নীলদর্পণ নাটকের সংলাপ

William Henry Hudson তাঁর An Introduction To The Study of Literature গ্রন্থে 'The Study of The Drama' প্রবন্ধে নাটকের সংলাপ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন— "We may regard Dramtic dialogue as a means of characterisation under two heads; taking, first the utterances of a given person in his conversation with others, and than the remarks made about him by other persons in the play."

সংলাপ হল চরিত্রায়ণের পরিপূরক। সেই কারণেই মহামতি অ্যারিষ্টটল তাঁর গ্রন্থে নাটকের পরিকাঠামো নির্মাণে সংলাপের গুরত্বকে স্বীকার করেছেন। আজও এই গুরত্ব অনস্বীকার্য। দীনবন্ধু তাঁর নীলদর্পণ নাটকে সংলাপকে যথার্থরূপে চরিত্র দ্যোতকরূপে উপস্থাপিত করেছেন। তাঁর নাটকে তিন ধরনের চরিত্র রয়েছে— ভদ্র, ভদ্রেতর ও ইংরাজ নারী ও পুরুষ। ভদ্র চরিত্রগুলির মধ্যে নারী ও পুরুষ উভয় চরিত্রই রয়েছে। যথা গোলোকচন্দ্র বসু, নবীনমাধব বসু, বিন্দুমাধব, সাধুচরণ, সাবিত্রী, সৈরিন্ধ্রী ও সরলতা। এদের মুখে নাট্যকার যে গদ্যসংলাপ প্রয়োগ করেছেন সেই প্রয়োগ ততখানি শিল্পসম্মত হয় নি। এরা এদের আবেগ, উচ্ছ্ব দুঃখ ও যন্ত্রণা প্রকাশ করেছে যে ভাষায় সেই ভাষা চরিত্রগুলির সংকট মুহূর্তগুলিকে একট করে তুলতে পারে নি। কারণ সেই গদ্য সংলাপ এমন সাধু গদ্যে রচিত যা মুখের ভাষার আদল হতে পারে না। আর সংলাপ কখনও সাধু হয় না। আসলে দীনবন্ধু যখন নাটক লেখা শুরু করেন, তখন তার সামনে ছিল রামনারায়ণ তর্করত্নের 'কুলীনকুলসর্বঙ্গ ও মধুসূদন দত্তের 'শর্মিষ্ঠা'। এইসব নাটকের গদ্য সংলাপের আদর্শ গৃহীত হয়েছে প্যারীচাদ মিত্রের 'আলালের ঘরের দুলাল' গ্রন্থের ভাষা থেকে। এই ভাষায় লঘু চাল পরিলক্ষিত হয়। এই লঘু চালকে সংশোধিত করে প্রহসনের গদ্য সংলাপে ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু নাটকের গুরু গম্ভীর সংলাপ রচনায় যে উক্ত ভাষা অচল, সেকথা কি মধুসূদন কি দীনবন্ধু উভয়ই অনুধাবন করতে পারেন নি। তাঁরা দুজনই আলালী ভাষার লঘু চালকে মার্জিত করে যখন সে গদ্য তাঁদের প্রহসনের সংলাপে প্রয়োগ করলেন তখনই তা সাফল্য পেয়েছে। কিন্তু প্রহসন রচনায় দীনবন্ধু উল্লিখিত ভাষায় সংলাপ রচনায় পারদর্শিতা দেখাতে পারলেও নীলদর্পণের সংলাপে আলালী গদ্যের সংস্কার সাধন করে নেবার সুযোগ পান নি।

নীলদর্পণের গোলোকচন্দ্র, নবীনমাধব, বিন্দুমাধব ও সাধুচরণ চরিত্রগুলি সৎ ও আদর্শবাদী। অতএব দীনবন্ধু ধরেই নিয়েছিলেন এই চরিত্রগুলির সংলাপের ভাষা গুরুগম্ভীর সাধু গদ্যের ব্যবহারের পক্ষে উপযুক্ত। ভাষাকে বিশেষ করে নাটকের সংলাপের ভাষায় প্রত্যক্ষ বাস্তবতার নিহিত সত্যকে প্রকাশ করার ভার দিতে হয়। তার ফলে ভাষাও যেমন সাবলীল তেমনি চরিত্রগুলিও জীবন্ত হয়ে ওঠে। পাঠক বা দর্শক যখন গোলোকচন্দ্রের ও নবীনমাধবের দুঃখে কাতর হয়ে ওঠার সুযোগ খুঁজছে তখনই সাধু গদ্যের আড়ষ্টতা সেই সুযোগকে নষ্ট করে দিচ্ছে। নবীনমাধবের সংলাপ লক্ষ্য করলেই তা স্পষ্ট হয়।

দ্বিতীয় অঙ্কের তৃতীয় গর্ভাঙ্কে যখন তাইদগার, রাইয়তকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে তখন রাইয়ত নবীনমাধবকে দেখে বলে— “বড়বাবু মোর ছেলে দ্বটোরে খাতি দিওগো, মোরে, মাটেত্তে আনলে তাদের একবার দ্যাক্ তি পালাম না।”

রাইয়তের কাতর আবেদনে প্রকাশিত হয়েছে মৌখিক গদ্যে। এই সংলাপে রাইয়তের উদ্বেগ বেদনা ও যন্ত্রণা যথাযথরূপে প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু রাইয়তের আবেদনে সাড়া দিয়ে নবীনমাধব যে কথা বলেছিল, সেকথা প্রকাশিত হয়েছে অলংকৃত ধীরে লয়ের সাধু গদ্যে- “কি অবিচার। নব প্রসূতি শশারু কিরাতের করগত হইলে তাহার শাবকগণ যেন অনাহারে শুষ্ক হইয়া মরে সেইরূপ এই রাইয়তের বালকদ্বয় অন্নাভাবে মরিবে।” দুর্যোগের মুহূর্তের ভাষা এত অলংকৃত, এত ধীরলয়ের এবং এত আড়ষ্টতায় ভরা হলে নাটকীয়তা নষ্ট হয়। নাট্যকার প্রজা দুঃখে কাতর আদর্শবান চরিত্র আঁকতে বসেছেন; নাটকীয় মুহুর্তের সূক্ষ্মসংঘাত সম্পর্কে তিনি অচেতন। তৎকালীন রোমান্স রচনার আদর্শের দ্বারা দীনবন্ধু পরিচালিত হয়েছেন। তার জন্যই এই বিপত্তি।

নবীনমাধবের ক্ষেত্রে এই বিপত্তি বারবার লক্ষিত হবে। খবর এসেছে গোলোকচন্দ্রকে ইন্দ্রাবাদের কাছারিতে যেতে হবে। তাঁকে মিথ্যা মামলায় জড়ান হয়েছে। অতএব নবীনমাধবের এখন সমূহ বিপদ। পিতার দুর্গতি পুত্রের জীবনহানি ত্বরান্বিত করবে এই চিন্তায় পত্নীর জন্য দুশ্চিন্তায় কাতর হয়েছে নবীনমাধব। আপন মনে তাই বলেছে 'কুরঙ্গনয়না আমার দাবাগ্নির কুরঙ্গিনী হয়েছেন ভয়ে ভাবনার পাগলিনী প্রায়। নীলকুঠির গুদামে তার পিতার পঞ্চত্ব হয়। তার সতত চিন্তা পাছে পতির সেই গতি ঘটে। আমি কতদিকে সান্ত্বনা করিব সপরিবারে পলায়ন করা কি বিধি, পরোপকার পরম ধর্ম সহসা পরান্মুখ হব না।” এই ভাষা আলালী ভাষার আদলে কল্পিত। এই ভাষার অলংকারের প্রসাধনে ও ধীর লয়ের বিন্যাসে চরিত্রের উদ্বেগ, সক্রিয়তা ব্যাহত হয়েছে। রোগের হাতে ক্ষেত্রমণির চরম সর্বনাশের নাটকীয় মুহূর্তে নবীনমাধব তোরাপসহ কুটিতে ঘটনাস্থলে প্রবেশ করে রোগের প্রতি গালি। বর্ষণ করে বলেছে— “রে নরাধম নীচবৃত্তি নীলকর, এই কি তোমার খ্রীষ্টান ধর্মের জিতেন্দ্রিয়তা? এই কি তোমার খ্রীষ্টানের দয়া বিনয় শীলতা? আহা, আহা, বালিকা, অবলা, অন্তর্বত্নী কামিনীর প্রতি এইরূপ নির্ণয় ব্যবহারে।”

ঘটনার বিপর্যস্তরূপ ও নবীনমাধবকে বিচলিত করেছে। কিন্তু সে তো স্তব্ধ হয়ে নীলকরকে খ্রীষ্টান ধর্মের দয়া, বিনয় ও শীলতার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য আসে নি। সে এসেছে ক্ষেত্রমণিকে যত শীঘ্র সম্ভব উদ্ধার করে নিয়ে যেতে। অতএব তার পক্ষে এই বিপর্যস্ত মুহূর্তে নীলকর রোগ সাহেবকে হিতোপদেশ শোনানোর কোনও অর্থ নেই। আদর্শবাদী নবীনমাধব সেকথা অনুধাবন করতে পারল না দুঃখ সেখানে। অথচ তারই পাশে দাঁড়িয়ে তোরাপ ঝাল বিলম্ব না করে বলেছে – “সমিন্দি দেড়য়ে যেন কাটের পুতুল গোডার বাক্যি হরে গিয়েছে বড়বাবু, সমিন্দির কি এমন আছে তা ধরম কথা শোনাবে, ও ঝ্যামন কুকুর মুই তেমনি মুগুর। সমিন্দির ঝ্যামন চাবালি মোর তেমনি হাতের পোঁচা (গলদেশ ধরিয়া গালে চপেটাঘাত) ডাকবি তো জোরার বাড়ী যাবি (গলাটিপে ধরে) পাঁচদিন চোরের একদিন সেদের, পাঁচ দিন খাবালি একদিন খা (কানমলন)। "

ক্ষেত্রমণিকে একলা পেয়ে অত্যাচার করছে যে 'নরাধম নীচবৃত্তি নীলকর তাকে ধর্মকথা শোনালে যে শোনে না একথা দরিদ্র মূর্খ প্রজা তোরাপ বোঝে। এ অত্যাচারের একমাত্র উত্তর যে অত্যাচারীর গালে চপেটাঘাত ও কানমলন, সেকথা তোরাপও বোঝে। দুঃখের বিষয় নবীনমাধব সে কথা বোঝে না। ভয়ংকর অত্যাচারের সামনে দাঁড়িয়ে যেমন কুকুর তেমন মুগুরের সন্ধান করতে হয় তবেই নাটকীয় মুহূর্ত চরম দুর্গতির চেহারা স্পষ্ট করতে পারে। দীনবন্ধু ভদ্রচরিত্রগুলির ক্ষেত্রে একথা বেমালুম বিস্তৃত হয়েছেন। ফলে ভদ্রচরিত্রগুলি হয়েছে কাঠের পুতুল। সৈরিন্ধ্রী স্বামীর মৃত্যুর দৃশ্যে শোকাহত হয়েছে। কিন্তু তার শোকের প্রকাশের ভাষা বড় কৃত্রিম। আদর্শবান স্বামী তার ইহলোকে ক্লেশ ভোগ করে স্বর্গে গিয়ে পরম সুখে থাকবেন। তার ক্লেশ প্রকাশ পেয়েছে ধীর লয়ের পয়ার ছন্দে।—

দয়ার পয়োধি তুমি পতিতপাবন।
পরিণামে কর ঘ্রাণ জীবন জীবন।।”

এই পয়ার উচ্চারণে শোকের প্রকাশ ব্যাহত হয়েছে। তাতে চরিত্রের কৃত্রিমতা অনাবৃত হয়ে গিয়েছে।

বিন্দুমাধবের শোকের প্রকাশের ভাষা তৎসমবহুল সাধুভাষার প্রয়োগে কৃত্রিম এবং অনাটকীয় হয়েছে। মা সাবিত্রী উন্মত্ত অবস্থায় তার স্ত্রীকে বধ করেছেন। স্ত্রীকে হারানোর দুঃখ নিম্নোক্তভাবে প্রকাশ করেছে বিন্দুমাধব : “আহা মৃত পতিপুত্র নারীর ক্ষিপ্ততা কি সুখপ্রদ। মনোমৃগ ক্ষিপ্ততা প্রস্তর প্রাচীর বেষ্টিত শোক শার্দূল আক্রমণ করিতে অক্ষম। মা আমি তোমার বিন্দুমাধব।" বিন্দুমাধবের শোক প্রকাশের ভাষা কৃত্রিম হওয়াতে তার চরিত্রটিও হয়েছে অস্বাভাবিক। নীলের করালকর-এর কথা ভাবতে ভাবতে বিন্দুমাধব পয়ারের বেড়ার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। এই পয়ারে বর্ণিত হয়েছে বসু পরিবারের করুণ পরিণতি। কিন্তু তাতে নাটকের গাম্ভীর্য নষ্ট হয়ে গেছে। ভদ্র চরিত্রগুলির তুলনায় ভদ্রেতর চরিত্রগুলির ভাষা বড় বেশি নাটকীয় ও জীবন্ত হয়েছে। তোরাপ অবস্থা অনুযায়ী কর্মসমাধা করেছে। তাতে তার উপস্থিত বুদ্ধি, চারিত্রিক দৃঢ়তা প্রকাশ পেয়েছে। নীলকরদের সে চিনে নিয়েছিল। তাই সাহেবদের অত্যাচারের সামনে দাঁড়িয়ে অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে যেমন সে বিলম্ব করে নি, তেমনি দ্রুতগতিতে তার মনের জ্বালা ও আক্রোশ প্রকাশ পেয়েছে সাবলীলভাবে। এই প্রকাশের ভাষা রুচির সীমা লঙ্ঘন করেছে এতে কোন ভুল নেই। কিন্তু তাৎকালিক মুহূর্তের নাটকীয়তায় সেই রুচিহীনতা তার চরিত্রকে জীবন্ত করেছে। সে একজন গ্রাম্য অশিক্ষিত মুসলমান চাষী। তার রাগের ভাষায় রুচিবিগর্হিত সংলাপ মিশে থাকবে। তাতে তার চরিত্র স্বাভাবিক হবে। সাহেবরা পেরেক মারা জুতো পরে। দ্বিতীয় রাইয়তের মুখে তার ব্যখ্যা শুনতে তোরাপ রাজি নয়। সে সাহেবদের দেখে নিতে চায়। তাই সে বলে – “দুত্তোর প্যারেকের মার প্যাট করে্ লৌ দেখে গাড়া মোর ঝাঁকি মেরে ওটচে। উঃ কি বলবো, সমিন্দিরি অ্যাকবার ভাতার মারির মাটে পাই, এমনি থাপ্পোর ঝাঁকি, সমিন্দিরি চাবালিডে আসমানে উড়য়ে দেই, ওর গ্যাডম্যাড করা হের ভেতর দে বার করি।” এ ভাষা অশ্লীল রুচি বাগীশ শহুরে শিক্ষিত মানুষের কাছে। কিন্তু যে লোক অন্যায়ভাবে পেরেক মারা জুতো দিয়ে বুকে লাথি মেরে প্রজাদের রক্তপাত ঘটিয়ে দিচ্ছে, তখন তার জুতোর মহিমা কীর্তন না করে জুতোপরা লোকটাকেই মেরে দেওয়া উচিত এই হল তোরাপের চিন্তা। এই চিন্তার প্রকাশ উল্লিখিত ভাষাতেই সম্ভব। দীনবন্ধু এই তোরাপকে স্বচক্ষে দেখেছেন। তার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করার জন্য তার মুখের ভাষাকেও ঘৃণ্য করেননি।

আদুরী একজন গ্রাম্য বয়স্কা, বিধবা পরিচারিকা। তার স্বামীর স্মৃতিই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। যে বিদ্যাসাগর বিধবা বিয়ের ব্যবস্থা করেন, তাঁর প্রতি আদুরীর সমর্থন থাকতে পারে না। তাই অনায়াসে সে পারে—'সেই সাগর নাড়ের বিয়ে দেয়, ছ্যা-নাকি দুটো দল হয়েছে মুই আজাদের দলে। বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে ঐ ভাষার কেউ ঘৃণা প্রকাশ করবে না। কিন্তু আদুরী করবে। তার আর বিবাহের প্রয়োজন নেই। নাড়ের বিয়ে সে চায় না। সরলতার ছাদে গিয়ে কাপড় তোলার প্রসঙ্গে আদুরীর তির্যক রসিকতা অশ্লীলতার ইঙ্গিত করে। কিন্তু গ্রাম্য বয়স্কা বিধবা পরিচারিকার এই রসিকতা বেমানান নয়। এখানেও নাট্যকার তাঁর সহানুভূতি দিয়ে আদুরীকে এঁকেছেন।

পদী ময়রাণী কুট্টিনী ও স্বৈরিণী। দীনবন্ধু এই রকম রমণীর সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। সেইজন্য তার অপকর্মের যে বর্ণনা দিতে যেমন তাঁর বিলম্ব হয় নি বা দ্বিধা জাগে নি তেমনি তার স্ববিরোধী সত্তাকেও নাট্যকার প্রকাশ করেছেন। পদী ময়রাণী আত্মসমীক্ষায় বলেছে—“ছোট সাহেবের আর আগায় না, আমি রয়েছি কলিবুনো রয়েছে মাগো, কি ঘৃণা। টাকার জন্যে জাত জন্ম গেলে, বুনোর বিছানা ছুঁতে হলো, বড় সাহেব ড্যাকরা দ্যাকমার করেছে বলে নাকি কান কেটে দেবে ড্যাকরার ভীমরতি হয়েছে ভাতারখাগীর ভাতার মেয়ে মানুষ ধরে গুদামে রাখতে পারে, মেয়ে মানুষের পাছায় নাতি মারতে পারে, ড্যাকরার সেরকম তো একদিন দেখলাম না।"

পদী ময়রাণীর এই ভাষা তাকে স্বাভাবিক এক জীবন্ত চরিত্রের প্রকাশ ঘটাতে সাহায্য করেছে। সে ছোট সাহেবের রক্ষিতা কিন্তু রক্ষিতা হয়েও সে থাকতে চায় সাহেবের একেশ্বরী। সেখানে কলি নামের আর একটি নারীকে সে বসাতে চায় না। এখানে প্রকাশ পেয়েছে তার অন্তরের ঈর্ষা আর তাতেই চরিত্রটি স্বতন্ত্র এক দীপ্তিতে ভাস্বর হয়েছে। সাহেব তাকে রক্ষিতা করে রাখলেও সে হতে চায় সাহেবের মক্ষিরাণী। কিন্তু তার মনোবাসনা কোনদিন পূরণ হবে না। তাই রাগে ফুঁসে উঠে সে বিনা দ্বিধায় বলে 'সাহেবের আর আগায় না।' পদীর মতো শয়তানী নারীর প্রতি সহানুভূতি না থাকলে এই ভাষা প্রয়োগে দীনবন্ধু দ্বিধাবোধ করতেন।

দেখা যাচ্ছে, নীলদর্পণের ভদ্রেতর চরিত্রের তুলনায় ভদ্র নারী পুরুষ চরিত্রগুলি আড়ষ্ট ও অনেকখানি অনাটকীয় হয়ে গেছে। তার মূল কারণ ভদ্র চরিত্রগুলির মুখের সংলাপ। ভদ্র চরিত্রগুলির জীবন্ত মূর্তি দীনবন্ধু স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেন নি। তাই এই ভদ্র চরিত্র আঁকতে গিয়ে তিনি ইংরেজি ও সংস্কৃত গ্রন্থের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। তার ফলে অনুকরণ ও অনুসরণ করতে গিয়ে দীনবন্ধু ব্যর্থ হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র দীনবন্ধুর কবিত্ব আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন, “কাজেই যাহা নাই; যাহার আদর্শ সমাজে নাই, তিনি তাই গড়িতে গিয়াছিলেন। তাঁর এই প্রয়াস তাই ব্যর্থ হয়েছে। কারণ তিনি সেখানে তাঁর অন্তরের সহানুভূতি মিশাতে পারেন নি। ভদ্রেতর চরিত্রগুলির জীবন্ত মূর্তি দীনবন্ধু স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সেখানে সহানুভূতি মিশিয়ে চরিত্রগুলিকে বাস্তব ও জীবন্ত করে তুলতে তিনি ব্যর্থ হন নি।

নীলদর্পণে অনেকগুলি ইংরাজ চরিত্র আছে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য রোগ ও উড। বাংলা সাহিত্যে তথা বাংলা নাটকে তখনও ইংরাজ চরিত্র তত ব্যপকভাবে অঙ্কিত হতে শুরু করে নি। অতএব এদের মুখের সংলাপ কি হবে তা নিয়ে কোন আদর্শ গড়ে ওঠার অবকাশ পায় নি। কিন্তু এই দুই ইংরেজ চরিত্রের মুখে তিনি বসিয়েছেন এমন সংলাপ যা গ্রাম্য উচ্চারণে সমৃদ্ধ। এরা দুজনেই গ্রাম্য ইতর গালাগালি প্রয়োগ করেছে কথায় কথায়। তার সঙ্গে তারা মিশিয়েছে ইংরেজি অশ্লীল গালাগালি। ফলে চরিত্রগুলির নৃশংসা ও ইতরতা প্রকাশে বাধা হয় নি। কিন্তু প্রশ্ন জাগে এই ইংরেজ চরিত্র দুটি গ্রাম্য বাংলা ভাষার অশ্লীল গালাগালি আয়ত্ত করল কিভাবে। তাদের মুখে সবসময়ই শোনা গেছে ‘বাঞ্চৎ', 'শয়ার,'' ‘শালা,' 'নেমকহারামি’, 'ছিনলি' প্রভৃতি প্রয়োগ। এমন কি বাংলা প্রবাদও শোনা গেছে তাদের মুখে। যেমন 'শয়ারের পায়ে মুক্ত ছড়ান' ‘ছেলিয়ার বাবা হইতে ইচ্ছা প্রভৃতি। সাহেবরা কি গ্রাম্যচাষী জীবনের এত ঘনিষ্ঠ পরিচয় পেয়েছিল যাতে গ্রাম্য প্রবাদ আয়ত্ত করতে তাদের বিলম্ব হয় নি।

ইংরেজ সংশ্লিষ্ট চরিত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল গোপীনাথ দেওয়ান। গোপীনাথ জাতিতে কায়স্থ কিন্তু তার আচার ব্যবহার কৈবর্তের মতো। সে অন্নের লোভে সাহেব ভজনা করে, কিন্তু তবুও সাহেবরা তাকে কথায় কথায় চাবুক মারে অশ্লীল গালাগালি দেয়। দেওয়ানগিরি করতে গিয়ে সে যে আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিয়েছে, এ সম্পর্কে সে সচেতন। সে বলেছে— “সাত শত শকুনি মরিয়া একটি নীলকরের দেওয়ান হয় নচেৎ অগণনীয় মোজা হজম হয় কেমন করে? কি পদাঘাতই করিতেছে, বাপ! বেটা যেন আমার কালেজ আউট বাবুদের গৌনপরা মাগ।” এই সংলাপে প্রকাশ পেয়েছে সম্পূর্ণ গোপীনাথ দেওয়ান। এর দ্বারা প্রকাশ পেয়েছে তার আত্মমর্যাদা ও বংশমর্যাদাবোধ। কলেজের তৎকালীন শিক্ষা সমাপ্ত করা বাবুদের স্ত্রীরা স্বেচ্ছাচারী ছিল। তারা মেমসাহেবদের মত গাউন পরতো। তৎকালীন সমাজে এই ধরনের স্ত্রী যেমন খুব অস্বাভাবিক তেমনি সাহেবদের আচরণও তার কাছে অস্বাভাবিক লাগে। দেওয়ান চরিত্র দীনবন্ধু স্বচক্ষে দেখা। তাই এখানে তাঁর অভিজ্ঞতা ও সহানুভূতি দুই মিলে গিয়ে সম্পূর্ণ দেওয়ান চরিত্র অঙ্কিত হতে পেরেছে।

দীনবন্ধু সংলাপ রচনায় যেখানে অভিজ্ঞতা ও সহানুভূতি মেলাতে পেরেছিলেন সেখানেই তাঁর অঙ্কিত চরিত্র ও তার মুখের সংলাপ বাস্তব জীবন্ত এবং স্বাভাবিক হয়েছে। দীনবন্ধুর সংলাপ রচনার সার্থকতা সম্বন্ধে এই হল মুখ্য বিষয়।



Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন