্য। হৃদয়বৃত্তির অনুশীলন করিবার কোন সুযোগই সে পায় না। মানবের বৃহত্তর কর্তব্যবোধ যে দেবীপূজার প্রচলিত বিধিকে উল্লঙ্ঘন করতে পারে এ ধারণা তার পক্ষে অভাবনীয়। গোবিন্দমাণিক্যের সঙ্গে রঘুপতির দ্বন্দ্ব এক হিসাবে ক্ষাত্র ও ব্রাহ্মণের দ্বন্দ্ব বলা যেতে পারে, অন্ততঃ রঘুপতির দিক দিয়ে। রঘুপতি ক্ষমতাপ্রিয় প্রতিমাপূজক, প্রতারক নয়। নিজের কাজে সে খাঁটি। সে সত্যকে দেখতে চায় নিজের বুদ্ধির দৃষ্টিতে। এই দৃষ্টি শাস্ত্রের অনুশাসনে সংকীর্ণ-প্রসর এবং সংস্কারের আবরণে ক্ষীণ। তাই দেশকালাতীত সহজ সত্যকে গ্রহণ করতে সে অক্ষম। ....... জয়সিংহের মৃত্যুতে রঘুপতির অহংকার-অভিমানের প্রাচীর ভেঙ্গে পড়ল। তখন জয়সিংহের প্রেমই মধ্যস্থ হয়ে রঘুপতি-অপর্ণার বিরোধের অবসান ঘটিয়ে দুই বিরোধী হৃদয়কে স্নেহের নিবিড় বন্ধনে বেঁধে দিল। .......
→ ডক্টর শ্রীকুমার বন্দোপাধ্যায় : বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস ৩য় খণ্ডে
নাট্যোল্লিখিত (বিসর্জন) পাত্র-পাত্রীর উক্তিগুলি অনাবশ্যকরূপে দীর্ঘ ও বাহুল্যদুষ্ট হয়েছে। তাদের মধ্যে নাটকোচিত সংযম ও অর্থপূর্ণতার অভাব। জয়সিংহের স্বগতোক্তিগুলিতে বিশেষ করে এই সকল দোষ লক্ষিত হয়। রাজা গোবিন্দমাণিক্যের অন্ত অটল তেজস্বিতা ও স্নেহসিক্ত ন্যায়নিষ্ঠা রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসে যেমন, নাটকে ততটা ফুটে ওঠে নি। ...... লেখকের ভাষা গীতি-কাব্যের দিক দিয়া বেশ কবিত্বপূর্ণ হইলেও নাটকের দমকা হাওয়া ও মুহুর্মুহুঃ পরিবর্তনশীল প্রয়োজনের দাবী মিটাবার পক্ষে যেন যথেষ্ট লঘু ও স্বচ্ছন্দগতি নয়। রবীন্দ্রনাথের যে নাটকের প্রতি স্বাভাবিক প্রবণতা ছিল না, তা বুঝতে গেলে তাঁর 'রাজর্ষি' উপন্যাসের সঙ্গে 'বিসর্জন' নাটকটির তুলনা করলেই চলবে। উপন্যাসে তিনি তাঁর সমস্ত প্রতিজ্ঞা সমস্ত মাধুর্য ও কোমলতা ঢেলে দিয়েছেন; নাটকের অপরিচিত ক্ষেত্রে তাঁর প্রতিভা যেন অপ্রত্যাশিত বাধা পেয়ে খণ্ডিত ও প্রতিহত হয়েছে। রাজার যে অধিকম মূর্তিটি উপন্যাসে জ্বলন্ত অক্ষরে ফুটে উঠেছে, নাটকে যেন তা অপেক্ষাকৃত অস্পষ্ট ও হীনপ্রভ। উপন্যাসটি তার ডান হাতের লেখা ও নাটকটি যেন বাঁ হাতের লেখা বলে মনে হয়।
মোহিতলাল মজুমদার : সাহিত্যবিতান :
“বিসর্জন' নাটকে গীতিকবির আত্মভার প্রচার আরও অকুণ্ঠিত হয়ে উঠেছে। এই রবীন্দ্র-নাটা বিসর্জন কাব্যে অতিশয় ভাবগম্ভীর কবিত্বও যেমন পুনঃ পুনঃ ঝলসিয়া উঠেছে, তেমনি কবির। আত্মভাব প্রচারে দুর্নমনীয় আবেশে এর পাত্রপাত্রীগণ ভস্ম হয়ে গেছে। 'বিসর্জনে' একটি ধর্মমতের প্রতিষ্ঠাই কবির কাব্য প্রেরণাকে নিরতিশয় খণ্ডিত করেছে, তাই এর কোনো চরিত্রই নাটকোচিত হয় নি। অর্থাৎ প্রকৃতি বা সমাজের অনুরূপ হয় নি। রাজা গোবিন্দমাণিক্য রাজা না হয়ে একজন পরম ভাবগত বাউল বৈষ্ণব হয়েছেন। ক্ষত্রিয়যুবক জয়সিংহ, রাজপুতবাচ্চা না হয়ে মহাকবি ও দার্শনিক হয়েছে। কতকটা হ্যামলেটের মত হইলেও সে হ্যামলেটও হতে পারে না—হ্যামলেটের মত তার জন্মগত রাজরতের সংস্কার শেষের কার্যটিতে ফুটে ওঠে না। রঘুপতিও হিন্দু মন্দিরের শক্তি পুরোহিত না হয়ে, কবির অভিপ্রায় সাধনের জন্য প্রাচীন মিশরের বা ফিনিসীয় দেবমন্দিরের পুরোহিত হয়েছে। সে তেমনই ক্ষমতালোভী, রাজশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বী, ধূর্ত ও নাস্তিক, তার কারণ সে পৃথিবীর সকল পৌত্তলিক ধর্মের প্রতিনিধি; সে ধর্মের যারা রক্ষক তারা জনগণের মূঢ় বিশ্বাসকে যেমন ঘৃণা করে, তেমনিই তাদিকে প্রতারণা করে থাকে। এই নাটকে, কবির স্বগত অভিপ্রায়সিদ্ধির জন্য শক্তি বাঙালী ব্রাহ্মণকে ঐ চরিত্র স্বীকার করতে হয়েছে। সবচেয়ে লক্ষণীয় এই যে, এই নাটকের একটি চরিত্রও ট্র্যাজেডির চরিত্র নয়, সকলেই অতিশয় দুর্বল, ভাবের আতিশয্যে আত্মহারা। জয়সিংহের আত্মহত্যার মধ্যেও যেমন কোন সহজ মানবীয় বুদ্ধি বা প্রবৃত্তি প্ররোচনা নাই, রঘুপতির পরিণামও তেমনই একটি ভাববাষ্পপূর্ণ গোলকের বিস্ফোরণ মাত্র; সে যেন এতদিন একটা স্বপ্ন দেখছিল, তার সেই দুর্ধর্ষ সংকল্প, সেই আত্মাভিমান তার চরিত্রগত নয়— সে যেন একটা মুখোশ, তাই তার সেই স্বপ্নভঙ্গের ট্র্যাজেডি একটি মেলোড্রমায় পর্যবসিত হয়েছে।
ডক্টর সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত : 'রবীন্দ্রনাথ'
রঘুপতি, গোবিন্দমাণিক্য, এঁরা প্রত্যেকেই বিরাটমানব। রঘুপতির মধ্যে রয়েছে সংস্কারের অপরিসীম তেজ, আর গোবিন্দমাণিক্যে নবজাগ্রত অনুভূতি আজন্মার্জিত সংস্কারের মতইভগবান; এই দুই বিরাট মানবের সংঘর্ষ এই ট্র্যাজেডির প্রধান উপাদান। বিষয় গৌরবে এই নাটক কাকেও অপেক্ষা হীন নয়। গোবিন্দমাণিক্য শুধু যে রঘুপতি ও প্রজার বিরুদ্ধেই নিজের মত দৃঢ় রেখেছেন তা নয়, তাঁকে সংগ্রাম করতে হয়েছে আরও নিকটতর, প্রিয়তর লোকের বিরুদ্ধে। তাঁহার স্ত্রী নিঃস্তান। হিন্দু রমণীর স্বাভাবিক সংস্কার তো তাঁর আছেই; তাপরপর বলির সাহায্যে রাণী দেবতার বর লাভ করতে চান, যে-বর তাঁকে সন্তান দিয়ে তার জীবনের অভিশাপ ঘুচিয়ে দেবে।
গোবিন্দমাণিক্য ও রঘুপতির দ্বন্দ্বের ট্র্যাজেডির উপকরণ রয়েছে। ট্র্যাজেডিতে যাদের মধ্যে সংঘর্ষ হবে তারা অসাধারণ ব্যক্তি হবে, একথা সমালোচকদের নিকট শুনতে পাই। আজকাল সাম্যবাদের দিনে সাধারণ লয়ে ট্র্যাজেডির মূল কথা হচ্ছে ব্যক্তির দ্বন্দ্ব, সেখানকার পরস্পরবিরোধী ব্যক্তিরা একেবারে ক্ষীণজীবী হলে চলবে না। গোবিন্দমাণিক্য ও রঘুপতির মনের দৃঢ়তা অনমনীয়; তাই হৃদয় সংঘর্ষে একটি মহত্ত্ব আছে, যা সামান্য নরনারীর কাহিনীতে পাওয়া কঠিন। তবে একটি বিষয়ে ত্রুটি আছে বলে মনে হয়। শ্রেষ্ঠ ট্র্যাজেডিতে শুধু যে বাইরের উত্থান পতনের কথা রচিত হয় তা নয়, নায়কের মনের নানাভাবের ঘাতপ্রতিঘাতের চিত্রও দেওয়া হয়ে থাকে এবং শেষোক দ্বন্দ্বই সেক্সপীয়র প্রভৃতির শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের নাটকের প্রধান উপজীব্য। কিন্তু 'বিসর্জন' নাটকে পরস্পরবিরোধী দুইটি নায়কের মনে কোন নি। বলি বন্ধ করাতে ভ্রাতা ও স্ত্রীর সঙ্গে যে-বিচ্ছেদ ঘটেছে এর জন্য রাজা দুঃখিত, কিন্তু নিজ কর্তব্য সম্পর্কে তার মনে কোন দ্বিধা নেই। রঘুপতির কঠিন চিত্র জয়সিংহের জন্য স্নেহমমতায় ভরপুর, কিন্তু এর জন্য বলির ঔচিত্য সম্বন্ধে তিনি কখনও সন্দিহান হন নি। জয়সিংহের মৃত্যুর পর তিনি অপর্ণাকে মা বলে আহ্বান করেছেন ও দেবীপ্রতিমার মধ্যে মাতার প্রাণ নাই এ কথা বলেছেন। কিন্তু ইহা ধর্মান্তর গ্রহণের মত শোনায় এবং এ নাটকেরও অবসান হয়েছে। যত দিন তিনি স্বীয় ধর্মে বিশ্বাস করতেন, ততদিন মূহুর্তের জন্যও বিচলিত হন না; আর যেদিন তাকে ছাড়লেন, একবারেই ছাড়লেন। প্রধান নায়কাে মধ্যে মানসিক দ্বন্দ্বের যে অভাবের কথা সূচিত হল, এটা অপরাধ এমন কথা বলা কিনা জানি না, কিন্তু এই শ্রেণীর অন্যান্য শ্রেষ্ঠ নাটকে যাহা পাওয়া যায়, তা এই নাটকে নেই। তাই এটা একটু অসম্পূর্ণ বলিয়া মনে হয়।
ডক্টর এস. সি. সেনগুপ্তা : The Geat Sentinel
The Conflicts starts in the beginning of the drama. When King Gobinda forbids sacrifice, it reasches a climax at dead of night when Raghupati and Nakahatra prapare to sacrifice Dhruba, the foster-child of King Gobinda, and the Catastrophe comes in the early hours of the morning revulsion in the mind of Raghupati who throws the image a way and retiree with Aparna.
→ প্রমথনাথ বিশী : 'রবীন্দ্রনাথ'
'বিসর্জন' বর্ষাকালের নাটক—কেবল তার নাটকীতার চূড়ান্ত শ্রাবণের শেষরাত্রে বর্ষাকালের শেষরাত্রে ঘটেছে; পরের দিন অর্থাৎ শরতের প্রথমে এর অবসান। বিসর্জনে'র মতো মানব-হৃদয়ের ঘাতপ্রতিঘাতপূর্ণ নাটকে বর্ষার লীলা প্রকাশের অবস অম্ল- যেটুকু বা আছে তাও যেন কবি তেমনভাবে গ্রহণ করেন নি। জয়সিংহের হৃদয়ের দ্বন্দ্ব বর্ষার মেঘাড়ম্বরে, অবিশ্রাম বর্ষনে বিদ্যুৎচমকে, বজ্রাঘাতে ও গর্জনের ভিতর দিয়ে প্রকাশ করবার সুযোগ ছিল। জয়সিংহের হৃদয়ের সরলতা ও আবেগ বর্ষার স্নিগ্ধতা ও শ্যামশ্রীর দোসর। 'বিসর্জন' নাটকে কবি এই সুযোগ গ্রহণ না করলেও 'রাজর্ষি' উপন্যাসে করেছেন।
বলিদান আসলে রিপুবলি। কারণ রিপু থেকেই পাপের জন্ম। রিপুকে অর্থাৎ ভিতরকার পশুকে এবং পাপাচারীকে ছাগ বা মহিষ কল্পনা করে রিপুর প্রবঞ্চনাই করা এবং অবশ্যই তা' সাধানার বিকৃতি। রঘুপতির মধ্যে এই বিকৃতির রূপকেই রবীন্দ্রনাথ ব্যক্ত করতে চেষ্টা করেছেন। প্রকৃতির প্রতি মানুষের প্রতিভা এবং মানুষ্যত্বের বিকাশে যথেষ্ট সাহায্য করে, কিন্তু প্রথা বলতে কতকগুলি জ্বড় অর্থহীন কুসংস্কার বা অপরিবর্তনীয় নিয়মকে বুঝায় না। এইখানেই রঘুপতির ভুল, কিন্তু এই ভুলের জন্য যে মূল্য তাকে দিতে হল তাও তো সামান্য নহে। এইজন্যই জয়সিংহের আত্মবিসর্জনের পর রঘুপতির প্রতি আমাদের অ সহানুভূতিতে পূর্ণ হয়ে ওঠে।
অধ্যাপক দ্বিজেন্দ্রলাল নাথ :
'বিসর্জন' নাটক রবীন্দ্রনাথের প্রথম যুগের নাটকগোষ্ঠীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি নাট্যগুণান্বিত। নাটকের বিষয়বস্তুতে রয়েছে দুটো প্রবল আদর্শের সংঘাত : একদিকে বহুযুগসঞ্চিত দেশপ্রথা ও সংস্কারের অন্ধ আনুগত্য আর একদিকে সর্বযুগ-আকাঙ্ক্ষিত জীবপ্রেমের মধ্যে দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়ে নাটকীয় ঘটনা চলমান হয়ে উঠেছে। রঘুপতির মতো অন্তদ্বন্দ্ববিদীর্ণ ট্র্যাজিক চরিত্র রীবন্দ্রনাটকে আর নেই—সমালোচকের এ মন্তব্য একেবারে যুক্তিহীন নয়। অপরাপর চরিত্রের মধ্যে গোবিন্দমাণিক্য গুণবতী, জয়সিংহ ও অপর্ণার চরিত্রও উজ্জ্বল রেখায় অন্বিত হয়েছে। প্রেম ও প্রতাপের দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত প্রেম জয়লাভ করেছে—রবীন্দ্রনাথের এ-প্রিয়-আদর্শ-অভিমুখী আইডিয়া শুধু 'বিসর্জন' নাটকে নয়—- তাঁর পরবর্তী বহু নাটকেও ঘুরে ফিরে দেখা দিয়েছে, কিন্তু নাটকে আইডিয়া প্রতিষ্ঠা এবং প্রচারই বড়ো কথা নয়-- সে আইডিয়া ঘটনা-বিন্যাস ও সংঘর্ষ-সৃষ্টির মধ্য দিয়া কতখানি নাট্যরস সৃষ্টি করতে পেরেছে তাই আমাদের বিবেচ্য।
'বিসর্জন' নাটকের সব চাইতে ত্রুটিপূর্ণ বিষয় বোধ হয় নাট্যোল্লিখিত বিষয় বোধ হয়। নাট্যোল্লিখিত পাত্র-পাত্রীর মুখে উচ্ছাসময় দীর্ঘ সংলাপের যোজনা। ...... 'বিসর্জন' নাটকের অপর প্রধান ত্রুটি হলো নাট্যকারণ নির্লিপ্তিতার অভাব (detachment)। কোন কোন চরিত্রের মধ্য দিয়ে নাট্যকার নিজের মতামত নিয়ে স্পষ্টভাবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। এ- ছাড়া কোন কোন চরিত্রের মুখে যে-সংলাপ দেওয়া হয়েছে তাও মানব-মনস্তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। রঘুপতির পরিবর্তনও এসেছে আকস্মিক ভাবে। নাটকের পরিসমাপ্তিও নিটোল নয়। মনে হয় নাট্যকারের পূর্ব পরিকল্পিত কোন ভাবাদর্শকে জয়যুক্ত করবার জন্যে তাহাহুড়া করে এরূপ পরিসমাপ্তি ঘটানো হয়েছে। এ সমস্ত ত্রুটি সত্ত্বেও একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই যে 'বিসর্জন' নাটকে অভিনয় গুন যথেষ্ট বর্তমান।
→ ডক্টর নীহাররঞ্জন রায় : 'রবীন্দ্রসাহিত্যের ভূমিকা' :
'বিসর্জন' দেখি পুঁথিগত আচারগত ধর্মের বিরুদ্ধে মানবধর্ম বিশ্বধর্মের প্রতীক একটি ধর্মকে দাঁড় করিয়ে দুয়ের মধ্যে একটি দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করা হয়েছে এবং মানবধর্মকে শেষ পর্যন্ত জয়ী করা হয়েছে। ***
এ-কথা সকলেই জানেন যে, 'বিসর্জনে'র মধ্যে একটা ‘আইডিয়া' খুব নিবিড় হয়ে আছে, সমস্ত নাটকটিতে সেই 'আইডিয়াটি 'রই সংগ্রাম। পঞ্চমাদের প্রথম দৃশ্যের সঙ্গে সঙ্গে যদি নাটকটির উপর যবনিকাপাত হত, তা হলে সংগ্রামের শেষে সেই ‘আইডিয়াটাই জয়ী হইল কি না সে খবর আমরা পাইতাম না। কিন্তু শেষ দৃশ্যগুলিতে আমরা দেখিলাম, সেই 'আইডিয়াটা'রই সম্পূর্ণ বিজয়োৎসব। একটা নির্দিষ্ট সত্য প্রতিষ্ঠার, একটা নির্দিষ্ট 'আইডিয়া’র জয়-প্রদর্শনের এই যে প্রয়াস, ইহা 'বিসর্জনে'র রসবোধ ও অনুভূতির তীব্রতাকে একটু ক্ষুণ্ণ না করে পারে না; এবং সেই নির্দিষ্ট সত্যটাই যে কবির মনকে অধিকার করিয়া রাখেছিল তাও কতকটা ধরা না পড়ে পারে নাই।
ডক্টর তারাকনাথ গঙ্গোপাধ্যায় :
বহির্মুখী সংঘাতধর্মী নাটক এবং একক ভাবের পুষ্পিত উচ্ছ্বাস—এই দুইয়ের দ্বন্দ্ব সবচেয়ে করুণ হয়ে ফুটেছে 'রাজা ও রাণীর পরবর্তী সৃষ্টি 'বিসর্জনে। ... হিংসাশক্তির সঙ্গে প্রেমশক্তির সংঘর্ষ এবং হিংসার বিসর্জনে প্রেমের প্রতিষ্ঠা— নাটকে ব্যক্তব্যটি এই। 'রাজর্ষি' উপন্যাসের বিস্তৃত জটিল কাহিনীর মধ্য থেকে ভাবের এই অংশটুকুই বধীন্দ্রনাথ সযত্নে আহরণ করে নিয়েছেন। নাটকের এই উদ্দেশ্যটি প্রথম থেকেই অতিমাত্রায় স্পষ্ট— চরিগুলিকে বিকশিত করে বক্তব্যকে সিদ্ধান্তরূপে নিষ্পন্ন করা হয়নি, প্রতিটি চরিত্র উদ্দেশ্যকে পরিক্রমা করতে বাধ্য হয়েছে। ফলে, যে-রঘুপতি এমন অসামান্য বিরোধী শক্তিরূপে সংকেতিত হয়েছিলেন, তিনি প্রতিমার মুখ ঘুরিয়ে দেবার কাজে নাস্তিকের ভূমিকা নিয়েছেন, হিত্যা অরণ্যের মাঝে, হত্যা জলে স্থলে, ইত্যাদি উক্তিতে ডারউইনের তত্ত্বে পৌঁছেছেন, 'মহামিথ্যা'র সিদ্ধান্তে তাঁকে বৈদান্তিক বলে মনে হয়। গুণবতীর চমৎকার চরিত্রটি কলঙ্কিত হয়েছে ধ্রুবকে হত্যা করবার অহেতুক (তাঁর বিদ্বেষের কোন পূর্ব-ভূমিকা নেই) পৈশাচিক চক্রান্তে। মোগল এবং নক্ষত্র রায়ের হাতে রাজ্য ছেড়ে দিয়ে গোবিন্দমাণিক্যের বানপ্রস্থের সংকল্প বিদ্রোহী রূপ নেয় নিছক কাপুরুষতায়; রাজার সিংহাসনে বসে' অনুজকে নির্বাসন দিতে পারেন, সেই রাজাই কেমন করে মোগলের পরাধীনতাকে ভ্রাতৃপ্রেমের নামে ত্রিপুরাকে - উপহার দেবেন—সে-কথা অনুমান করা কঠিন হয়।
কিন্তু এগুলি বাইরের প্রশ্ন। সব চাইতে বড় কথা এই যে, একমাত্র ভাবের একক সুরটিকে এই নাটকে ধরতে চেয়েছিলেন লেখক, কিন্তু প্রথাসিদ্ধ নাট্যরীতিকেও তিনি বর্জন করতে পারেন নি।
→ ডক্টর তারাপদ মুখোপাধ্যায় :
প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সমগ্র নাটকথানির মধ্যে গোবিন্দমাণিক্যের যে অপ্রতিহত প্রভাব রয়েছে, জয়সিংহের আত্মবিসর্জন ও তাঁর তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্ব এত গভীরভাবে অনুভূত হয়েছে এবং রঘুপতি-চরিত্রের অন্তিম পরিণতিকে এর বড় করে দেখানো হয়েছে যে, নাটকের নায়ক-বিচারে এদের কাকেও ছোট করে দেখা সম্ভব নয়। একজন সমস্ত দ্বন্দ্ব সংঘাত ঘটনার স্রোত হতে ঊর্ধ্বে আপন মহিমায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, একজন দুই বিরোধী ঘটনার স্রোতে পড়ে ঘুরপাক খেতে খেতে আত্মবিসর্জন করে ফেললেন, আর একজন স্বহস্তে সমস্ত ঘটনা পরিচালনার গুরুভার গ্রহণ করিয়া পরিণতিকে নিজের ভাগ্যানুকূল করবার মধ্য দিয়ে। অপরাজেয় পুরুষকারের পরিচয় দিয়েছেন। চরিত্রের মহিমায়, কবিচিত্তের সহানুভূতিতে এবং ঘটনার পরিচালনার শুরু দায়িত্বে নাটকমধ্যে তিনটি চরিত্রই সমান শক্তিসম্পন্ন। তিনটি চরিত্রই প্রধান হোক, এী নায়ক পরিকল্পনা যখন সম্ভব নয়, তখন এদের মধ্য থেকে একজনকে নায়কত্বের পদে বরণ করে নিতে হবে, এখন কাকে সে পদে বরণ করা যায়- তাহা বিতর্কমূলক সমস্যা।