ভারতবর্ষে বহু প্রাচীন কালে নীল চাষ হত। এই নীল বিদেশে রপ্তানীও হত। ভারতবর্ষ থেকে রপ্তানী হত বলে ইউরোপে নীলের আরেক নাম দেওয়া 'ইণ্ডিগো'। এই নামকরণের সঙ্গে মিশে আছে নীল উৎপাদনকারী দেশ হিসাবে ভারতবর্ষের নাম। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে নীলচাষের প্রচলন ছিল। এই নীলের প্রধান ক্রেতা ছিল ইউরোপ। ইউরোপে কাপড়ের কল প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে নীলের চাহিদা নিদারুণ ভাবে বেড়ে যায়।
ভারতবর্ষে আগে নীল চাষ হত পাঞ্জাবে ও উত্তর প্রদেশের আগ্রায়। বাংলায় নীলচাষ হতে শুরু হয় খ্রীষ্টীয় অষ্টাদশ শতকে। তারপর থেকে নীলচাষের অগ্রণী ভূমিকায় চলে যায় বাংলা। ঘটনাটি কৌতূহলোদ্দীপক।
পঞ্চদশ শতকে ইউরোপের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ায় পর্তুগাল, হল্যাণ্ড, ফ্রান্স, ইংলণ্ড থেকে দলে দলে বণিকেরা এদেশে আসাস শুরু করে। এরা এদেশের নীল ইউরোপে নিয়ে গিয়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করত। ব্যবসার স্বার্থেই এরা এদেশে রাজত্ব স্থাপনের স্বপ্ন দেখা শুরু করে। এই ব্যাপারে সফল হয় ইংলণ্ডের বণিকেরা। ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দের পলাশীর যুদ্ধে জয়ী হয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী বাংলা বিহার উড়িষ্যার শাসনভার পেয়ে যায়। তার ফলে বণিকের মানদণ্ড পরিণত হয় রাজদণ্ডে। এরপরই এরা এদেশে নীলকুঠি স্থাপন করে নীল চাষ শুরু করে। এর জন্য বহু নীলকর ইংরাজকে নীলচাষের আইন সম্মত সুযোগ দেওয়া হয়। এ দেশীয় জমিদার ভূস্বামীরা আগেই নীল চাষে এগিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু ইংরেজ বণিকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় জমিদারেরা ক্রমশ হঠে যেতে থাকেন।
১৮৩৩ খ্রীষ্টাব্দে চার্টার অ্যাক্ট পাশ হওয়ায় এদেশে ইউরোপীয় তথা ইংরাজদের বসবাসের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এই আইনের বলে বহু ইংরাজ এদেশে জমি কিনে বা দখল নিয়ে বসবাস শুরু করে। এরা অধিকাংশই অভদ্র পরিবারের মানুষ। ব্যক্তিগতভাবেও এরা ছিল ধূর্ত স্বার্থপর এবং হিংস্র। এই নবাগত ইংরাজ সম্প্রদায়ের মানুষের নজর ছিল নীলচাষে।
বাংলার নীলচাষ শুরু হবার সময় থেকেই চাষীদের উপর অত্যাচার চলতে থাকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্বার্ধে যখন লর্ড মিন্টো ভারতবর্ষের গভর্নর জেনারেল তখনই অভিযোগ ওঠে নীলকরগণ প্রজাদের উপর অকথ্য উৎপীড়ন চালায়। এই উৎপীড়নের তালিকায় আছে গুদামে প্রজাদের ধরে এনে আটকে রাখা, তাদের গরু বাছুর ধরে এনে আটকে রাখা, বেতের বাড়ি মারা এবং প্রজাদের বাড়ির মেয়েদের উপর পাশবিক আচরণ প্রভৃতি। এছাড়া নীলকরেরা প্রজাদের উপর নীলের 'দাদন' চাপিয়ে দিত। 'দাদন' হল নীলচাষের জন্য চাষীদের অগ্রিম অর্থ প্রদান। এই দাদন নেওয়ার নিহিত অর্থ হল প্রজা তার জমিতে নীল ছাড়া আর কোন ফসল ফলাতে পারবে না। পক্ষান্তরে যে চাষী একাই নীলের দাদন নিয়েছে, তার আর নীলকরদের হাত থেকে বেরিয়ে আসার কোনও উপায় নেই। পুরুষানুক্রমে তাকে নীলচাষ করতে বাধ্য থাকতে হবে। গভর্নর জেনারেল লর্ড মিন্টো জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের কাছে প্রেরিত একটি আদেশে জানিয়ে দেন যে, যদি কোন নীলকর সাহেবের দ্বারা চাষীদের উপর 'দাদন' চাপিয়ে দেওয়ার বা নীলচাষ সংক্রান্ত জুলুম চালানের অভিযোগ আসে তবে তার যথাযথ তদন্ত করে যেন শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। লর্ড মিন্টোর এই সদিচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া হয়নি। তার কারণ নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার এবং অভিযোগ প্রমাণের কোনও সুযোগ বা সাহস ছিল না প্রজাদের। তাছাড়া অধিকাংশ বিচারক এবং ম্যাজিস্ট্রেট ছিল নীলকর সাহেবদের দেশের লোক এবং বন্ধু। নীলকর সাহেবরা তাদের স্বার্থেই ঐ সব ম্যাজিস্ট্রেট ও বিচারকদের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিয়েছিল। অতএব লর্ড মিন্টোর
সদিচ্ছা সরকারী আদেশেই আবদ্ধ ছিল। ১৮২৩ খ্রীষ্টাব্দে পাশ হয় ষষ্ঠ আইন যাকে Regulation VI বলে। এতে বলা হয়, যে-চাষীরা একবার নীলকর সাহেবদের কাছ থেকে দাদন নিয়েছে সেই সব চাষীদের জমির উপর নীলকরদের বিশেষ স্বত্ব থাকবে। ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দে জারি করা পঞ্চম আইনে | Regulation 1830) বলা হয়, দাদন গ্রহণ করা চাষীরা নীলচাষে অসম্মত হলে তারা দণ্ডযোগ্য অপরাধ করেছে বলে ধরে নেওয়া হবে। এই দণ্ড বলা বাহুল্য কারাদণ্ড। নীলকরদের জোরজবরদস্তি তার ফলে বাড়তে থাকে। তাতে নীলচাষীর প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছিল। তাদের আদালতে যাবার পথ খোলা থাকলেও এই পথ ছিল দুর্গম। কোনক্রমে সেই পথ অতিক্রম করে আদালতে পৌঁছাতে পারলেও সুবিচারের আশা ছিল সুদূরপরাহত। কারণ, অধিকাংশ আদালতে হাকিমেরা ছিল নীলকর সাহেবের বন্ধু। অভিযোগের তদন্ত করতে এসে ম্যাজিস্ট্রেটগণ নীলকর সাহেবদের কুঠিতেই এসে উঠতেন। তার ফলে অসহায় উৎপীড়িত চাষীরা সুবিচারও পেত না। এবং নালিশ জানানর অপরাধে তাদের কপালে জুটত অশেষ লাঞ্ছনা।
নীলকর সাহেবরা অতি অল্প পুঁজি নিয়ে নীল ব্যবসায়ে নেমে অল্পদিনের মধ্যে অধিক লাভের মুখ দেখতে পেত। সেই অর্থ নীলকর সাহেবরা পাঠাত ইংলণ্ডে। কারোর মতে ইংলণ্ডে যে শিল্প বিপ্লব ঘটেছিল তর অধিকাংশ অর্থ সরবরাহ করা হয়েছিল নীলচাষের ব্যবসায়ের মাধ্যমে।
বাংলা অসহায় নীলচাষীদের দুঃখ দুর্দশার ছবি প্রকাশিত হতে শুরু করে তৎকালীন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। এই পত্রিকাগুলির মধ্যে অন্যতম হল সিংবাদ প্রভাকর' 'সম্বাদ ভাস্কর “তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা' এবং 'হিন্দু পেট্রিয়ট'। হিন্দুপেট্রিয়ট পত্রিকা প্রথম প্রকাশিষ হয় ১৮৫৩ খ্রীষ্টাব্দের ৬ জানুয়ারি। সম্পাদক ছিলেন সাংবাদিক কেশরী হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। তিনি তার পত্রিকায় নীলচাষীদের স্বার্থ সুরক্ষার জন্য মনোযোগী হন। গ্রাম বাংলার চাষীদের দুর্দশার চিত্র তাঁর পত্রিকায় তুলে ধরার জন্য হরিশচন্দ্র বেশ কয়েকজন তরুণ নির্ভীক সাংবাদিক নিয়োগ করেন। এই সাংবাদিকদের একজন হলেন শিশিরকুমার ঘোষ এবং অন্যজনের নাম মনোমোহন ঘোষ। শিশিরকুমার অমৃতবাজার পত্রিকা প্রকাশ করে বিখ্যাত হন। মনোমোহন ঘোষ ইণ্ডিয়ান মিরর' পত্রিকার সম্পাদনা করতেন। পরে অবশ্য তিনি সম্পাদনাকর্ম ছেড়ে দিয়ে আইন ব্যবসায়ে অবতীর্ণ হয়ে প্রচুর খ্যাতির অধিকার হন।
হিন্দুপেট্রিয়ট পত্রিকায় নীলকর সাহেবদের অমানবিক এবং অবিশ্বাস্য অত্যাচারের বিবরণ প্রকাশিত হতে থাকে। ইংরেজ প্রশাসকরা এইসব সংবাদে বিশেষভাবে বিচলিত হতে থাকে। মানবতাবাদী ইংরেজরা নীলকরদের অত্যাচারের হাত থেকে প্রজাদের বাঁচাতে সক্রিয় হন। কিন্তু তাঁদের সংখ্যা খুবই সীমিত। অধিকাংশ ইংরেজ প্রশাসক নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনী প্রকাশের জন্য হিন্দুপেট্রিয়টের উপর রুষ্ট হয়। কিন্তু হরিশচন্দ্র তাঁর ব্রতানুষ্ঠান থেকে সরে যাননি।
বাংলায় নীল ব্যবসা বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে। জেমস্ হিলসের মালিকানায় নদীয়া জেলায় এগারটি নীলকুঠি স্থাপিত হয়। আর সর্বাপেক্ষা বিশাল নীল ব্যবসার মালিক ছিল বেঙ্গল ইণ্ডিগো কোম্পানী। এটি ছিল একটি যৌথ প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের কুঠিগুলি ছিল নদীয়া, মুর্শিদাবাদ ও বারাসতের বিভিন্ন প্রান্তে। পূর্ববঙ্গের নীল ব্যবসায়ের মালিক ছিল জে. পি. ওয়াইজ। এছাড়া কিছু নীলকুঠি ব্যক্তিগত মালিকানায় চালু ছিল। এদের মালিক ইউরোপীয়রা। এক একটি নীল ব্যবসায়ী সংস্থা, যাকে ইংরেজিতে বলা হয় 'Concern' একসঙ্গে ৫ থেকে ১০টি নীলকুঠি চালাত। উক্ত কুঠিগুলি চালাত ম্যানজোরগণ। এই ম্যানেজারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দুটি নাম হল রবার্ট টি লারমুর এবং জেমস্ ফোরলং। লারমুর ছিল বেঙ্গল ইণ্ডিগো কোম্পানীর অধীনস্থ বহুকুঠির ম্যানেজার। আর ফোরলং ছিল জেমস্ হিলসে-র কোম্পানীর কুঠিগুলির ম্যানেজার। এরা দুজনে ছিল বাংলার অসংখ্য অসহায় কৃষকের ভাগ্যবিধাতা। ফোরলং যদিও প্রজাদের সঙ্গে মানিয়ে গুছিয়ে চলার চেষ্টা করত কিন্তু লারমুর ছিল নৃশংস। 'নীলদর্পণ' নাটকে বর্ণিত বিখ্যাত শ্যামচাদ রামকান্ত নামের বেতের আবিষ্কর্তা ছিল লারমুর। লারমুরের কুঠির অত্যাচারের পটভূমিকাই উঠে এসেছে নীলদর্পণ নাটকে।
১৮৫৯ সালের মধ্যবর্তী সময়ে শুরু হল নীল বিদ্রোহ। প্রথমে এই বিদ্রোহ দেখা দেয়। যশোহর জেলার কাঠগোড়ানীলকনসার্ণের (Concern) সংযুক্ত গ্রামে। বলাবাহুল্য এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন নড়াইলের জমিদার রামরতন রায়, মহেশ চট্টোপাধ্যায়, মোরাদ বিশ্বাস, সুহাস বিশ্বাস, লালচাঁদ সাহা, সাধুহাটির মথুরা আচার্য রতন মণ্ডল, চৌগাছার দিগম্বর ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস, রামমোহন, রামরতন ও গিরিশ মল্লিক, যশোহরের জলুয়ামাগুরার শিশিরকুমার ঘোষ, বাঁশবেড়িয়ার বৈদ্যনাথ ও বিশ্বনাথ সর্দার।
প্রশ্ন জাগে জমিদাররা কেন নীল বিদ্রোহে অংশ নেয়? চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে যে- জমিদার সমাজের উদ্ভব ঘটে, এই সব জমিদার ছিল ইংরেজ শাসকের কাছের লোক। ১৮১৯ খ্রীষ্টাব্দে পাস হওয়া অষ্ট আইনে (Regulation 8) জমিদারদের পত্তনী মূলক বন্দোবস্ত করার অধিকার দেওয়া হয়। তার ফলে এক এক পরগণায় সৃষ্টি হয় অসংখ্য তালুক। জমিদাররা ইংলণ্ড থেকে আসা ইংরেজদের বড় বড় সব পনী দেওয়া শুরু করেন। পত্তনী পেয়ে নীলকর সাহেবরা হয়ে উঠল এক একজন জমিদার। সরকারী প্রশাসন যন্ত্র এই সব নীলকর সাহেবের অনুকূলে চলে গেল। তাদের নিজস্ব লাঠিয়াল জেলখানা এবং শাসন ব্যবস্থা রচিত হল। তারাই নীল ব্যবসায়ে বাংলার জমিদারদের ছাড়িয়ে গেল। জমিদাররাও নীলকরদের অত্যাচারের মুখোমুখি হলেন। অতএব তাঁরাও বিদ্রোহে সামিল হলেন।
খ্রীষ্টান পাদরীরা নীলকর সাহেবদের অত্যাচার দূর করতে উঠে পড়ে লাগেন। তাঁরা এদেশে এসে গ্রাম বাংলার হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বহু বাঙালীকে খ্রীষ্টানধর্মে দীক্ষিত করার ব্রত নেন। কিন্তু নীলকরদের অত্যাচারে জর্জরিত গ্রামের অসহায় বাঙালী জনসাধারণ খ্রীষ্টান পাদরীদেরও সুনজরে দেখেনি। অতএব পাদরীরাও নীলকরদের বিরোধিতায় নীলবিদ্রোহীদের সামিল হন।
নীলবিদ্রোহ শুরু হবার দুবছর আগে আবির্ভাব ঘটে সিপাহী বিদ্রোহের। সেই বিদ্রোহ দমনে সঙ্গে সঙ্গে দেখা দেয় নীলবিদ্রোহ। ইংরেজ শাসকরা স্বভাবতই বিভ্রান্ত হন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় তৎকালীন বাংলার গভর্নর হ্যালিডে তাঁর স্বদেশবাসী নীলকরদের শাস্তিদানে তৎপর হন নি। তার জন্য অবশ্য তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ দ্বারা তিরস্কৃত হন। শুধু তাই নয় তাঁকে বদলীও করা হয়। তাঁর জায়গায় আসেন লে: গভর্নর গ্রান্ট। তিনি সবসময়ই নীলকরদের অত্যাচারের হাত থেকে চাষিদের বাঁচাতেই চাইতেন।
১৮৫৫ খ্রীষ্টাব্দে বারাসতের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জে. এইচ. ম্যাঙ্গলেস নীলচাষীদের স্বার্থ সুরক্ষার জন্যে সচেষ্ট হওয়ায় তাঁকে বদলী করে তাঁর জায়গায় আনার ব্যবস্থা করেন এশলী ইডেনকে। ইডেন যেমন ছিলেন দক্ষ প্রশাসক তেমনি ন্যায় বিচারের পক্ষপাতী। ইডেন তাঁর নতুনপদে যোগদানের পর খুব শীঘ্রই নীলকরদের বিরাগ ভাজন হন। কারণ, বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে নীলকর সাহেব ও নীলচাষীদের বিরোধে তিনি নীলচাষীদের পক্ষে রায় দেন। নীলকর সাহেবরা তৎকালীন নদীয়া বিভাগের কমিশনার আর্থার গ্রোট-এর কাছে ইডেনের বিরুদ্ধে নালিশ করে। গ্রোট ইডেনকে তাঁর চাষীর পক্ষে দেওয়া রায় পাল্টে দিতে বলেন। কিন্তু ইডেন এই অনুরোধ রক্ষা করতে অসম্মত হন। শুধু তাই নয় তিনি নীলকরদের এই বলে সতর্ক করে দেন, চাষীদের দিয়ে নাল চাষ করাতে হলে, চাষীরা যেন উপযুক্ত পারিশ্রমিক পায়। ইডেনের এই অনুরোধ রক্ষিত হচ্ছে না দেখে তিনি একটি নতুন আদেশ জারি করেন। তাতে বলা হল, কোনও চাষীকে নীল চাষে বাধ্য করা চলবে না। এই আদেশ জারীকে বলা হত ‘বোরকারী’। বোরকারী জারীর কথা বারাসতের চারিদিকে প্রচারিত হয়। চাষীরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। কিন্তু পূর্বকথিত নীলকোম্পানীর ম্যানেজার লারমুর ইডেনের সঙ্গে দেখা করে উল্লিখিত আদেশ প্রত্যাহার করে নিতে অনুরোধ করে। কিন্তু ইডেন লারমুরের অনুরোধ রক্ষা করেন নি।
তৎকালীন লেঃ গভর্নর গ্রান্টও নীলচাষীদের পক্ষে রায় দিতেন। গ্রান্ট ও ইডেনের মনোভাবের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। নীলকর সাহেবদের অত্যাচার দূর করার প্রয়াসের খবর বাংলার চারিদিকে দাবানলের মতো ছড়াতে থাকে। যশোহর নদীয়া মুর্শিদাবাদ পাবনা ঢাকা মৈমন সিংহ প্রভৃতি অঞ্চলের চাষীরা বিদ্রোহে সংঘবন্ধ হয়। এই বিদ্রাহ দমনের জন্য নীলকর সাহেবরাও তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে। ফলে বাঁধে তীব্র সংঘাত। তার ফলে বাংলার গ্রামে গ্রামে লেগে যায় লাঠা লাঠি খুন জখম, নারী অপহরণ, নারী লাঞ্ছনা, জোর করে জমিতে নীলচাষের জবরদস্তি। এই সব ভয়াবহ নৃশংসতার সংবাদ বিশ্বস্ততার সঙ্গে প্রকাশিত হতে থাকে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকায়। তার জন্য হরিশচন্দ্র ব্যায় করেন তাঁর অর্থ, শ্রম ও মূল্যবান সময়। ১৮৫৮ রচিত প্যারীচাঁদ মিত্রের 'আলালের ঘরের দুলাল' গ্রন্থে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের নিখুঁত বর্ণনা প্রদত্ত হয়েছে। নীলবিদ্রোহ সংঘটিত হবার ঠিক এক বছরের মাথায় ১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দের ১২ ফেব্রুয়ারী কাচিকাটা কুঠির ম্যানেজার অর্কিবল্ড হিলস্ তার কুঠিসংলগ্ন একটি গ্রামের গৃহবধূ হরমণিকে পুকুর ঘাট থেকে তার লাঠিয়ালের সাহায্যে তুলে এনে কুঠিতে রেখে দেয়। হরমণি ছিল সুশ্রী এবং সুন্দরী। হরমণির গ্রামের মধ্যে দিয়ে যাবার সময় হিলস্ হরমণিকে দেখতে পায় এবং তার রূপে আকৃষ্ট হয়ে তাকে অপহরণের ব্যবস্থা করে। হরমণির শ্বশুর মধুর বিশ্বাস নদীয়ার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হার্সেলের কাছে অর্কিকন্ড হিলসের নামে অভিযোগ দায়ের করে। কিন্তু উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে মধুর বিশ্বাসের অভিযোগ খারিজ হয়ে যায়।
নীলবিদ্রোহকে কেন্দ্র করে যখন গ্রামবাংলার চারিদিকে হাহাকার অত্যাচার জোর জবরদস্তি চূড়ান্ত পর্যায়ের পৌঁছে যায় তখন সরকার নীলচাষ প্রথা সম্বন্ধে অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে একটি কমিশন বসানর প্রস্তাব করে। এই প্রস্তাব অনুসারে ১০ মে ১৮৬০ প্রস্তাবিত নীলকমিশন বসান হয়। সরকারের তরফে কমিশনের সদস্য নিযুক্ত হন তৎকালীন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী সেটনকার (Mr. W. S. Seton Ker) এবং রিচার্ড টেম্পল 'Richard Temple"। সেটনকার উক্ত কমিশনের সভাপতি মনোনীত হন। নীলকমিশনের আর যেসব সদস্য হন তাঁরা খ্রীষ্টান পাদরীদের প্রতিনিধি রেভাঃ সেইল, নীলকর সমিতির প্রতিনিধি ফার্গুসন, ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান এ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধি চন্দ্রমোহন চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি। নীলকমিশন গঠনের ৩ মাসের মধ্যে অনুসন্ধানের রিপোর্ট সরকারের কাজে জমা দেওয়া হয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য ১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দে প্রবর্তিত হয় বিখ্যাত একাদশ আইন (Act XI 1860) এই আইনে বলা বৈধভাবে যেসব চুক্তি করা হয় চলতি বছরে সেই অনুসারে সরাসরি বিচারের ব্যবস্থা থাকবে এবং কেউ যদি ভয় দেখিয়ে চুক্তি ভঙ্গ করতে ও ফস নষ্ট করতে বাধ্য করে সে দণ্ডিত হবে। এই আইন জারির মুখ্য কারণ প্রজা বিদ্রোহ জনিত, গ্রামে গ্রামে খাজনা বন্ধের ডাক। এই ডাকে সাড়া দেয় গ্রামের সর্বস্তরের মানুষ। সরকার সিপাহী বিদ্রোহ নেভানোর সঙ্গে সঙ্গে নতুন করে আর সঙ্কট সৃষ্টি করতে উৎসাহী ছিল না। ঐ একাদশ আইনে নীলকমিশন বসানর প্রস্তাব ছিল। এই প্রস্তাবানুসারে রিপোর্ট প্রজা সাধারণ স্বস্তি অনুভব করায় উক্ত রিপোর্ট প্রকাশের পর ঐ বছরের অক্টোবর মাসে একাদশ আইন প্রত্যাহৃত হয়। বাধ্যতামূলক নীলচাষ বন্ধ হয়। চাষীর মনে আনন্দে চাষ করার সুযোগ পেয়ে খুশি হয়েছিল। বাংলার সাধারণ চাষীরা হিন্দু পেট্রিয়ট সম্পাদক হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের প্রতি জানিয়েছিল আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। হরিশচন্দ্রই দিনের পর দিন নিদারুণ ঝুঁকি নিয়ে নীলকরদের নানা অত্যাচারের কাহিনীর তথ্যভিত্তিক বিবরণ ছেপেছেন তার পত্রিকায়। তাই গ্রামবাংলার অজ্ঞাত কবি হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়কে স্মরণ করে গান বেঁধেছিল—
“ভাসছে মন মনের হরিখে
আগে লুটে খেত এক হরিসে
এখন বাঁচালে এক হরিশে
বুনে বুনে নীল জমি হল খিল
(এখন) হতেছে তাই অড়র কলাই সরিষে।”
গানটিতে উল্লিখিত একাদশ আইনের প্রত্যাহারের স্বস্তির আনন্দ প্রকাশ হয়েছে। গানটি তাই নানা কারণে ঐতিহাসিক। ১৮৬০ খ্রীষ্টাব্দ গ্রাম বাংলার চাষীদের মুক্তির বছর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় নীল কমিশনের রিপোর্টে নীলচাষ বন্ধের কোনও সুপারিশ করা হয়নি। ফলে নীলকর ও তৎকালীন জমিদারদের নীলচাষের প্রতি আগ্রহ থেকেই গেল।
১৮৬০ সালের অক্টোবরে যখন উল্লিখিত একাদশ আইন প্রত্যাহৃত হল তখন ঐ বছরের শরৎকালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় 'নীলদর্পণ নাটক'। প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় লেখকের নামের উল্লেখ নেই। শুধু লেখা ছিল “নীলকর বিষধর দংশন-কাতর প্রজানিকর-ক্ষেমঙ্করেণ কেনচিৎ পথিকেনাভি প্রণীতম্।” অবশ্য পরবর্তী সংস্করণে তার জায়গায় লেখা হয় “কস্যচিৎপথিকসা”। অর্থাৎ 'জনৈক পথিক' ছদ্ম নামে নীলদর্পণ প্রকাশিত হয়। এই নাটকের নাট্যকার যে দীনবন্ধু মিত্র তা কিন্তু তখন প্রকাশ পায়নি। তবে আকারে ইঙ্গিতে প্রকাশ পেয়ে ছিল যে, দীনবন্ধু মিত্রই সেই 'জনৈক পথিক। ২৯ জুন তারিখের 'হরকরা' পত্রিকায় প্রকাশিত একটা সংবাদে লেখা হয় : "At any rate as we are aquuainted with the name of this 'friend of poor and needy' keep an eye upon the appointments and promotions in connection with the post-office and you may be edificed some morning."
'Friend of poor and needy' যে দীনবন্ধু তা জানা গেল এবং তিনি যে ডাকঘর- এর কাজের সঙ্গে যুক্ত তাও জানা গেল। আশ্চর্যের বিষয় এই নাটক রচনার পরও দীনবন্ধু মিত্র আরও ১২/১৩ বছর ডাকঘরের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু তাঁকে এই নাটক লেখার জন্য হেনস্থা হতে হয়নি।
যাই হোক নীলদর্পণ প্রকাশের পর নীলকরদের অত্যাচারের নিষ্ঠুর রূপ সর্বসাধারণের মনে রেখাপাত করে। নীলদর্পণ-এর ব্যাপক প্রচারের উদ্দেশ্য প্রজাহিতৈষী পাদরি জেমস্ লঙ, নাটকটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন। অনুবাদক হিসাবে কোনও ব্যক্তি বিশেষের নামের উল্লেখ করা হয় নি। শুধু লেখা হয়েছিল “By a native"। এই ‘native' কে তাই নিয়ে অনেক জল্পনা কল্পনা হয়েছে। অনেকের মতে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত নীলদর্পণের ইংরেজি অনুবাদক। বঙ্কিমচন্দ্রই খুব সম্ভব এই তথ্য প্রথম পরিবেশন করেছেন। তিনি তাঁর “রায় দীনবন্ধু মিত্র বাহাদুরের জীবনী ও গ্রন্থাবলীর সমালোচনা” শীর্ষক প্রবন্ধে এ সম্পর্কে লিখেছেন, ইহার প্রচার করিয়া লং সাহেব কারাবদ্ধ হইয়াছিলেন; সীটনকার অপদস্থ হইয়াছিলেন। ইহার ইংরাজি অনুবাদ করিয়া মাইকেল মধুসূদন দত্ত গোপনে তিরস্কৃত ও অবমানিত হইয়াছিলেন এবং শুনিয়াছি শেষে তাঁহার জীবন নির্বাহের উপায় সুপ্রিম কোর্টের চাকুরী পর্যন্ত ত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।”
সাম্প্রতিককালের গবেষণায় জানা গেছে মধুসূদন নীলদর্পণের অনুবাদক নন। উল্লিখিত “native' অনুবাদক অন্য কেউ। বঙ্কিমচন্দ্র অন্যের মুখের কথায় বিশ্বাস করে উপরের মন্তব্য করেছিলেন। তিনি সেই কথার সত্যতা যাচাই করেননি। তবে পারি লং এক বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাঁর একশত টাকা আর্থিক জরিমানা হয়। যেদিন বিচারের রায় প্রকাশিত হয় সেদিন স্বয়ং কালীপ্রসন্ন সিংহ আদালতে উপস্থিত থেকে জরিমানার টাকা তৎক্ষণাং বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। সীটনকার যে অপদস্থ হয়েছিলেন তাও ইতিহাস সম্মত। কিন্তু মধুসূদন সম্পর্কে প্রদত্ত তথ্য সত্য নয়।
যাই হোক নীলদর্পণ নাটক এবং নীলকরদের অত্যাচার কাহিনী গিয়ে পৌঁছায় ইংলণ্ডেও অতঃপর অনেক আলাপ আলোচনার পর নীলচাষ বন্ধ হয়ে ১৮৬৮ খ্রীষ্টাব্দে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন