নীলদর্পণ যখন রচিত হয় তখন ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পটভূমি বড় জটিল। এই নাটক রচনার তিন বছর পূর্বে সংঘটিত হয়েছে সিপাহী বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহকে বলা হয়। প্রথম ভারতবাসীর স্বাধীনতা সংগ্রাম।
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে যখন কলকাতায় হিন্দু কলেজ স্থাপিত হয়, তখন তার মাধ্যমে learning অভিজাত বঙ্গসন্তানদের মানসিক প্রকর্ষের সুযোগ এনে দেয়। যুরোপীয় জ্ঞানবিজ্ঞানের নানা শাখার প্রতি জাগে বিচিত্র কৌতূহল। তার ফলে সমাজ সংস্কার, মুক্তচিন্তা ও সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা তীব্র হয়ে ওঠে। নানা বিষয়ক সভাসমিতি স্থাপন, সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রিকা প্রকাশের ইচ্ছা বাঙালীর মনে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষা চর্চা ও সাহিত্য রচনার আগ্রহ ব্যাপকতা পেতে থাকে। বিধবা-বিবাহ প্রবর্তন এবং সেই সঙ্গে বহু-বিবাহ ও বাল্য-বিবাহের অবলোপ ঘটানোর জন্য আইন প্রবর্তনের আহ্বান জাগে। এই আহ্বান আন্দোলনের রূপ নেয়। চারিদিকে স্কুল কলেজ স্থাপন এবং সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রয়াস ত্বরান্বিত হয়। এই সঙ্গে জাগে দেশ চেতনা।
নব্য শিক্ষিত বাঙালী ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ঘ্রাণে এতই মাতোয়ারা হয়ে ওঠে যে ইংরেজ শাসন উৎখাতের চিন্তা তাদের মনে দানা বাঁধে নি। উচ্চবর্ণের ইংরেজি শিক্ষিত সম্প্রদায় যখন ইংরেজদের সঙ্গে একাসনে বসার উপায় খুঁজে ফিরছে তখনই ভারতবর্ষের চারিদিকে নিম্নবর্গের মানুষেরা ইংরেজের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নভাবে সংঘবদ্ধ না হয়ে আন্দোলনের ডাক দিতে শুরু করেছে। তাদের সেই আন্দোলন সার্থক না হলেও তার সুদূর প্রসারী প্রভাব কাটান সম্ভব হয় নি ভারতবাসীর পক্ষে। ১৮৫৭ সালে উক্ত নানা বিচ্ছিন্ন আন্দোলন সংঘবদ্ধ হয়ে বিদ্রোহের দাবানল সৃষ্টি করল সিপাহী বিদ্রোহের মাধ্যমে। ভারতবাসীর জাতীয়তাবোধ প্রত্যক্ষ রূপে প্রকাশ পেল। এই জাতীয়তাবোধ জাগাল দেশবাসীর রাজনৈতিক চেতনা। দেশপ্রেমের কল্পনা প্রখর হয়ে উঠল। বাঙালী কবি ও নাট্যকার এই দেশপ্রেমের মন্ত্রে উদ্দীপিত হলেন।
সিপাহী বিদ্রোহ ইংরেজ শাসক অচিরেই দমন করল একথা ঠিক। কিন্তু এই বিদ্রোহ দমন করতে না করতেই আবির্ভাব ঘটল নীল আন্দোলনের। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে নীলকরের অত্যাচার মাত্রাহীন হয়ে উঠল। গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে ধ্বনিত হয় অসহায় আর্ত চিৎকার। ইংরেজ শাসক সম্প্রদায় পরোক্ষে মদত দিল নীলচাষে। কারণ এই চাষ বিস্তর অর্থাগমের সুযোগ। নীলকরদের লাগাম ছাড়া অত্যাচারকে ইংরেজ শাসক আন্তরিকভাবে দমন করার অভিপ্রায় প্রদর্শন করে নি। এদেশী কিছু প্রজাদরদী সাংবাদিক ও সম্পাদক নীলচাষীদের দুর্গতির চিত্র প্রাণ ভয় তুচ্ছ করে তাদের সংবাদপত্রে ও সাময়িক পত্রে প্রকাশ করতে লাগলেন। অক্ষয়কুমার দত্ত তাঁর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায়, ঈশ্বর গুপ্ত তাঁর সংবাদ প্রভাকরে এবং হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায় তাঁর হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকায় দিনের পর দিন বাংলার চাষীদের অবস্থার কথা নির্ভীকচিত্তে প্রকাশ করার চেষ্টা করলেন। প্যারীচাদ মিত্র তাঁর 'আলালের ঘরের দুলাল' গ্রন্থে নীলকরদের অত্যাচারের কথা দ্বিধাহীনচিত্তে প্রকাশ করলেন। অবশেষে ধৈর্যহারা গ্রামের কৃষককুল নীল আন্দোলন শুরু করলেন। নদীয়া ও যশোহর জেলায় নীল আন্দোলন সংঘবদ্ধ আন্দোলনে রূপান্তরিত হল। নীলকর সাহেবরাও আরও বেপরোয়া হয়ে উঠল। তারা এই প্রজাবিদ্রোহকে প্রবল ইংরেজ বিরোধিতার প্রকাশ রূপে গণ্য করল। চাবুক পিস্তল ছোরা লাঠি দেওয়ান, আমিন, ম্যাজিস্ট্রেট আইন আদালত দিয়ে তারা এই বিদ্রোহের মূকাবিলার পথ খুঁজল। কিন্তু তৎকালীন ইংরেজ শাসক সিপাহী বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে অনেকখানি নাজেহাল হয়েছে। নতুন করে এই সরকার আর বিদ্রোহের মুখোমুখি হতে রাজি নয়। ১৮৬০ সালের গোড়ায় নীল আন্দোলনের স্বরূপ সন্ধান ও অবসানের উদ্দেশ্যে সরকার বসাল নীল কমিশন। নীল কমিশনের রায় প্রকাশের পর পরই প্রকাশ পেল 'নীলদর্পণ' নাটক। ১৮৬০ সালের অক্টোবরের ঢাকা থেকে প্রকাশিত হল নীলদর্পণ নাটক। নাটকটিতে নাট্যকার স্বনাম ব্যবহার করেন নি। তিনি জনৈক পথিক নামে নাটকটি প্রকাশ করেন। অবশ্য নাটকটি যে দীনবন্ধু মিত্রের রচনা সে কথা গোপন থাকেনি।
দীনবন্ধু স্বনাম ব্যবহার না করুন, ইংরেজদের প্রতি এই নাটকে কেবল বিদ্বেষ প্রকাশ পায় নি। তিনি তাঁর নাটকের ভূমিকায় জানিয়েছেন, নীলদর্পণে বর্ণিত নীলকরদের অত্যাচারে জর্জরতি প্রজাদের ছবি দেখে নীলকর সাহেবরা তাদের কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে, এবং সেই সঙ্গে প্রজা নিগ্রহ বন্ধ করে দিয়ে প্রজা মঙ্গলের ভাবনায় উদ্বুদ্ধ হবে। তাতে বিলাতের মুখরক্ষা হবে। যে বিলাতের লোক ন্যায় নীতি ধর্মে, মানবিক ও গণতান্ত্রিক চেতনায় সমৃদ্ধ, তাদের দেশের লোক এদেশে এসে ন্যায় নীতি ধর্ম, মানসিকতা ও গণতান্ত্রিক চেতনা বিসর্জন দিয়ে অসহায় প্রজাপীড়নে উৎসাহী হয়ে উঠেছে সেই বিলাতের অনুরাগী দীনবন্ধু মিত্রের এটা ভালো লাগে নি। তাঁর ইংরেজ অনুরাগ অনেকের হয়ত ভালো লাগবে না। কিন্তু এটাই সব নয়। নাটকে দীনবন্ধু ব্রিটিশ প্রশাসনের আগ্রাসীরূপ বড়ো নির্মমভাবে তুলে ধরেছেন। নবীনমাধব যেহেতু নীলকরদের দাবী মেটাতে ইচ্ছুক নয়, অসহায় প্রজাদের হয়ে লড়াই করে অসীম সাহসে, ইস্কুল প্রতিষ্ঠা করতে চায় সেহেতু সে নীলকরদের শত্রু। ঐ সময় এই রকম অসংখ্য নবীনমাধব তৈরি হয়েছিল। নদীয়া জেলার দিগম্বর বিশ্বাস, বিষ্ণুকরণ বিশ্বাস, গুয়াতেলির মিত্র পরিবারের কর্তা নবীনমাধবের স্বগোত্রীয়। তৎকালীন বাঙালী এদের কর্ম তালিকায় জাতীয়তাবোধের পরিচয় পেয়েছিল। অসহায় প্রজা রমণী ক্ষেত্রমণীর উপর নীলকর সাহেবের লুব্ধ দৃষ্টি থেকে বাঁচানোর প্রয়াসে উৎসাহী হয়েছিল গ্রাম্য মুসলমান চাষী তোরাপ। দীনবন্ধু দেখিয়েছেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়তে গেলে হিন্দু ও মুসলমানের মিলিত প্রয়াসই প্রধান ভাবে প্রয়োজন। ক্ষেত্রমণির লাঞ্ছনার দৃশ্যে নবীনমাধব অত্যাচারী রোগ সাহেবকে নরাধম নীচবৃত্তি বলে গালি দিয়েছিল। শুধু তাই নয় তোরাপ রোগ সাহেবের গলদেশ ধরে চপেটাঘাত করে ক্ষান্ত হয় নি তার গাল টিপে ধরে কান মলে দিয়েছিল। তোরাপের এই সাহেব নিগ্রহ আর একবার দেখা গেছে। পঞ্চম অঙ্কের দ্বিতীয় গর্ভাঙ্কে নবীনমাধব উড সাহেবকে যখন অনুরোধ জানাতে আসে এই বলে যে পিতৃশ্রাদ্ধ শেষ হলেই সাহেবরা তাদের পুকুরপাড়ে নীলবোনা শুরু করুক, তখন উড সাহেব পায়ের জুতা নবীনমাধবের হাঁটুতে ঠেকিয়েছিল। প্রতিটি ক্রিয়ারই যেমন সমান এবং বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে, তেমনি নবীনমাধব ও উড সাহেবের বুকে সজোরে পদাঘাত করে। তোরাপও চুপ করে থাকে নি। নবীমাধবকে যখন মেরে ফেলার জন্য প্রথমে মাথায় লাঠির বাড়ি এবং শেষে তার দেহে তরোয়ালের আঘাত দিয়েছে, তখন তোরাপ উড সাহেবের নাক কামড়ে নিয়ে পালিয়েছিল। সমগ্র বাংলা সাহিত্যে এই সব ঘটনা যুগান্তকারী। নির্ভীক দীনবন্ধু এই সব ঘটনা দুঃসাহসে ভর করে নীলদর্পণ নাটক ঘটিয়েছেন। ঘটনাগুলি জাতীয়তাবোধের উদ্দীপনা জাগায়। ইংরেজদের বুকে লাথিমারা, তাদের গালে থাপ্পড় বসানো কান মলে দেওয়া এবং নাক কামড়ে নেওয়া—এসব ঘটনা তখন কোথাও ঘটেছে বলে শোনা যায় নি। গ্রাম বাংলায় যেভাবে নীলকররা অত্যাচার চালাচ্ছিল, তাতে তৎকালীন অসাহায় মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাচ্ছিল। দীনবন্ধু তারই দৃষ্টান্তে উপরোক্ত ইংরেজ নিগ্রহের ছবি উপহার দিয়েছেন তাঁর নাটকে। দীনবন্ধু ছিলেন দেশপ্রেমিক। নীলদর্পণ সেই দেশ প্রেমের নাটক। প্রখ্যাত অধ্যাপক রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত তাঁর দীনবন্ধু মিত্রের স্বদেশ চিন্তা' প্রবন্ধে (দেশ সাহিত্য সংখ্যা ১৩৭০ বঙ্গাব্দ) লিখেছেন—
“দীনবন্ধুই প্রথম বাঙালীকে দেশের কথা ভাবিতে শিখাইলেন। তিনি প্রথম বিদেশী বণিকের অত্যাচারের প্রতিবাদ করিলেন। তিনিই প্রথম ইংরাজ চালিত সংবাদপত্রের হীনমন্যতার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করিলেন। আবার ইংরাজ রাজপুরুষ ও ইংরাজ বণিকের অন্যায় উৎপীড়নের কথা বলিতে যাইয়া তিনিই প্রথম তাহাদের বাঙালী সহায়কদের লোভ ও কাপুরুষতার এক গ্লানিকর চিত্র বাঙালীর সামনে তুলিয়া ধরিলেন। এই নাটকেই প্রথম বাঙালী দেশসেবক সাহেবের বুকে পদাঘাত করিল।”
বাঙালীর জাতীয়তাবোধের জাগরণ ঘটাতে গিয়ে নাট্যকার এমন কতকগুলি ঘটনার দৃশ্য প্রত্যক্ষভাবে অঙ্কন করেছেন যা শুধু বাংলা সাহিত্যে নয় সমগ্র বাংলাদেশেও প্রথম। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে ডাক দেওয়া হয়েছিল বিদেশী দ্রব্য বয়কটের। এই ডাক প্রকারান্তরে ইংরেজ বণিকের প্রতি বিরুদ্ধতার ডাক। স্মরণে রাখা প্রয়োজন ইংরেজ বণিকের বিরুদ্ধতা করার ডাক প্রথম দিয়েছিল বাংলার অসহায় প্রজাবৃন্দ। নীলদর্পণ নাটকে এই ডাকের নাট্যদৃশ্যই উপহার দেওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম গর্ভাঙ্কে তোরাপ নীলকর সাহেবের প্রকৃতি বিশ্লেষণ করেছেন নিম্নছড়ায়—
ব্যারাল চোকো হাঁদা ভেদো।
নীলকুটির নীল মেদো ।
এই শ্লোকটি রচনা করেছে জনৈক বচোরদ্দি নানা। দ্বিতীয় রাইয়তও একটি শ্লোক শুনিয়েছে-
"জাত মারে পাদরি ধরে।
ভাত মাত্রে নীল বাঁদরে।”
এই শ্লোকও রচনা করেছে গ্রাম্য কবি নিতে আতাই। বাঙালীর ভাতের থালা ধরে টান দিয়েছে যে নীলকর, তাকে গ্রাম বাংলার মানুষ বাঁদরের সঙ্গে তুলনা করেছে। এই তুলনাতে বর্ষিত হয়েছে নীলকর জর্জরিত মানুষের মনের ক্রোধ। নীলদর্পণ সেই ক্রোধের নাটক।
বাংলার শিক্ষিত চাকুরী জীবী মধ্যবিত্ত মানুষ যখন ইংরেজদের সঙ্গে আপোষ করে পার্থিব পাওনা মেটাবার সুযোগ খুঁজছে তখন অসহায় গ্রামবাসী ইংরেজ বণিককে নীলমেমদো, নীল বাঁদর বলে গাল পাড়ছে। এইভাবে সবার অলক্ষ্যে তৈরি হয়েছে জাতীয় চেতনার বজ্র গর্ভ আহ্বান। দীনবন্ধু গ্রাম বাংলায় ঘুরতে ঘুরতে এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলার বুকে জাগা জাতীয়তাবোধের স্বরূপ তার নাট্য সাহিত্যে তুলে ধরেছিলেন।
স্বরপুরের বহু পরিবার শুধু নীল অত্যাচার ঠেকাতে চায় নি সেই সঙ্গে চেয়েছে ইস্কুল স্থাপন করতে। নবীনমাধব বিদ্যানুরাগী পণ্ডিত অধ্যাপকদের প্রতি তার অসীম শ্রদ্ধা। তার ভাই বিন্দুমাধব কলকাতার কলেজে পড়ে। শেক্সপিয়র তার প্রিয় কবি ও নাটক্যার। বঙ্কিম তার সহাধ্যায়ী। এই বঙ্কিম যদি আগামীদিনের সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র হন তবে বুঝতে হবে, দীনবন্ধু বঙ্কিমের কালজয়ী কবিতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার মধ্যে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন আগামী দিনের বাংলা সাহিত্যের যথার্থ সেবকের আবির্ভাব ঘটতে আর দেরি নেই। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে নবোৎকর্ষের ব্যাপারে দীনবন্ধু যে কতখানি সচেতন ছিলেন তা এই ঘটনা থেকেই স্পষ্ট হয়।
বিন্দুমাধব শুধু নিজে শিক্ষিত হতে চায় না, তার স্ত্রী সরলতাকেও আধুনিক সাহিত্যের রস পরিবেশন করতে চায়। সে তার স্ত্রীকে শেক্সপিয়র পড়াতে অনুপ্রাণিত করে। সরলতা গ্রাম্য ভূস্বামী পরিবারের পুত্রবধূ হলেও সে একটি শিক্ষিত শহরে মনোভাবাপন্ন নাগরিক কলকাতার সন্নিকস্থ অঞ্চলের পরিবারের কন্যা। এই পরিবারের কর্তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন স্বয়ং গভর্নর।
সরলতাও বিদ্যানুরাগিণী। সাহিত্যপাঠে তার আগ্রহ অপরিসীম। সে সৈরিন্ধ্রীকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের 'বেতাল পঞ্চবিংশতি' পাঠ করে শোনায়। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহের ব্যবস্থাপক ছিলেন। নব সমাজ সংস্কারকের উল্লেখে দীনবন্ধুর সমাজ চিন্তার স্বরূপ ধরা পড়েছে। বিদ্যাসাগর শুধু সমাজ সংস্কারক নন আধুনিক বাংলা গদ্যের জনক। নতুন দিনের সাহিত্য রচনার পটভূমি তিনি তৈরি করে দিচ্ছেন তখন। যে বছর নীলদর্পণ প্রকাশিত হয় সেই বছরই প্রকাশিত হয় সীতার বনবাস। ক্ষেত্রমণির মতো সীতাও এক লাঞ্ছিতা রমণী। এই রমণীর জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চোখের জল পড়েছে।
নারী মুক্তির ঈশারা যেমন মিলবে বিদ্যাসাগরের রচনায় তেমনি মিলবে দীনবন্ধুর। নীলদর্পণেও। সরলতা সেই ঈন্সিত মুক্তি চেতনায় উদ্বিগ্ন। সে তার স্বামী বিন্দুমাধবের চিঠি হাতে করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আপন মনে বলে –
“আমাদের নারীকুলে জন্ম, আমরা পাঁচ বয়স্যায় একত্রে উদ্যানে যাইতে পারি না, আমরা নগর ভ্রমণে অক্ষম, আমাদিগের মঙ্গল- সূচক সভা স্থাপন সম্ভবে না, আমাদের কালেজ নাই, কাছারী নাই, ব্রাহ্মসমাজ নাই— রমণীর মন কাতর হইলে বিনোদনের কিছুমাত্র উপায় নাই, মন অবোধ হইলে মনের তো দোষ দিতে পারি না।”
নারীপুরুষের সম্মিলিত সহযোগিতায় সমাজ জঙ্গমতা প্রাপ্ত হয়। শিক্ষিত পুরুষের মধ্যে প্রগতির চিন্তা জেগেছে, তার জন্য কলেজ স্থাপিত হয়েছে, সভা- সমিতির আয়োজন হয়েছে সাহিত্য রচনার আগ্রহ বাড়ছে, সংবাদ পত্র সাময়িক প্রকাশ হতে শুরু করেছে। এমতাবস্থায় নারী শিক্ষার নারীপ্রগতির পথ এখনও রুদ্ধ। এই রুদ্ধ কারায় আবদ্ধ বঙ্গ নারী বন্ধন মুক্তির উপায় খুঁজে না পেয়ে হতাশায় জর্জরতি হয়েছে। দীনবন্ধু সরলতার মাধ্যমে নারী সচেতনার স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছেন।
সরলতার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে সৈরিন্ধ্রী যে নিরক্ষরা হলেও বিদ্যাসাগরের রচনা পাঠের আগ্রহ প্রকাশ করে নির্দ্বিধায়। বসু বাড়ির পরিচারিকা আদুরী যে কতখানি দেশ সচেতন তা জানা যায় তার মুখে রাজা রাধাকান্তদেব বাহাদুর ও পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উল্লেখে।
নীলদর্পণ প্রকাশের সাত বছর পরে কলকাতায় স্থাপিত হয় হিন্দুমেলা, যা জাতীয়তাবোধের স্ফুরণের সহায়ক হয়েছিল। নীলদর্পণ কলকাতায় প্রথম মঞ্চস্থ হয় ১৮৭২ সালের ৭ ডিসেম্বর ন্যাশনাল থিয়েটারে। যে থিয়েটারের নামের সঙ্গে ন্যাশন্যাল শব্দটি যুক্ত থাকে, সে থিয়েটারে নীলদর্পণ ছাড়া আর কোনও নাটক অভিনীত হবে? নীলদর্পণের দৃষ্টান্ত অনুসরণে পরপর লেখা হয়েছিল দর্পণযুক্ত কিছু নাটক। যেমন জমিদার দর্পণ, কেরানী দর্পণ, চাকর দর্পণ প্রভৃতি। নীলদর্পণের সাহেব চরিত্র পরবর্তী কালের বাংলা নাটকেও অনুসৃত হয়েছে। উপেন্দ্রনাথ দাশ তাঁর সুরেন্দ্র-বিনোদিনী ও শরৎ-সরোজিনী নাটকে সাহেব দলন দৃশ্য অঙ্কন করেছেন। নীলদর্পণের ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশ করে জেমস লঙের এক মাসের কারাদণ্ড ও একশত টাকা জরিমানা হয়। জরিমানার টাকা নিজের পকেট থেকে বের করে জমা দিয়েছেন স্বয়ং কালীপ্রসন্ন সিংহ। এ সমস্তই দেশ হিতৈষণার স্বরূপ প্রকাশ।
দীনবন্ধু তাঁর নাটকে ভদ্র চরিত্রের পাশে ভদ্রেতর চরিত্রের সশ্রদ্ধ সন্নিবেশ ঘটিয়ে দেশের উচ্চনীচ সর্বস্তরের নারীপুরুষের প্রতি সম্মান জানিয়েছেন। তিনি দেখাতে চেষ্টা করেছেন দেশের সমস্ত স্তরের মানুষ যদি সমবেতভাবে বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে একত্রিত হয় সংঘবদ্ধ হয় তবে বিদেশী শক্তি এদেশ থেকে চলে যেতে বাধ্য হবে। দেশ আবার স্বাধীন এবং স্বয়ং সম্পূর্ণ হবে। নীলপূর্ণ জাতীয়তা বোধের চেতনার নাটক। তাই এই নাটক আজও বাঙালীর কাছে সমাদৃত।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন