নীলদর্পণ নাটকে হাস্যরস

হাস্যরস সৃষ্টি করার জন্য চাই অপূর্ব বস্তু নির্মাণক্ষমাপ্রজ্ঞা। কারণ হাসি সৃষ্টি হয় বৈষম্য ও অসঙ্গতি থেকে। অচিন্ত্যনীয় কোন ঘটনা দেহের বিকৃতি, প্রাপ্তিবোধ প্রভৃতি থেকে হাসির উদ্রেক ঘটে। তবে যেভাবেই হাস্যরস সৃষ্টির চেষ্টা হোক না কেন, সর্বাগ্রে দরকার হয়। সুগভীর সহানুভূতি।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর পঞ্চভূত গ্রন্থে কৌতুক হাস্যের স্বরূপ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লিখেছেন — “দুঃখে কাঁদি সুখে হাসি, এটুকু বুঝিতে বিলম্ব হয় না কিন্তু কৌতুকে হাসি কেন? কৌতুক তো ঠিক সুখ নয়। মোটা মানুষ চৌকি ভাঙিয়া পড়িয়া গেলে আমাদের কোনো সুখের কারণ ঘটে, একথা বলিতে পারি না। কিন্তু হাসির কারণ ঘটে ইহা পরীক্ষিত সত্য।"

রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করেছেন হাসির উদ্রেক ঘটনায় অসঙ্গতি। এই অসঙ্গতি ইচ্ছার সঙ্গে অবস্থার, কথার সঙ্গে কার্যের। আবার অতিরঞ্জন থেকেও হাসির সৃষ্টি হয়। অদ্ভুত কল্পনা ও উদ্ভট পরিবেশ রচনা থেকে সৃষ্টি হয় অতিরঞ্জন, যা হাসির কারণ ঘটায়।

হাসির নানা প্রকার ভেদ আছে। ইংরেজি সাহিত্যে wit. satire irony, humour sarcasum প্রভৃতির মাধ্যমে হাসির সৃষ্টি করা হয়েছে। wit হল সূক্ষ্ম বুদ্ধি গ্রাহ্য হাস্যরস। এই হাসিতে মুখে মৃদু রেখা ফুটে উঠে। satire হল নির্মম কৌতুক। তাতে যার বিরুদ্ধে satire প্রয়োগ করা হয় তার মর্মমূল পর্যন্ত লজ্জারুণ হয়ে ওঠে। Irony হল তীব্র শ্লেষ। fun নিছকই কৌতুক। কারোর ভাঁড়ামি নির্বুদ্ধিতা শিথিলতা স্থূলতা নিয়ে কৌতুক করাই fun-এর উপজীব্য। sarcasm নিষ্ঠুর কৌতুক। fun যদি হয় মজা তবে sarcasm হল নির্মম চাবুক।

এইগুলি ছাড়া আরও একপ্রকার হাস্যরস আছে, যা আমাদের যাবতীয় অসঙ্গতি ও ভুলের মধ্যে দিয়ে প্রীতি ও সুগভীর সহানুভূতির মিশ্রণ ঘটিয়ে মনকে অশ্রুসিক্ত করে তোলে। একেই বলে হিউমার। এই হাস্যরস সৃষ্টি করতে গেলে প্রতিভার প্রয়োজন আছে। হিউমার সৃষ্টিতে দীনবন্ধুর কৃতিত্ব অসাধারণ।

দীনবন্ধুর যাবতীয় নাট্য সাহিত্যে হাস্যরসের উপরিকথিত বিভাগগুলি সহজেই চোখে পড়ে। কিন্তু নীলদর্পণ নাটকে কেবল হিউমারের অশ্রুবর্ষণ।

প্রথমেই স্বীকার করা ভাল, নীলদর্পণ-এর বিষয়বস্তু এমন যে এখানে হাস্যরস সৃষ্টির অবকাশ কম। কারণ এই নাটকে বর্ণিত হয়েছে শাসকের হাতে শাসিতের নির্মম অত্যাচার ও তজ্জনিত অসহায় হাহাকার। অতএব এখানে হাস্যরসের কোনও অবকাশ নেই। অর্থ বিত্ত কৌলীন্যহীন দরিদ্র বাংলার গ্রাম্য চাষীরা বাধ্য হয়েছে নীলচাষ করতে বা তার ধান জমি নীলচাষের জন্য হাতছাড়া করতে। নীলকর সাহেবরা প্রবল দাপটে অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে যাবতীয় প্রশাসন যন্ত্র হাতের মুঠোয় এনে অবাধে নীলচাষের ব্যবস্থা করেছে। এতে তাদের সমূহ লাভ। কোনও চাষীর সাধ্য নেই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার। সহ্যের সীমা মাত্রা ছাড়ালে স্বাভাবিক কারণেই প্রতিবাদের জন্ম হয়। নীলকরদের অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য সমাজের ধনী সম্পন্ন মানুষেরা প্রজা-হিতৈষণায় এগিয়ে এসেছিল। তার ফলে দেখা দেয় নীল আন্দোলন। নীলদর্পণে এগিয়ে এসেছে স্বরপুরের বসু পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র নবীনমাধব। তার ফল তার হাতে হাতে পেতে হয়েছে। নীলকরগণ নবীনমাধবকে জব্দ করার জন্য তার পিতা গোলোকচন্দ্র বসুকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দিয়ে কারাগারে ঠেলে দিয়েছে। প্রবল আত্মমর্যায় আঘাত লাগায় তিনি কারাগারের মধ্যে উদ্বন্ধনে প্রাণত্যাগ করেছেন। এই মৃত্যু পরপর আরো কতগুলি মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছে। যেমন সাহেবদের হাতে নবীনমাধবের মৃত্যুবরণ। উন্মাদিনী সাবিত্রী তাঁর আদরের কনিষ্ঠ পুত্র বধুকে হত্যা করেছেন এবং অবশেষে সম্বিৎ ফিরে পাওয়ার পর আত্মশোচনার কঠোর আঘাতে সাবিত্রীও মৃত্যুবরণ করেছেন হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া স্তব্ধ হওয়ায়। সাধুচরণের গর্ভবতী বিবাহিতা কন্যার মৃত্যুর কারণ সে শেষ পর্যন্ত নীলকরের শয্যাসঙ্গিনী হতে চায় নি বলে। এই করুণ কাহিনী হাস্যরস সৃষ্টির উপযুক্ত জায়গা নয়। কিন্তু দীনবন্ধু তাঁর অসাধারণ লেখনীর দ্বারা নাটকের বিভিন্ন পাত্র পাত্রীর জীবনরস নিষ্কাশন করে নিয়েছেন। নীলদর্পণ-এর হাস্যরস তাই উঠে এসেছে কয়েকটি চরিত্রের অজ্ঞতা, বিভ্রান্তি ও বিস্ময়বোধ থেকে। এক কথায় বলা যায়, এই হাসি যথার্থ হিউমার জাতীয় ।

সাধুচরণ নীলের দাদনের সঙ্গে পরিচিত। দাদন একবার যে চাষী পরিবারে ঢোকে, সে পরিবার চিরকালের জন্য ভূমিহীন হয়ে যায় নীলকরের কাছে। তাই সাধুচরণ নীলের দাদনকে যখন নীলের গাদন বলে, তখন হাসির পরিবর্তে তার কান্না ঠেলে বেরিয়ে আসে। চাষী পরিবারের অসহায়তায় এমন নির্মম প্রকাশ অন্য কিছুর দ্বারা অসম্ভব।

বেগুণবেড়ের কুঠিতে ধরে আনা তোরাপসহ আরও চারজন রাইয়তকে। তারা নবীনমাধবের বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষীদানের জন্য আনীত হয়েছে। এরা নিতান্ত সরল নিরক্ষর গ্রাম্য চাষী। এদের নিয়ে দীনবন্ধু কৌতুক করেন নি। কিন্তু এদের কথাবার্তায় আচরণে এমন কিছু অসঙ্গতি প্রকাশ পেয়েছে যা হাসির খোরাক হয়েছে। চারটি রাইয়তের প্রকৃতি চার রকমের। প্রথম রাইয়তের বুকের উপর নীলকর সাহেবের দামী বুট জুতো পরে দাঁড়ানোয় তার বুকে ক্ষতস্থান তৈরি হয়েছে। নীলকুঠির সাহেবের বিরুদ্ধে তার যাওয়ার উপায় নেই। সে তার সাহেবের বিরুদ্ধে তার মনের রাগ প্রকাশ করেছে এই বলে 'গোডার পায্যান বলদে গোরুর খুর।' সাহেবের প্রতি তার গালাগালি বড় নির্মম। কারণ সে সাহেবকে অশ্লীল গালাগালি দিয়েছে তাকে গোড়া (গুখেগোর বেটা) ও বলদে গোরুর সঙ্গে তুলনা করে। প্রথম রাইয়তের কথায় অজ্ঞতার গন্ধ পেয়ে পরম বিজ্ঞের মতো দ্বিতীয় রাইয়ত জানিয়েছে, সাহেবরা যে প্যারেকমারা জুতো পরে জানিস নে?' এই অতি সহজ কথাটা প্রথম রাইয়ত জানে না বলে দ্বিতীয় রাইয়ত পরম আত্মসন্তুষ্টি লাভ করেছে। এখানেই হাস্যরস উদ্ভিক্ত হয়েছে।

তৃতীয় রাইয়ত যেমন স্ত্রৈণ তেমনি আত্মবিশ্বাসহীন। তার যাবতীয় শিক্ষা তার স্ত্রীর কাছে। কোনও অভিনব কিছু দেখলে, সে তা স্ত্রীকে না জানিয়ে পারে না। নীলকুঠির গুদাম ঘরে আটকে রাখা রাইয়তদের আর্তধ্বনি তার কাছে ভূতের নাকীকান্না বলে মনে হয়েছে। এই অভিনব অভিজ্ঞতা সে তার স্ত্রীকে না বলে পারবে না। আবার সে যেমন রোগ সাহেবের পায়ের গুঁতো খেয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ে তখন সে আর্ত চিৎকারে বলে 'বউ তুই কনেরে, মোরে খুন করো ফ্যালালো।"

চতুর্থ রাইয়ত নিজেকে শিক্ষিত বলে মনে করে, তাই সে হঠাৎ হঠাৎ তৎসমশব্দযুক্ত বাক্য বলে। সে কিন্তু স্বরপুরের লোক নয়, তবু এখানে সে এসেছিল মিছরি নেওয়ার জন্য। তারপর সে গোলোকচন্দ্রের পরামর্শ দাদন নিতে অস্বীকার করায় তাকে কুঠিতে ধরে আনা হয়েছে। গোলোকচন্দ্রকে দেখে তার ভালো লেগেছিল। তার ভালো লাগার বিষয়টি ব্যক্ত করেছে সে নিম্নোক্তভাবে 'আহা কি দয়ার শরীল, কি চেহারার চটক কি অরপুরুব রুপী দেখেলাম, বসে আছেন যেন য্যান গজেন্দ্রগামিনী।' গোলোকচন্দ্রের সম্ভ্রান্ত উপবেশন দৃশ্য তার কাছে গজেন্দ্রগামিনীর সাদৃশ্য জাগিয়ে দেয়। ইংরেজিতে এইরকম শব্দ ব্যবহারকে malapropism বলে। দীনবন্ধু এর দ্বারা হাস্য রস সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন।

উপরে যে কয়জন রাইয়তের কথা বলা হয়েছে, তাদের থেকে স্বতন্ত্র মানসিকতার মানুষ তোরাপ যেমন সাহসী, তোমনি বুদ্ধিমান। সাহেবের বেতের বাড়ি আর আর পায়ের জুতা খেয়ে সে কথায় চিৎকার করে বটে, তবে সে মনে মনে ভেবে নেয়, সাহেবের সঙ্গে উপযুক্ত সময়ে মোকাবিলা করবে। সে স্বগতোক্তিতে বলে, “বাবা রে। যে নানা, অ্যাকন তো নাজি হই। ত্যাখন ঝা জানি তা করবো।” তার এই বুদ্ধির প্রকাশ কৌশল হাসির উদ্রেক ঘটায়। এই হাসি কৌতুকের হাসি। তোরাপ আরও বার কয়েক কৌতুক হাসির যোগান দিয়েছে। ক্ষেত্রমণির লাঞ্ছনার দৃশ্যের কথা ভাবা যায়।

ক্ষেত্রমণিকে উদ্ধার করার সময় ছোট সাহেব তোরাপকে জুতার গুঁতা মারলে, তোরাপ বলে – গ্যাডম্যাড করো জুতার গুঁতা মারিসনে।' ছোট সাহেবকে সে প্রাণে মেরে চিৎ করে ফেলে দিয়ে পলায়ন করেছিল। পলায়ন করার আগে সে সাহেবের কান মলেও দিয়ে দিয়েছিল। এই সবই তার প্রতিশোধ পরায়ণতার লক্ষণ। কিন্তু এই লক্ষণগুলিই কৌতুকরসের উৎসার ঘটিয়েছে। নীলকরের কান মলে দিয়ে সে যাবতীয় নিগৃহীত প্রজা সাধারণের আত্মপ্রসারর কারণ হয়েছে। এই আত্মপ্রসাদ লাভের উপায়টি কৌতুককর।

নবীনমাধবের মৃত্যুবরণের দৃশ্যে তোরাপ প্রতিশোধ নিয়েছে সাহেবের নাক কামড়ে নিয়ে। নাকের কামড়ে নেওয়া অংশটি সে তার কোমরে গুঁজে রেখেছে, জ্ঞান ফিরে এলে সে তার বড়বাবুকে দেখাবে। তার বীরত্বের মহিমা প্রতিভাত হয়েছে কৌতুকরসের মধ্য দিয়ে দীনবন্ধুর প্রবল জীবনজিজ্ঞাসার প্রতিফলনে। স্বয়ং দীনবন্ধু চেয়েছিলেন নীলকরেরা তাদের কৃতকর্মের ফলভোগ করুক প্রজাদের হাতে নিগৃহীত হয়ে। তোরাপ সেই ইচ্ছার প্রতিমূর্তি।

দীনবন্ধু গৃহ পরিচারিকারূপে আদুরীকে এঁকেছেন। সে ইতিহাস সচেতন ও সতীত্বের আদর্শে স্থিত। তার কাছে স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্ম ভয়াবহ। আদুরী যখন শোনে বসু বাড়ির বন্ধু বিদ্যাসাগরের 'বেতাল' পড়া শুনবে তখন সে বিদ্যাসাগরের প্রতি তাঁর অনাসক্তির কথা দৃঢ়তার সঙ্গে ব্যক্ত করেছে। সে বলেছে “সেই সাগর নাড়ের বিয়ে দেয়, ছ্যা-নাকি দুটো দল হয়েছে। মুই আজাদের দলে।”

বিদ্যাসাগর ছিলেন বিধবা-বিবাহের স্বপক্ষে আর 'আজা' অর্থাৎ রাজা রাধাকান্ত দেববাহাদুর ছিলেন বিপক্ষে। আদুরী বিধবা, কিন্তু পুনর্বিবাহে তার মন নেই বলে সে বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহের প্রবর্তনের প্রয়াসকে ঘৃণা করে, আর রাজা রাধাকান্তের প্রতি জানায় তার অন্তরের আনুগত্য। নিতান্ত পরিচারিকা হয়েও আদুরীর ইতিহাস চেতনা বেমানান ঠেকতে পারে। এই অসঙ্গতি কিন্তু স্নিগ্ধ কৌতুক রস প্রকাশ করেছে।

রেবতীর মুখে যখন আদুরী শুনেছে পদীময়রাণী ক্ষেত্রমণির উপর ছোট সাহেবের লালসার কথা জানিয়েছে, তখন আদুরী অযাচিতভাবে বলেছে। 'থু, থু, থু।...গোন্দো। প্যাজির গোন্দো !সাহেবের কাছে কি মোরা থাকতি পারি, গোন্দো থু থু। প্যাজির গোন্দো! মুই তো আর একা বেরোব না, মুই সব সইতে পারি প্যাজির গোন্দো সইতি পারি নে থু, থু, গোন্দো। প্যাজির গোন্দো!”

মনে রাখতে হবে আদুরী বয়স্কা বিধবা পরিচারিকা। মৃত স্বামীর স্মৃতি এখনও তাকে কুরে কুরে খায়। সে তাঁর বাকি জীবন মৃত স্বামীর সুখ স্মৃতি নিয়েই বেঁচে থাকতে চায়। সে যেমন বিধবা বিবাহে সম্মতি জানায় না তেমনি বিদেশী সাহেবের কাছেও দেহ সমর্পণ করবে না, কারণ সাহেব 'প্যাজ' খায়। এই সাহেবের হাত থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্য এখন থেকে আদুরী পথে ঘাটে একা বেরোবে না। কারণ তাহলে সাহেব কর্তৃক সে অপহৃতা হতে পারে। আদুরীর চারিত্রিক শুচিতার তুলনা মেলে না। সাহেবের কাছে সে যেহেতু বয়স্কা সেইহেতু তাকে কখনই লেঠেলরা অপহরণ করে নিয়ে যাবে না, এ সত্য তার অজানা নয়। তবু সে যখন বলে আর একা বেরোব না তখন এক সরল কৌতুক জীবনরসে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে।

পদী বিধবা স্বৈরিণী। সে জীবিকা নির্বাহের উপায় হিসেবে বেছে নিয়েছে সাহেবের লালসা নিবৃত্তির রক্ষিতার জীবন। সে শুধু তার নিজের শরীরই সাহেবের লালসার শিকারে পরিণত করে নি, সাহেবের জন্য আরও অনেক মেয়ের খবর তার পৌঁছে দিতে হয় নীলকুঠিতে। তার এই কুকর্মের পরিণতি সম্পর্কে সে সচেতন। এ হেন পদী যখন সতীত্বের মহিমার কথা আওড়ায় তখন বিসদৃশ অসঙ্গতির জন্য হাসির উদ্রেক হয়। অসতী নারীর সতীত্বের বড়াই শোভা পায় না। এই হাসি নিষ্ঠুর হলেও করুণ। লেখকের সহানুভূতি এখানে প্রকট। পদীর কথায় যদি হাসির উদ্রেক ঘটে, তবে নিশ্চয়ই তা হিউমারের হাসি। পদী যে জীবন বেছে নিয়েছে, তা নিম্নস্তরের অমার্জিত জীবন। এই জীবন বেছে নিয়েও যে সে লজ্জাশরম বিসর্জন দেয় নি, তা বোঝা যায় যখন নবীনমাধবের মুখোমুখি হবার মুহূর্তে সে বলে— ওমা কি লজ্জা। বড়বাবুকে মুখখান দেখালাম। অসতীর জীবন বেছে নিয়েও সে যে লজ্জাহীনা নয় এই মর্মান্তিক জীবন কথা প্রকাশ পাওয়ায় তার জীবনযন্ত্রণা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই হাসিও নির্মম এবং করুণ।

ইন্দ্রাবাদে ফৌজদারি কাছারির যে বিবরণ দীনবন্ধু উদ্ঘাটন করেছেন তাতে স্পষ্ট হয়েছে, আদালতকে দুর্বৃত্ত ও স্বার্থপর ধনী ক্ষমতাশীল ব্যক্তিরা বশীভূত করতে পারে। আদালতের বিচারককে বলে ধর্মাবতার। এই ধর্মস্থানকে নীলকর সাহেবরা কলুষিত করেছে। দীনবন্ধু এই কলুষিত আদালতের দৃশ্য অঙ্কন করে নিষ্ঠুর কৌতুক রসের সৃষ্টি করেছেন। ম্যাজিস্ট্রেট, মোক্তার সেরেস্তাদের আচরণ ও কথাবার্তা সবই সেই নির্মম কৌতুকরসের অবিমিশ্র প্রকাশ ঘটিয়েছে। এই কৌতুকরসের সামনে দাঁড়িয়ে হাসির পরিবর্তে চোখের জল গড়াবে। আদালতের মহিমা ক্ষুণ্ণ হলে যে পৃথিবী বাসযোগ্য থাকবে না দীনবন্ধু সেই কথাই পাঠককে বোঝাতে চেয়েছেন।

নীলকর সাহেবরা গ্রামের মানুষকে জব্দ করার জন্য গরু লাঙল কেড়ে নিয়ে আসার সময় তাদের বউকেও ধরে নিয়ে আসতো। বেগুণবেড়ের কুঠির আই. আই. উড সেই হতভাগ্য বউদের উপর শারীরিক বলপ্রয়োগ করত না। অর্থাৎ সে দেখাতে চাইত নারী নিগ্রহ তার স্বভাবে নেই। তার ছোট সাহেব পি. পি. রোগও স্বভাব চরিত্রে খারাপ। দেওয়ান আমিনরাই তার চরিত্র নষ্ট হওয়ার কারণ। তৃতীয় অঙ্কের প্রথম গর্ভাঙ্কে গোপীনাথ দেওয়ান যখন উডকে জানাল, “আমিন আপনার ভগিনীকে ছোট সাহেবের কামরায় আনিয়াছিল” তখন উড বলেছিল, “হাঁ হাঁ আমি জানি, ঐ বাঞ্চৎ আর পদী ময়রাণী ছোট সাহেবকে খারাপ করিয়াছে। বজ্জাৎকো হাম জরুর শেখলায়েঙ্গে, বাঞ্চৎ, কো হামারা বটনেকা ঘরমে ভেজ ডেয়্।” উড সাহেবের কথা শুনলে মনে হবে রোগ একজন ধোয়া তুলসীপাতা। নীলদর্পণের শুরু থেকেই দেখতে পাওয়া যায় রোগ স্বাভাবিক ভাবে নারীলোলুপ। অথচ তার এই চরিত্র শিথিলতা সম্পর্কে উডের নীরবতা হাসির খোরাক জোগায়। এ হাসি শ্লেষের। নষ্ট চরিত্র ইংরেজ নীলকরের ভণ্ডামির মুখোশ দীনবন্ধু বড় নির্মম চাবুকের দ্বারা প্রকাশ করে দিয়েছেন।

গোপীনাথ দেওয়ান চাকরি রক্ষার স্বার্থে নীলকরদের মন জুগিয়ে চলে। তারই কুপরামর্শে গোলোকচন্দ্র বসু মিথ্যা মামলায় কারারুদ্ধ হন এবং শেষে অনুশোচনায় ও আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগায় আত্মহত্যা করেন। নবীনমাধবকে কারারুদ্ধ করার দুষ্ট মন্ত্র সেই সাহেবের কানে তুলে দেয়। তবুও উড়ের মনে হয় গোপীনাথ উড়ের বিশ্বাসভাজন নয়। গোপীনাথকে নীল কমিশনে নীলকরদের কথা বলতে পাঠান হবে বলে উড ঠিক করে রেখেছিল। কিন্তু গোপীনাথকে ততখানি আন্তরিক ও বিশ্বস্ত বলে মনে হয় নি উডের। তাই গোপীনাথকে উড দুই পা দিয়ে পদাঘাত করে বলে, “কাকো কাম্ দেখকে হাম তোমকো আসে জেল মে ভেজ দেখা।” পদাহত গোপীনাথ উডের এই কথা শুনে বলে, “কি পদাঘাতই করিতেছে বাপ। বেটা যেন আমার কালেজ আউট বাবুদের গৌনপরা মাগ।”

নীলদর্পণ রচনা কালে কলেজের পাশ করা বাবুদের স্ত্রী মেমসাহেবদের মত গাউন পরে চলাফেরা করত। তারা বাঙালী বধূদের মত নয়। এইসব মেমসাহেব সাজা বঙ্গ বন্ধুদের কেউ সহ্য করতে পারত না। গোপীনাথ দেওয়ানের কাছেও তেমনি নীলকর সাহেবরা অসহ্য। এখানে প্রকাশ পেয়েছে দেওয়ানের তীব্র ক্ষোভ ও অসহনীয় জ্বালা। এই ক্ষোভ ও জ্বালা যে হাসির সৃষ্টি করে তার পেছনে আছে চোখের জল। তাই এ হাসি করুণ হিউমারের কাছ ঘেঁসে চলে যায়।

পূর্বেই স্বীকার করা হয়েছে। নীলদর্পণ নাটকে প্রত্যক্ষভাবে হাসি সৃষ্টির কোন অবকাশ নেই। কিন্তু নাট্যকার লিখন কৌশল এমন চাতুর্যে ভরা যে সে লেখনী মাঝে মাঝেই উচ্চাঙ্গের হাস্য রসের পরিবেশন করেছে। বলাবাহুল্য, এ হাসি নির্মল শুভ্র। এই হাসির মাধ্যমে চাষীদের অজ্ঞতা ও অসহায়তা যেমন প্রকাশ পেয়েছে তেমনি নীলকর তার আমিন দেওয়ানদের সম্পূর্ণ চরিত্রের উদ্ঘাটন হয়েছে কলমের ২/১ আঁচড়েই। দীনবন্ধু যে একজন প্রতিভাবান নাট্যশিল্পী তা এ থেকেই স্পষ্ট হয়।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন