রামায়ণ ও মহাভারতের মধ্যে কোনটি আগে রচিত?

দুই মহাকাব্যের পরিচয়

রামায়ণ মহাকাব্যের ৭ টি পর্ব বা কাণ্ড। কাণ্ডগুলির নাম হল - বালকাণ্ড, অযোধ্যা কাণ্ড, অরণ্য কাণ্ড, কিষ্কিন্ধা কাণ্ড, সুন্দর কাণ্ড, লঙ্কা কাণ্ড এবং উত্তর কাণ্ড।

ভারতবর্ষের জাতীয় কাব্য বা মহাকাব্য বলতে সাধারণভাবে রামায়ণ ও মহাভারত কে বোঝানো হয়। মহাকাব্য দুটির পূর্ণাঙ্গ রূপে লাভ দীর্ঘদিন ধরে বহুজনের বিভিন্ন রচনার সন্নিবেশে। সেগুলি প্রক্ষিপ্ত বলে নির্ণীত হলেও গ্রন্থগুলিতে অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত হয়ে আছে। বলাবাহুল্য এই অংশগুলির জন্য উভয় মহাকাব্যের রচনাকাল রহস্যাবৃত। Lassen, Weber, Jacobi প্রমূখ পণ্ডিতগণ রামায়ণকে মহাভারতের পূর্ববর্তী বলে মনে করেন। অন্যদিকে ম্যাকডোনাল উইন্টার নেট প্রমূখ পণ্ডিতগণ মহাভারত কে রামায়ণের পূর্ববর্তী বলতে চেয়েছেন।

ভারতের দুই সামাজিক মহাকাব্য রামায়ণ ও মহাভারতের মধ্যে কোনটি আগে লেখা এই প্রশ্নের মীমাংসা আজও সম্ভব হয়নি সামাজিক মহাকাব্য কোন একজন কোভিদ দ্বারা কোন এক কালে রচিত হয় না তা বহু শতাব্দী ধরে বহু মানুষের দ্বারা ধীরে ধীরে পরিণতি লাভ করে কোন মহাকাব্যের পরিণত অবস্থা প্রাপ্তির আগেই ঘটেছিল সেটা আমাদের অনুসন্ধান করতে হবে।

একই সঙ্গে দুটি মহাকাব্যের উল্লেখ করতে হলে আমরা আগে রামায়ণের নাম উল্লেখ করি। রামায়ণের কবি বাল্মিকীকে আমরা আদি কবি বলি স্বভাবতই ধারণা হতে পারে রামায়ণ-মহাভারতের আগে রচিত। ঐতিহাসিকগণ উভয় কাব্যের রচনাকাল সম্পর্কে যেসব তথ্য দিয়েছেন তাতে রামায়নকেই পূর্ববর্তী বলে মনে করা হয়। তবু আমরা এ বিতর্কে না গিয়ে অনুমানের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন পন্ডিতেরা যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন সেই বিষয়েই এখন আলোচনা করব।

রামায়ণের প্রাচীনতার স্বপক্ষে যুক্তি:


১. বাল্মিকী রচিত মহাকাব্য রামায়ণকে আদি কাব্য ও বাল্মিকীকে আদি কবি বলা হয়েছে।

২. ঐতিহ্য ও পুরাণ অনুযায়ী রামচন্দ্র ত্রেতা যুগের অবতার এবং কৃষ্ণ দ্বাপর যুগের অবতার সুতরাং রাম কাহিনী সম্বলিত রামায়ণ পূর্বে রচিত।

৩. রামায়ণে বর্ণিত সভ্যতা অনাড়ম্বর সরল কুটিলতাহীন এবং অরণ্য প্রভাবিত। মহাভারতীয় চরিত্রগুলির মধ্যে নাগরিক কুটিলতা চিত্রিত হয়েছে তাই রামায়ণ মহাভারত অপেক্ষা প্রাচীন বলেই স্বীকার্য।

৪. রামায়ণে সহমরণ বা সতীদাহ প্রথার উল্লেখ নেই কিন্তু পরবর্তীকালে মহাভারতে মাদ্রীর সহমরণ বিষয় থাকার জন্য রামায়ণ পূর্বে রচিত একথা বলা যায়।

৫. রামায়ণে বর্ণিত ইক্ষাকু বংশীয় রাজাদের রাজধানী পরবর্তীকালে অযোধ্যা থেকে সাকেত নামে রূপান্তরিত হয়। এই নামের উল্লেখ রামায়ণে নেই সুতরাং যে বৌদ্ধ ও জৈনযুগে রাজধানীর এই নামান্তর হয়েছিল, রামায়ণ তার পূর্বে রচিত বলেই বিবেচনা করা হয়।

৬. রামায়ণ অপেক্ষা মহাভারতের সময় স্ত্রী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। যা পরবর্তীকালের উন্নততর সভ্যতার ইঙ্গিত বহন করে। মহাভারতে নারী চরিত্রে রাজনৈতিক চেতনা ও অন্যায়ের প্রতিবাদের কথা রয়েছে। যে কারণে মহাভারতের তুলনায় রামায়ণকে প্রাচীন বলা হয়।

মহাভারতের প্রাচীনতার স্বপক্ষে যুক্তি:


১. Winternitz উভয় মহাকাব্যের রচনাশৈলী বিচার করে মহাভারত কে প্রাচীন বলেছেন মহাভারতে দুর্যোধন উবাচ, সঞ্জয় উবাচ প্রভৃতি বলে চরিত্রকে পরিচিত করানোর রীতি দেখা যায়। রামায়ণের বর্ণনা ভঙ্গি অনেক মার্জিত

২. মহাভারতে বর্ণিত মানুষদের যুদ্ধপ্রিয়তা বেশি থাকায় তা আদিমতাকেই চিহ্নিত করে। অধ্যাপক ওল্ডেন বার্গারের মতে মহাভারতে গদ্য ও পদ্যের যে মিশ্রণ দেখা যায় তা কাব্যটির প্রাচীনতা সূচিত করে।

৩. রামায়ণে আখ্যান সরল হলেও রচনাশৈলীর দিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী কবিদের কাব্যে এই অলংকরণের প্রভাব দেখা যায়। সেই তুলনায় মহাভারতে রামায়ণের মতো রচনাশৈলীগত পারিপাট্য লক্ষিত হয় না। এজন্য মহাভারতকে প্রাচীনতর বলা যায়। 

উপসংহার:


রামায়ণ মহাভারতের মধ্যে কোনটি প্রাচীন, এই বিতর্ক শেষ হবে না। যে কাব্য দীর্ঘকাল ধরে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে তার রচনাকাল নির্দেশ করা দূরহ বলেই অনুমানের উপর ভিত্তি করতে হয়। তবুও উপরিউক্ত যুক্তিগুলি অনুসরণে বলা যায় যে রামায়ণ-মহাভারতের পূর্বেই রচিত হয়েছে।


এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কলকাতার যীশু কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা বিচার ও সংবাদধর্মীতা

মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্যের নামকরণের সার্থকতা বিচার

ঘোড়সওয়ার কবিতার সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু ও আধুনিকতার লক্ষণ