বৃন্দাবনের ষড়গোস্বামী
দ্বাপর যুগে স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ-স্বরূপে বৃন্দাবনে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। কলিযুগে শ্রীচৈতন্যদেবের কৃপাতেই বৃন্দাবন পুনরায় তীর্থক্ষেত্ররূপে প্রসিদ্ধি লাভ করে। চৈতন্যদেব যখন গৌড়-রামকেলি-ঝাড়খণ্ডের মধ্য দিয়ে বৃন্দাবন পরিক্রমায় গিয়েছিলেন বৃন্দাবন তখন ঝোপজঙ্গলে পরিপূর্ণ একান্ত শ্রীহীন হয়ে পড়েছিল। চৈতন্যদেবই প্রথম বৃন্দাবনের বিভিন্ন জায়গায় কৃষ্ণের লীলাস্থলগুলি চিহ্নিত করেন, পরবর্তীকালে সেখানে মঠ-মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীকালে তিনি তাঁর অনেক ভক্তকে বৃন্দাবনে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য পাঠিয়েছিলেন। তারপর থেকেই গৌড়ীয় ভক্ত ও তীর্থযাত্রীদের যাতায়াতের ফলে বৃন্দাবন পুনরায় তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হয়। শ্রীচৈতন্যদেবের নিজেরও একান্ত ইচ্ছা ছিল সন্ন্যাস গ্রহণের পর বৃন্দাবনেই স্থায়ীভাবে বাস করার। কিন্তু বাংলা থেকে বৃন্দাবনের দূরত্ব এবং তার ফলে শচীমাতার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার ভয়ে তিনি অপেক্ষাকৃত নিকটবর্তী পুরীধামকেই তাঁর স্থায়ী বসবাসের জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। বৃন্দাবন তো হিন্দুদের পবিত্র তীর্থক্ষেত্র ছিলই, সেই সঙ্গে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম ও তত্ত্বের বিকাশ কেন্দ্র হিসেবে এর গুরুত্ব ক্রমশ বিস্তার লাভ করে।
চৈতন্যের তিরোধানের পর নিত্যানন্দ, তারপর নিত্যানন্দের পুত্র বীরভদ্রের (মতান্তরে বীরচন্দ্র) উপর বৈষ্ণব সমাজের নেতৃত্বের ভার অর্পিত হয়েছিল। নিত্যানন্দ এবং বীরভদ্র বৈষ্ণবীয় প্রেম ধর্মের সহজ আবেগে সাধারণ মানুষকে আবিষ্ট করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁদের কারো মধ্যেই দার্শনিক প্রবণতা ছিল না। অথচ যে কোন ধর্ম বা সম্প্রদায়কে বলিষ্ঠ ও সুকঠিন ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করতে হলে দার্শনিক মননের বিশেষভাবে প্রয়োজন। অত্যন্ত সৌভাগ্যের বিষয়, বৃন্দাবনের ষড় গোস্বামীদের সংস্কৃত গ্রন্থগুলি আবেগধর্মী বৈষ্ণব মতকে একটা সর্বভারতীয় দার্শনিক প্রত্যয় দান করেছে, অতিরিক্ত ভাবের উচ্ছ্বাসকে মননের গণ্ডীর মধ্যে সংযত ও সংহত করতে পেরেছে। কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁর চৈতন্যচরিতামৃতে ষড় গোস্বামীর উল্লেখ করতে গিয়ে
লিখেছেন—
“শ্রীরূপ শ্রীসনাতন ভট্ট রঘুনাথ।
শ্রীজীব গোপাল ভট্ট দাস রঘুনাথ।।
এই ছয় গোসাঞির করি চরণ বন্দন।
যাহা হৈতে বিঘ্ন নাশ অভীষ্ট পূরণ।।”
এই ছয় গোসাঞি-কেই তিনি তাঁর শিক্ষাগুরু বলেছেন এবং বৃন্দাবনের ষড় গোস্বামী হিসেবে এঁরা বৈষ্ণব সমাজে বিশেষভাবে পরিচিত। কিন্তু এই ছ'জন ছাড়াও এঁদের মধ্যে প্রভাবশালী ভক্ত-বৈষ্ণব আরও কয়েকজন ছিলেন, কিন্তু তাঁরা সাধন-ভজন নিয়ে একান্তে থাকতেন বলে তাঁদের সম্বন্ধে বৈষ্ণব জীবনীকারগণ নীরব থেকেছেন। অবশ্য এঁদেরও পূর্বে মাধবেন্দ্রপুরী বৃন্দাবন পরিক্রমা করে পবিত্র বৃন্দাবনধামকে সর্বপ্রথম ভক্তচক্ষে নিয়ে আসেন। চৈতন্যের পূর্বে তিনিই প্রথম বাংলাদেশে কৃষ্ণভক্তি প্রচার করেছিলেন। তিনিই প্রথম ব্রজধামে গোপালমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন এবং গোপাল সেবার ব্যবস্থা করেন। কবিরাজ গোস্বামীও তাঁর সম্বন্ধে লিখেছেন—
“সাবধানে বন্দির আজ শ্রীমাধব পুরী।
বিষ্ণুভক্তি পথের প্রথম অবতরি ॥”
আমরা এখন বৃন্দাবনের ষড় গোস্বামী সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করব।
• শ্রীসনাতন গোস্বামী :
শ্রীসর্বজ্ঞ নামে কর্ণাটে একজন প্রবল পরাক্রান্ত রাজা ছিলেন। তিনি ছিলেন ভরদ্বাজ গোত্রীয় যজুর্বেদী ব্রাহ্মণ। চারটি বেদ সম্পর্কে তাঁর সম্যক জ্ঞান ছিল, ব্রাহ্মণ সমাজেও তিনি 'জগদগুরু' নামে বিখ্যাত ছিলেন। তাঁর পুত্র অনিরুদ্ধও বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ ছিলেন। অনিরুদ্ধেরও দুই পুত্ররূপেশ্বর এবং হরিহর। মৃত্যুর পূর্বে অনিরুদ্ধ দুই ভাইকে তার রাজত্ব সমানভাগে ভাগ করে দেন। কিন্তু কিছুদিন পরই অনুজ হরিহর জোষ্ঠ রূপেশ্বরকে রাজ্য ভ্রষ্ট করে নিজেই সমগ্র রাজ্য অধিকার করেন। নিরুপায় রূপেশ্বর সপত্নীক পৌরস্তা দেশে পালিয়ে গিয়ে সেখানকার রাজা শিখরেশ্বরের প্রীতি ও সৌহার্দ্য লাভ করে সেখানেই বসবাস করতে থাকেন। এখানে পদ্মনাভ নামে তাঁর এক পুত্র জন্মগ্রহণ করে। পরবর্তীকালে পদ্মনাভ সাঙ্গ যজুর্বেদ, সমস্ত উপনিষদ এবং রসশাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করেন। শেষ বয়সে তিনি কালনার নিকটবর্তী নৈহাটী গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন। পদ্মনাভের আঠারটি কন্যা, পাঁচটি পুত্র। তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র মুকুন্দের পুত্রের নাম ছিল কুমারদেব। তিনি অত্যন্ত শুদ্ধাচারী ব্রাহ্মণ ছিলেন। কুমারদেবেরও অনেকগুলি সন্তান। তার মধ্যে শ্রীসনাতন, শ্রীরূপ এবং শ্রীঅনুপম—এই তিনজনই বৈষ্ণবশ্রেষ্ঠ বলে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। এঁরা তিনজনই গৌড়েশ্বর হুসেন শাহের অধীনে রাজকার্য করতেন। সেখানে গৌড়েশ্বর প্রদত্ত পদানুযায়ী তাঁদের নাম ছিল সাকর মল্লিক, দবীর খাস এবং অনুপম মল্লিক। অনুপমের পুত্রের নাম শ্রীজীব। চৈতন্যদেব জ্যেষ্ঠ দুই ভাইয়ের নতুন নাম দিয়েছিলেন—সনাতন ও রূপ।
সনাতন নবদ্বীপের নৈয়ায়িক পণ্ডিত বিদ্যাবাচস্পতির কাছে অধ্যয়ন করেছিলেন। পরে গৌড়ের সুলতান হুসেন শাহের উচ্চ রাজকর্মচারী হয়ে ধনজন ও প্রতিষ্ঠা সবই লাভ করেছিলেন। তাঁদের বাস ছিল গৌড়ের কাছে রামকেলিগ্রাম। নীলাচল থেকে মহাপ্রভু যখন একবার বাংলাদেশে এসেছিলেন তখন রামকেলি গ্রামে রূপ-সনাতনের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। তবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, চৈতন্যদেবের সঙ্গে সাক্ষাতের পূর্ব থেকেই তাঁরা বৈষ্ণবাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। কারণ রূপ গোস্বামীর 'দানকেলিকৌমুদী, উদ্ধবদূত' ও ‘হংসদূত' চৈতন্যের সঙ্গে পরিচিত হবার পূর্বেই রচিত হয়েছিল। চৈতন্যের সঙ্গে সাক্ষাতের পরই তাঁরা বিষয় ত্যাগের উপায় চিন্তা করতে থাকেন। সুলতানের অধীনে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত থাকলেও মুসলমান সাহচর্যে তাঁরা একেবারেই স্বচ্ছন্দ ছিলেন। না। হুসেন শাহ ও শেষ দিকে হিন্দুদের প্রতি ক্রমশ অনুদার হয়ে উঠেছিলেন।
এই সময় হুসেন শাহ সনাতনকে উড়িষ্যা অভিযানের সঙ্গী করতে চাইলে তিনি রাজী হননি। কারণ উড়িষ্যা জয়ের সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার তীর্থমন্দির ও দেবস্থান কলুষিত করাও হুসেন শাহের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। সনাতন অভিযানে যেতে অস্বীকৃত হলে হুসেন শাহ তাঁকে কারাগারে বন্দী করে একজন মুসলমান দ্বাররক্ষীকে পাহারার ভার দিয়ে যান। সনাতন কৌশলে নিজেকে কারাগার থেকে মুক্ত করে বৃন্দাবনের পথে যাত্রা করেন। কাশীতে সনাতনের সঙ্গে মহাপ্রভুর সাক্ষাৎ হয়। দু'মাস নিজের কাছে রেখে মহাপ্রভু সনাতনকে ভক্তিতত্ত্ব শিক্ষা দিয়ে বললেন-
“তুমিহ করিহ ভক্তি শাস্ত্রের প্রচার ।
মথুরায় লুপ্ত তীর্থের করিহ উদ্ধার ॥
বৃন্দাবনে কৃষ্ণসেবা বৈষ্ণব আচার ।
ভক্তিস্মৃতি শাস্ত্রে করি করিহ প্রচার ”
সনাতনের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গেই মহাপ্রভু বলেছিলেন ভগবানের মানব-লীলা মাহাত্ম্যের কথা—“কৃষ্ণের যতেক খেলা, সর্বোত্তম নরলীলা।/নরবপু তাহার স্বরূপ।” মহাপ্রভু তাঁকে সম্বন্ধ তত্ত্বের কথাও বলেন। ভগবানের সঙ্গে জীবের সম্বন্ধ হল সেবা-সেবক সম্বন্ধ। তিনি অভিধেয় তত্ত্বের কথা বলেন। রসস্বরূপ কৃষ্ণকে লাভ করার জন্য যে উপায় অবলম্বন করতে হয় তাকেই বলে অভিধেয়। প্রেমভক্তিই হল শ্রীকৃষ্ণকে পাবার পরম উপায়। মহাপ্রভু সনাতনকে প্রয়োজন তত্ত্বের কথাও বলেন। যে উদ্দেশ্যে উপাসনা করা হয় তাকেই প্রয়োজন তত্ত্ব বলে। ভগবানের স্মৃতিকে জাগ্রত রাখাই উপাসনার মুখ্য উদ্দেশ্য। মহাপ্রভু তাকে বললেন চিচ্ছক্তি, জীবশক্তি, মায়াশক্তির কথা, কর্ম-জ্ঞান ও ভক্তিযোগের কথা। সত্যযুগে ধ্যান, ত্রেতাযুগে যজ্ঞ, দ্বাপরে কৃষ্ণ-ভজনা এবং কলিযুগে কৃষ্ণনাম সংকীর্তন। গুরু এবং অন্তর্যামীরূপে শ্রীকৃষ্ণ বৈধীভক্তি, রাগানুগাভক্তি, শুদ্ধভক্তি এবং পঞ্চম পুরুষার্থ কৃষ্ণপ্রেম - এইসকল প্রসঙ্গ মহাপ্রভু সনাতনের কাছে বর্ণনা করেন। সেই সঙ্গে উপদেশ দেন, “বহু গ্রন্থ কলাভ্যাস ব্যাখ্যান বর্জিবে” এবং “অন্য দেব অন্য শাস্ত্র নিন্দা না করিবে।” সবশেষে তিনি তাঁকে ভক্তিশাস্ত্রের প্রচার এবং মথুরার লুপ্ত তীর্থ উদ্ধার করার নির্দেশ দেন।
শেষ পর্যন্ত সনাতনের চেষ্টাতেই মথুরা বৃন্দাবনের লুপ্ত তীর্থ-মাহাত্ম্য পুনরুদ্ধার হয়েছিল এবং তাঁর গ্রন্থাদি বৈষ্ণবধর্ম, দর্শন ও আচারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিল। সনাতন রচিত ‘বৃহদ্ ভাগবতামৃত' গৌড়ীয় বৈষ্ণব তত্ত্ব, দর্শন ও আদর্শ ব্যাখ্যার একটি অমূল্য গ্রন্থস্বরূপ। তাঁর ‘বৈষ্ণবতোষিণী' শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্ধের টীকা। এই টীকায় সনাতন মাধবেন্দ্র পুরীকে কৃষ্ণভক্তির অঙ্কুররূপে গণ্য করেছেন। এছাড়াও সনাতনের আরও দুটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ— 'হরিভক্তিবিলাস' এবং 'লীলাস্তব' বা 'দশমচরিত'। বৈষ্ণবতত্ত্ব ও দর্শনের মননশীল ভিত্তি রচনায় শ্রীসনাতনের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
• শ্রীরূপ গোস্বামী :
শ্রীরূপ গোস্বামীও ছিলেন হুসেন শাহের কর্মচারী, সেখানে তাঁর নাম ছিল দবীর খাস। নীলাচল থেকে মহাপ্রভু বৃন্দাবন যাত্রার পূর্বে আর একবার বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি গৌড়ের রামকেলিতে এলে রূপ তাঁর শরণাগত হন। পরে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা সনাতনের জন্য দশ হাজার টাকা এক মুদীর দোকানে জমা রেখে ছোটভাই অনুপমকে সঙ্গে করে পৈত্রিক বাড়ী বাকলা চন্দ্রদ্বীপে গমন করেন। দেশে ফিরে নীলাচল থেকে মহাপ্রভুর বৃন্দাবন গমনের সংবাদ পেয়ে প্রয়াগে গিয়ে রূপ তাঁর সঙ্গে মিলিত হন। দশদিন নিজের সান্নিধ্যে রেখে মহাপ্রভু রূপকে ভক্তিতত্ত্ব শিক্ষা দেন। যে প্রসঙ্গগুলি তিনি রূপের কাছে আলোচনা করেছিলেন তা হল কর্মনিষ্ঠা, জ্ঞানী, মুক্ত, কৃষ্ণভক্ত জীব—গুরুকৃষ্ণ প্রসাদে লভ্য ভক্তি, ভগবৎ ভজনা, নিষিদ্ধাচারের বাহুল্য বর্জন, শুদ্ধভক্তি—শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য, মধুর রস এবং প্রেমের ভাব ও মহাভাবে উত্তরণ।
মহাপ্রভুর উপদেশ-নির্দেশের পর রূপ-কে তিনি বৃন্দাবনে গিয়ে ভক্তিশাস্ত্র লেখার নির্দেশ দেন। কৃষ্ণলীলা অবলম্বনে নাটক লিখতে প্রবৃত্ত হয়ে রূপ পুনরায় নীলাচলে মহাপ্রভুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং মহাপ্রভুর উপদেশে কৃষ্ণলীলাকে ব্রজলীলা এবং দ্বারকালীলা দুই ভাগে বিভক্ত করেন। মহাপ্রভুর অন্তরের ভাবকে কাব্যে রূপ দেবার দুর্লভ শিল্পদৃষ্টি ছিল রূপ গোস্বামীর। সনাতন বৈষ্ণব আচার, নীতি-উপদেশ, ভাগবত ব্যাখ্যা প্রভৃতি ব্যাপারে লিপ্ত ছিলেন। কিন্তু রূপ গোস্বামী কাব্য, নাটক, নাট্যতত্ত্ব, নাট্যশাস্ত্র, অলঙ্কার, রসতত্ত্ব—এক কথায় রসসৃষ্টি ও তত্ত্ব ব্যাখ্যা উভয় ব্যাপারেই সমান দক্ষতা দেখিয়েছেন। তাঁর রচিত কাব্য — হংসদূত, উদ্ধবসন্দেশ, স্তবমালা; নাটক-বিদগ্ধমাধব, ললিতমাধব, দানকেলিকৌমুদী; রসতত্ত্ব ও অলঙ্কারশাস্ত্র-ভক্তিরসামৃতসিন্ধু, উজ্জ্বলনীলমণি; নাট্যতত্ত্ব-নাটকচন্দ্রিকা; কাব্যসংকলন — পদ্যাবলী; ধর্মতত্ত্ব—সংক্ষিপ্ত ভাগবতামৃত প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
শিখরিণী ছন্দে ১৪২ স্তবকে লেখা তাঁর 'হংসদূত' কাব্যটি বৈচিত্র্যের দিক দিয়ে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কৃষ্ণবিরহে রাধার যন্ত্রণার কথা উল্লেখ করে সখী ললিতা একটি শ্বেতহংসকে দূত করে মথুরায় কৃষ্ণের নিকট পাঠালেন। বৃন্দাবন থেকে মথুরা পর্যন্ত পথের বিস্তৃত বর্ণনা, কৃষ্ণলীলার চিহ্ন, স্থান প্রভৃতি কাব্যটিতে বর্ণিত হয়েছে। ‘উদ্ধবসন্দেশ' মন্দাক্রান্তা ছন্দে লেখা। কাব্যটিতে ভাগবতের দশম স্কন্ধে বর্ণিত উদ্ধব কাহিনীকে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। স্তব স্তোত্র রচনাতেও রূপ গোস্বামী আলঙ্কারিক নিপুণতা ও কবিকল্পনার নানা বৈচিত্র্য দেখিয়েছেন। তাঁর 'গোবিন্দ বিরুদাবলী” তীক্ষ্ণ বুদ্ধিদীপ্ত আলঙ্কারিক কৌশল, শ্রুতিসুখকর অনুপ্রাস প্রভৃতি কাব্যকৌশলে পাঠককে চমৎকৃত করে। সংস্কৃত সাহিত্যেও তাঁর যে পারদর্শিতা তার প্রমাণ স্বরূপ তাঁর 'বিদগ্ধমাধব’ ও 'ললিতমাধব' নামে দুটি নাটক এবং 'দানকেলিকৌমুদী' নামে একটি ভণিকা উল্লেখযোগ্য। বিদগ্ধমাধবে বৃন্দাবনলীলা বর্ণিত হয়েছে, কিন্তু 'ললিত মাধবে' বৃন্দাবনলীলা, মথুরালীলা ও দ্বারকালীলা তিনটিই স্থান পেয়েছে।
তাঁর 'ললিতমাধব' দশ অঙ্কে সমাপ্ত দীর্ঘ ঘটনা বিবৃতিমূলক নাটক। 'উজ্জ্বলনীলমণি' বর্ণিত সংবর্ধমান সম্ভোগের বর্ণনার জন্যই নাকি এই নাটক রচিত হয়েছিল। তবে রূপ গোস্বামীর প্রতিভার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন তাঁর 'ভক্তিরসামৃতসিন্ধু' এবং 'উজ্জ্বলনীলমণি'। ‘ভক্তিরসামৃতসিন্ধু'র ভক্তিরস এবং উজ্জ্বলনীলমণি'র অলঙ্কারতত্ত্ব ও কাব্যাদর্শ শুধু গৌড়ীয় বৈষ্ণব সাহিত্যের নয়, ভারতীয় অলঙ্কার শাস্ত্রেরও একটি সার্থক সংযোজন।
• শ্রীজীব গোস্বামী :
শ্রীজীব হলেন সনাতনের কনিষ্ঠ সহোদর অনুপমের পুত্র। তিনি নবদ্বীপে অধ্যয়ন করতে এসে নিত্যানন্দের আদেশে বৃন্দাবন গমন করেন। সেখানে পিতৃব্য রূপ এবং সনাতনের কাছে ভক্তিশাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। সনাতন, রূপ ও জীব—এই তিনজনে বৈষ্ণব সম্প্রদায়, দর্শন ও তত্ত্বাদর্শ গড়ে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। তার মধ্যে সনাতনের বৈষ্ণবমতের উপনিষদ, ভাগবতের ব্যাখ্যা, রূপের ভক্তিশাস্ত্র ও আলঙ্কারিক রসতত্ত্বকে বৈষ্ণবধর্মের অনুকূলে স্থাপন এবং জীব গোস্বামী বৈষ্ণব দর্শনের উপর বিরাট সৌধ নির্মাণ করে চিন্তা জ্ঞান ও তত্ত্বদর্শনের ক্ষেত্রে বিস্ময়কর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। সনাতন মূলত ভাষ্যকার, রূপ কবি ও মর্মগ্রাহী রসবেত্তা কিন্তু তাঁদের ভ্রাতুষ্পুত্র জীব মূলত দার্শনিক। জীব গোস্বামীর সঙ্গে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের বিশেষ যোগাযোগ ছিল। বাংলার বৈষ্ণবগণের তত্ত্বঘটিত সন্দেহ ও বাদানুবাদ নিরসনে তিনি বিশেষভাবে সাহায্য করতেন। তাঁরই আগ্রহ ও আনুকূল্যে রূপ সনাতনের গ্রন্থসমূহ বাংলাদেশে প্রচারের জন্য প্রেরিত হয়েছিল। এক কথায় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের কল্যাণ, বিকাশ ও বর্ধনের প্রতি তাঁর সতর্ক দৃষ্টি ছিল।
চৈতন্যের তিরোধানের সময় জীব বালক বা কিশোর বয়সী ছিলেন। বাল্যকাল থেকেই তিনি চৈতন্য ভক্তির আবহাওয়ায় লালিত-পালিত হয়েছিলেন, তখন থেকেই তাঁর মনে সংসার ত্যাগের বাসনা জেগেছিল। কৈশোর বয়সেই তিনি পিতা ও জ্যেষ্ঠতাতের আদর্শ অনুসরণ করে মস্তক মুণ্ডন ও গৈরিক বেশ ধারণ করে সন্ন্যাস নিলেন। তারপর নিত্যানন্দের নিকটে যান এবং তাঁর নির্দেশে কাশীধামে গিয়ে বিদ্যার্জন করার পর বৃন্দাবনে উপস্থিত হন। সেখানেই রূপ ও সনাতন ভ্রাতুষ্পুত্র জীবকে বৈষ্ণব তত্ত্বে দীক্ষা দেন।
জীব গোস্বামী স্বভাবগতভাবেই ছিলেন তাত্ত্বিক ও দার্শনিক। নানা মূল্যবান গ্রন্থ লিখে, বাংলাদেশে প্রামাণিক বৈষ্ণব গ্রন্থ প্রচার ও প্রসারের ব্যবস্থা করে, বৃন্দাবন থেকেই গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজকে পরিচালিত করে তিনি একাধারে তাত্ত্বিক-দার্শনিক এবং সাংগঠনিক প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ হল, কাব্য — গোপালচম্পু, সংকল্প কল্পদ্রুম, মাধবমহোৎসব; ব্যাকরণ ও রসশাস্ত্র — হরিনামামৃত ব্যাকরণ, সূত্রমালিকা, লোচনরচনী; বৈষ্ণবস্মৃতি ও ধর্মতত্ত্ব— গোপালতাপনী, ব্ৰহ্মসংহিতা, লঘুতোষিণী; বৈষ্ণবদর্শন— ষটসন্দর্ভ, সর্বসংবাদিনী প্রভৃতি। তাঁর 'গোপালচ' গদ্যপদ্যময় কৃষ্ণলীলা বিষয়ক বিশাল কাব্য। ব্যাকরণ ও অলঙ্কারশাস্ত্রে তাঁর বিশেষ নিপুণতা ছিল। তাঁর লেখা গ্রন্থগুলিতে প্রচুর পাণ্ডিত্য ও রসবোধের পরিচয় থাকলেও তিনি যে জন্য বৈষ্ণবসমাজ ও বঙ্গসংস্কৃতিতে স্মরণীয় হয়ে আছেন তা হল তাঁর বৈষ্ণবদর্শন সম্পর্কিত গ্রন্থগুলি। তিনিই গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মকে মননশীল, চিন্তাবদ্ধ ও সুদূরপ্রসারী করে তুলেছিলেন। তাঁর 'যটসন্দর্ভ' গ্রন্থটি স্বতন্ত্র ছয়টি গ্রন্থের সমাহার—তত্ত্বসন্দর্ভ, ভগবৎসন্দর্ভ, পরমাত্ম সন্দর্ভ, শ্রীকৃষ্ণ সন্দর্ভ, ভক্তি সন্দর্ভ এবং প্রীতি সন্দর্ভ। ভগবৎ সন্দর্ভে আছে গৌড়ীয় বৈষ্ণব আদর্শ অনুযায়ী ভাগবতের ব্যাখ্যা। পরমাত্ম সন্দর্ভে আছে ভগবানের সঙ্গে ভক্তের ভেদ এবং অভেদ নিয়ে অচিন্ত্যভেদাভেদের কথা। শ্রীকৃষ্ণ সন্দর্ভে শ্রীকৃষ্ণকে অংশ অবতার না বলে সর্বরূপে স্বয়ং পূর্ণ অবতারী বলা হয়েছে। ভক্তিসন্দর্ভে শুদ্ধভক্তি, বৈধীভক্তি, রাগানুগা ভক্তির প্রসঙ্গ বলেছেন, প্রীতিসন্দর্ভে বলেছেন প্রেমভক্তির প্রসঙ্গ। বৈষ্ণব রসশাস্ত্রে ভগবানের প্রতি উদ্দিষ্ট প্রীতিকে প্রেমভক্তি আখ্যা দেওয়া হয়। এই প্রেমভক্তির বশে জীব প্রেমস্বরূপ ভগবানকে যেমন উপলব্ধি করে, ভগবানও তেমনি ভক্তের প্রেম মারফৎ নিজের প্রীতিবোধকে নিজেই আস্বাদন করেন।
প্রীতি সন্দর্ভে জীব গোস্বামী দুটি মৌলিক বিষয়ের অবতারণা করেছেন—একটি হল ভক্তি কিভাবে রসে পরিণত হয়, অন্যটি হল স্বকীয়া-পরকীয়াবাদ। তিনি দেখিয়েছেন, অলঙ্কারশাস্ত্রে ভক্তিকে রস বলা না হলেও ভগবৎপ্রীতি সেখানে যথার্থ স্থায়িভাবরূপে গৃহীত হতে পারে। কৃষ্ণরতিতে স্থায়িভাবের সমস্ত প্রকরণই বর্তমান, তেত্রিশটি ব্যভিচারী ভাবও কৃষ্ণরতিতে পাওয়া যায়। প্রসঙ্গক্রমে তিনি গোপীপ্রেম সম্বন্ধে বলেছেন যে, গোপীপ্রেমই যথার্থ কৃষ্ণরতির দৃষ্টান্ত। স্বকীয়া-পরকীয়া প্রসঙ্গে সংস্কার রূপ সংকটমোচনের জন্য বলেছেন যে দ্বারকার কৃষ্ণপ্রিয়াগণ এবং বৃন্দাবনের ব্রজাঙ্গনাগণের মধ্যে একদল কৃষ্ণের বিবাহিতা, অন্য দল পরোটা। কিন্তু এঁরা সকলেই কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি। সুতরাং বৃন্দাবনের গোপীলীলার মধ্যে প্রাকৃত কাম নেই, পরকীয়া ভাবও নেই। সন্দর্ভের শেষে জীব গোস্বামী কৃষ্ণাবতাররূপে আবির্ভূত চৈতন্যবিগ্রহকে ভক্তি নিবেদন করেছেন। জীব গোস্বামী বৈষ্ণব ধর্মের সকল আবেগ এবং আকৃতিকে দার্শনিক ভিত্তিভূমির উপর সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন।
• শ্রীরঘুনাথ দাস গোস্বামী :
রঘুনাথ দাস ছিলেন সপ্তগ্রাম নিবাসী শ্রীগোবর্ধন দাসের পুত্র। তাঁর জ্যেঠার নাম ছিল হিরণ্য দাস। তাঁরা দু'ভাই ছিলেন সপ্তগ্রাম মুলুকের অধিপতি, প্রচুর সম্পত্তির অধিকারী। হিরণ্যদাস নিঃসন্তান, সুতরাং গোবর্ধন দাসের একমাত্র পুত্র রঘুনাথ দাসই ছিলেন এই বিপুল সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী। কিন্তু বিষয়-আশয়ের প্রতি তাঁর বিন্দুমাত্রা আসক্তি নেই। বাল্যকালেই তিনি হরিদাস ঠাকুরের সঙ্গলাভ করেন-
"রঘুনাথ দাস বালক করে অধ্যয়ন ।
হরিদাস ঠাকুরে যাই করয়ে দর্শন ॥”
সংসারের প্রতি তাঁর নিতান্ত অনাসক্তি লক্ষ্য করে চিন্তিত মাতা-পিতা তাঁকে সংসারী করার উদ্দেশ্যে একটি অতীব সুন্দরী কিশোরী কন্যার সঙ্গে তাঁর বিয়ে দিয়ে দেন—কিন্তু তৎসত্ত্বেও তাঁকে সংসারী করা গেল না। বারবার তিনি গৃহত্যাগ করার চেষ্টা করেন, কিন্তু পুনরায় তাকে ধরে নিয়ে আসা হয়। চৈতন্যদেব রামকেলি যাবার পথে যখন শান্তিপুরে অদ্বৈত আচার্যের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন কিশোর রঘুনাথ তখন মহাপ্রভুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যান। সন্ন্যাস নেবার পর মহাপ্রভু দু'বার শাস্তিপুরে এসেছিলেন, দু'বারই রঘুনাথ পিতা-জ্যেঠার অনুমতি নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। কিন্তু মহাপ্রভু বুঝেছিলেন যে, রঘুনাথের তখনও সংসার ত্যাগের সময় হয়নি। সেইজন্য দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ করতে গেলে মহাপ্রভু তাঁকে উপদেশ দিয়েছিলেন—
“মর্কট বৈরাগ্য না কর লোক দেখাইয়া।
যথাযোগ্য বিষয়-ভুঞ্জ অনাসক্ত হইয়া ॥”
এদিকে পিতা-জ্যেঠাও রঘুনাথকে প্রহরীবেষ্টিত করে রাখেন। রঘুনাথ মহাপ্রভূর উপদেশে বাড়ি ফিরে যথারীতি কাজকর্ম করতে থাকেন। তরুণী স্ত্রীর সঙ্গ ত্যাগ করে বহিবাটীতেই বসবাস শুরু করেন। ইতিমধ্যে খবর পেয়ে পানিহাটিতে নিত্যানন্দের কাছে উপস্থিত হন। শ্রীনিত্যানন্দ কৃপা করে তাঁর চিঁড়া মহোৎসব অঙ্গীকার করলেন এবং বললেন—“শীঘ্রই তুমি নীলাচলে যাইতে সমর্থ হইবে। প্রভু তোমাকে স্বরূপ দামোদরের হস্তে অর্পণ করিবেন।' এদিকে মাতাপিতা তাঁকে সবসময় চোখে চোখে রাখেন, পাছে তিনি পালিয়ে যান। তাই রথযাত্রার পূর্বে গৌড়ীয় ভক্তগণ পুরীধামে মহাপ্রভুর সঙ্গে মিলিত হবার জন্য যখন যাত্রা করলেন তখন ধরা পড়ার ভয়ে রঘুনাথ তাঁদের সঙ্গে যেতে পারলেন না। অবশেষে একদিন গৃহত্যাগের সুযোগ এল। সতর্ক রক্ষীদের দৃষ্টি এড়িয়ে, নীলাচলগামী ভক্তদের সঙ্গ ছেড়ে অচেনা-অজানা পথে একা প্রায় অভুক্ত অবস্থায় বারো দিন পরে তিনি নীলাচলে উপস্থিত হলেন। চৈতন্যদেব, তাকে পেয়ে পরম প্রীত হলেন এবং স্বরূপ দামোদরের হস্তে তাঁকে অর্পণ করলেন। স্বরূপ দামোদরের কাছেই তার শুরু হল অধ্যাত্মসাধনা ও শাস্ত্রশিক্ষা। কারণ সাধ্য-সাধন তত্ত্ব ও বৈষ্ণবদর্শনে স্বরূপ দামোদর অপেক্ষা আর কারও বেশি অধিকার ছিল না।
স্বরূপ দামোদরের কাছে বৈষ্ণবধর্ম-তত্ত্ব ও দর্শন শিক্ষা করলেও রঘুনাথ মহাপ্রভুর কাছ থেকে কিছু উপদেশ প্রার্থনা করলে তিনি তাঁকে সংক্ষেপে 'শিক্ষাষ্টক'-টি বললেন। রঘুনাথের বৈরাগ্য এক অপূর্ব বস্তু। আবাল্য ঐশ্বর্যলালিত ধনীর একমাত্র সন্তান প্রাণধারণের জন্য নীলাচলে কিছুদিন রাত্রি দশ দণ্ডের পরে জগন্নাথ মন্দিরের সিংহদ্বারে পাঁড়িয়ে থাকতেন। তখন কেউ মহাপ্রসাদাদি দিলে তাই খেয়ে প্রাণধারণ করতেন। পরে আর সিংহদ্বারেও না দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করে খেতেন। শেষে ভিক্ষা করাও ছেড়ে দিলেন, দু'তিন দিনের পরিত্যক্ত অন্ন-ব্যঞ্জন পসারীরা ফেলে দিলে তাই কুড়িয়ে এনে ধুয়ে নুন দিয়ে মেখে খেতেন—বাকী সময় শুধু ঈশ্বর চিন্তা ও নামগানে মত্ত হয়ে থাকতেন। দীর্ঘ ষোল বছর মহাপ্রভুর অন্তরঙ্গ সেবা করার সৌভাগ্য তাঁর হয়েছিল। মহাপ্রভু রঘুনাথকে 'গুপ্তামালা' ও 'কৃষ্ণশীলা' দান করেছিলেন। তিনি রঘুনাথকে উপদেশ দিয়েছিলেন—
“অমানী মানদ কৃষ্ণ-নাম সদা লবে ।
ব্রজে রাধাকৃষ্ণ সেবা মানসে করিবে ॥”
চৈতন্যদেব ও স্বরূপ দামোদরের তিরোধানের পর রঘুনাথ বৃন্দাবনে গিয়ে প্রাণত্যাগ করতে চাইলে রূপ-সনাতন তাঁকে নিরস্ত করেন। যাই হোক্, রূপ-সনাতনের সাহচর্যে তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আদর্শ সন্ন্যাসীর ন্যায় দিনাতিপাত করেছিলেন। এই সময় কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁর সঙ্গ ও সেবা করার সুযোগ পেয়েছিলেন, হয়তো এই সময়েই কৃষ্ণদাস তাঁর কাছ থেকে মহাপ্রভুর জীবন ও বাণী এবং তত্ত্বকথাদি শুনে থাকবেন। সনাতন ও রূপের পর তাঁর লোকান্তর ঘটে। কিন্তু তাঁর জন্মাব্দ ও মরণাব্দ সঠিক ভাবে জানা যায়নি।
রঘুনাথ শুধু যে বৈষ্ণব শাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন তা-ই নয়, সংস্কৃতে রচিত তাঁর স্তব-স্তোত্র ও কবিতা বৈষ্ণব সমাজে সুপরিচিত ছিল। 'মুক্তাচরিত্র' ও 'দানকেলিচিস্তামণি' তাঁর বিখ্যাত দুটি ক্ষুদ্রকাব্য। তাঁর দানকেলিচিত্তামণি' গ্রন্থে ছন্দ এবং অলংকারের সঙ্গে আদিরস ও ভক্তিরসের সুন্দর মিলন ঘটেছে। চৈতন্যস্তবে রঘুনাথ দাস লিখেছেন- “গৌরাঙ্গো হৃদয় উদয়ন্মাং মদয়তি”— তাঁর হৃদয় মহাপ্রভুর কৃপাপরশে সর্বদা পুলকিত হয়ে আছে। ড. সুকুমার সেন তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন – “...উন্মেষে, বিকাশে ও পরিণতিতে এই চরিত্রটি আদ্যন্ত চৈতন্য ভাবপ্রণোদিত।... তাঁর ত্যাগ তপস্যার আদর্শ সর্বাধিক প্রকটিত রঘুনাথ দাসের চারিত্র্যে।” শেষ সময়ে তিনি এবং কবিরাজ গোস্বামী একসঙ্গেই রাধা কুণ্ডে বাস করতেন।
• শ্রীরঘুনাথ ভট্ট গোস্বামী :
রঘুনাথ ভট্ট মহাপ্রভুর ভক্ত শিষ্য— তপন মিশ্রের পুত্র। নির্লোভ নিরহঙ্কার এই মানুষটি সম্পর্কে কবিরাজ গোস্বামীর 'চৈতন্যচরিতামৃত' ছাড়া অন্য কোথাও বিশেষ আলোচনা নেই। সন্ন্যাস গ্রহণের পূর্বে মহাপ্রভু বঙ্গদেশ ভ্রমণ করতে গেলে তপন মিশ্র তাঁর শরণাগত হন। মহাপ্রভু তাকে 'ষোল নাম বত্রিশ অক্ষর ' মন্ত্র দান করেন। এইদিক দিয়ে তিনিই প্রথম চৈতন্যের শিষ্য। মহাপ্রভু বৃন্দাবনে যাবার এবং ফেরার পথে তপন মিশ্রের গৃহে ভিক্ষা গ্রহণ করেন। বালক রঘুনাথ সেই সময় তাঁর পরিচর্যা করবার সুযোগ ও সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন।
“ভিক্ষা করি মহাপ্রভু করিল শয়ন ।
মিশ্রপুত্র রঘু করে পাদ- সংবাহন ॥ ”
বড় হয়ে রঘুনাথ নীলাচলে চৈতন্যের কাছে এসেছিলেন। আট মাস তাকে নিজের কাছে রেখে চৈতন্যদেব তাঁকে কাশী পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এবং উপদেশের ভাষায় বললেন, বিবাহ করবে না এবং বৃদ্ধ পিতা-মাতার সেবা করবে। কাশীতে চার বৎসর থাকার পর পিতামাতার পরলোকপ্রাপ্তি ঘটলে তিনি আবার নীলাচলে ফিরে এলেন। উল্লেখ্য, তপন মিশ্র পরবর্তী জীবনে স্ত্রী-পুত্রাদি সহ কাশীধামেই বাস করতেন। এবারও চৈতন্যদেব রঘুনাথকে নিজের কাছে আটমাস রেখে মহাপ্রভু তাঁকে বৃন্দাবন যাবার নির্দেশ দিলেন।
"আমার আজ্ঞায় রঘুনাথ যাহ বৃন্দাবন।
তাহা যাই রহ যাঁহা রূপ-সনাতন ॥
ভাগবত পড় সদা লহ কৃষ্ণনাম।
অচিরে করিবেন কৃপা কৃষ্ণ-ভগবান॥”
এই বলে মহাপ্রভু তাঁকে আলিঙ্গন করে জগন্নাথদেবের প্রসাদী তুলসীর মালা তাঁর গলায় পরিয়ে দিলেন। রঘুনাথ বৃন্দাবনে এসে রূপ গোস্বামীর সভায় ভাগবত পাঠ করতেন। তিনি অতিশয় সুকণ্ঠ ছিলেন, তদুপরি সঙ্গীতেও তাঁর দক্ষতা ছিল। তাঁর ভাগবত পাঠ সকলেই মুগ্ধ হয়ে শুনতেন। তাঁর নির্লোভ প্রচার-খ্যাতিহীন বিনয়ী জীবনের প্রতিচ্ছবি কৃষ্ণদাসের রচনায় সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে—
"গ্রাম্যবার্তা নাহি শুনে না করে জিহ্বায়।
কৃষ্ণকথা পূজা দিতে অষ্টপ্রহর যায়।।
বৈষ্ণবের নিন্দাকর্ম নাহি শুনে কানে ।
সবে কৃষ্ণ ভজন করে—এই মাত্র জানে।।"
চৈতন্যচরিতামৃত রচনা শেষ হবার আগেই রঘুনাথের তিরোধান ঘটে। মৃত্যুর সময়েও তিনি মহাপ্রভুর দেওয়া তুলসীমালাটি ত্যাগ করেননি। রঘুনাথের ব্যক্তিত্বে সকলেই আকৃষ্ট হত। অনেকের ধারণা, আকবরের সেনাপতি মহারাজা মানসিংহ রঘুনাথকে গুরু বলে মানতেন এবং তাঁরই প্রীতির উদ্দেশ্যে তিনি গোবিন্দের মন্দির নির্মাণ ও সেবার ব্যবস্থা করেছিলেন।
• শ্রীগোপাল ভট্ট গোস্বামী :
গোপাল ভট্ট ছিলেন শ্রীরঙ্গ ক্ষেত্রবাসী বেঙ্কট ভট্টের পুত্র। দক্ষিণ-ভ্রমণকালে মহাপ্রভু বেঙ্কট ভট্টের গৃহে চারমাসকাল অবস্থান করার সময় গোপাল ভট্ট প্রভুর সেবা করেছিলেন। তাঁর পিতৃব্য ছিলেন প্রবোধানন্দ সরস্বতীর শিষ্য। প্রামাণিক বৈষ্ণব গ্রন্থগুলিতে গোপাল ভট্ট সম্পর্কে বিশেষ কোন তথ্য পাওয়া যায় নি। কবিরাজ গোস্বামী তাঁর চৈতন্যচরিতামৃতে তাঁকে ষড় গোস্বামীর অন্তর্ভুক্ত করলেও তাঁর সম্পর্কে বিশেষ কোন তথ্য দেননি। পরবর্তীকালে রচিত কিছু গ্রন্থে যেমন, নরহরি চক্রবর্তীর 'ভক্তিরত্নাকর', নিত্যানন্দ দাসের ‘প্রেমবিলাস', মনোহর দাসের 'অনুরাগবল্লী' প্রভৃতিতে গোপাল ভট্ট সম্বন্ধে কিছু কিছু ঘটনাবিবৃতি থাকলেও সেগুলির মধ্যেও যথেষ্ট মতপার্থক্য আছে।
ভক্তিরত্নাকরের মতে, পিতামাতার আদেশেই তাদের মৃত্যুর পরে তিনি বৃন্দাবনে এসে রূপ-সনাতনের সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। ইনিই বৃন্দাবনে শ্রীশ্রীরাধারমণ বিগ্রহের প্রতিষ্ঠাতা। নরহরি চক্রবর্তী তাঁর ভক্তিরত্নাকরে লিখেছেন, গোপাল ভট্ট নীরব সাধনা ভালোবাসতেন—কোথাও তিনি নিজেকে প্রচার করতে চাননি।
“কবিরাজ তাঁর আজ্ঞা নারে লঙ্ঘিবার।
নামমাত্র লিখে না করে প্রচার ॥”
কৃষ্ণদাস তাঁর চৈতন্যচরিতামৃতে কেন গোপাল ভট্ট সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করেন। নি—সে বিষয়ে নরহরি চক্রবর্তী যা লিখেছেন তা অবিশ্বাস করার কারণ নেই। তাঁর রাধারমণ বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা সম্পর্কেও কিছু সংস্কার প্রচলিত আছে। যেমন শ্রীশ্রীরাধারমণ ছিলেন শালগ্রাম শিলা। কোন এক সময়ে একজন ধনী ব্যক্তি রাধারমণ মন্দিরে বহুমূল্য অলঙ্কার-বস্ত্রাদি দান করেছিলেন। সে সব পেয়ে গোপাল ভট্ট ভাবলেন, এই সমস্ত বস্ত্র অলঙ্কারাদি দ্বারা তিনি কিভাবে শালগ্রাম-কে সাজাবেন। এইসব ভাবতে ভাবতেই তিনি শয়ন করতে গেলেন। পরদিন ব্রাহ্মমুহূর্তে স্নান করে শালগ্রাম জাগাতে গিয়ে দেখেন, শালগ্রামের জায়গায় কর-চরণ বিশিষ্ট অপূর্বসুন্দর এক শ্রীবিগ্রহ এবং তাঁর পৃষ্ঠদেশে শালগ্রাম এমনভাবে বিরাজিত যে দেখলেই বোঝা যায় শালগ্রাম থেকেই শ্রীবিগ্রহ আত্মপ্রকাশ করেছেন। সাম্প্রতিক সময়েও রাধারমণের গোস্বামীগণ এই বিগ্রহের সেবা করেন এবং তার পশ্চাৎ ভাগে সেই শালগ্রাম এখনও বিরাজিত।
গোপাল ভট্ট গোস্বামী বৈষ্ণবস্মৃতিগ্রন্থ শ্রীশ্রীহরিভক্তি বিলাস সঙ্কলিত করেছেন এবং সনাতন গোস্বামী তার টীকা লিখেছেন। শ্রীজীব গোস্বামী তাঁর ভাগবত সন্দর্ভে লিখেছেন—গোপাল ভট্ট প্রাচীন বৈষ্ণবদের গ্রন্থ থেকে সঙ্কলন করে একখানি তত্ত্বগ্রন্থ লিখেছিলেন কিন্তু তা সুসংবদ্ধ ছিল না। শ্রীজীব গোস্বামী পরবর্তীকালে সে সমস্ত পর্যালোচনা করে যথাযথভাবে সন্নিবেশিত করে তাঁর ভাগবত সন্দর্ভ লিখেছিলেন। এছাড়াও গোপাল ভট্টের নামে আরও কিছু গ্রন্থ প্রচলিত আছে।
গোপাল ভট্ট অত্যন্ত বিনয়ী এবং আত্মপ্রচার বিমুখ ছিলেন। অত্যন্ত নিষ্ঠাবান ও আচার বিধিনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ বলে গোপাল ভট্টই বৃন্দাবনে গোস্বামীদের মধ্যে প্রধান দীক্ষাদাতা গুরুর অধিকার পেয়েছিলেন। পরবর্তী কালের বৈষ্ণবনেতা শ্রীনিবাস আচার্য গোপাল ভট্টের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তাঁর কাছে বৈষ্ণব তত্ত্ব শিক্ষা করেছিলেন।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন