সমর সেনের মহুয়ার দেশ কবিতায় কবির সৌন্দর্যচেতনার পরিচয়

ভূমিকা

হুয়ার দেশ কবিতাটি স্পষ্টভাবে দুটি অংশে বিভক্ত। প্রথম অংশে কবি নাগরিক জীবনের অবসাদ ও গ্লানির মর্মান্তিক চিত্র রচনা করেছেন। শহরের আকাশে সন্ধ্যা নেমে আসে আর ছড়িয়ে পড়ে অস্তগামী সূর্যের রঙিন আলো। কিন্তু এই সন্ধ্যা প্রশান্তি বহন করে আনে না। আকাশে আবর্তিত হয় ধোঁয়ার কুণ্ডলী। সেই ধোঁয়া ঘরে প্রবেশ করলে মনে হয় যেন দুঃস্বপ্নে আতঙ্কময় এই নাগরিক জীবন। এখান থেকে অনেক দূরে আছে মহুয়ার দেশ। এই কবিতায় মহুয়া শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে একটা প্রতীকের মতো। প্রকৃতির উদারতা, প্রশান্তি, স্নিগ্ধতা মহুয়ার প্রতীকে আভাসিত হয়েছে। 

কবিতার বিষয়বস্তু 

মহুয়ার দেশের অর্থ সেই স্বপ্নের দেশ যেখানে ক্লান্ত অবসন্ন প্রাণ সুস্থতার সাধ পায়। নাগরিক জীবনের অন্তহীন ক্লান্তির মধ্যে অবরুদ্ধ কবি মুক্তির স্বপ্ন দেখেন। একান্তভাবে কামনা করেন,


"আমার ক্লান্তির উপরে ঝরুক মহুয়া-ফুল,
নামুক মহুয়ার গন্ধ।"


কবিতাটির দ্বিতীয় অংশে পরিপ্রেক্ষিত রূপান্তরিত হয়েছে। সেই স্বপ্নের দেশ অর্থাৎ মহুয়ার দেশেই কবি উপস্থিত হয়েছেন কিন্তু সেখানে কবির হয়েছে এক সম্পূর্ণ বিপরীত অভিজ্ঞতা। নিঃসঙ্গতা বিলাসী নাগরিকের কাছে অসহ্য লাগে নিবিড় অন্ধকারের মধ্যে মাঝে মাঝে কয়লাখনির বিশাল শব্দ। প্রত্যাশিত প্রশান্তি এখানেও নেই। প্রকৃতির সন্তান যেসব মানুষ, তারা সারা রাত খনিগর্ভে কাজ করে সকালবেলায় অবসন্ন দেহমন নিয়ে বাইরে আসে। শিশির ভেজা সবুজ সকালের স্নিগ্ধ পরিবেশে চোখে দুঃস্বপ্ন নিয়ে আবির্ভূত এই মানুষগুলি দেখে কবি মর্মে মর্মে অনুভব করেন যে এখানেও প্রশান্তি নেই। জীবন অন্তহীনভাবে সর্বত্রই গ্লানিকর।


বাংলা কবিতায় নাগরিক জীবনের কুশ্রীতার পাশপাশি গ্রামের প্রশান্তির ছবি আঁকা প্রসিদ্ধ রীতি। গ্রামের মানুষ ও প্রকৃতির সরল জীবনের জন্য দীর্ঘশ্বাসমোচন আধুনিক বাঙালি কবিদের মজ্জাগত স্বভাব।


কবি সমর সেন এই মানসিকতার অসাড়তা প্রতিপন্ন করেছেন মহুয়ার দেশ কবিতায়। তিনি পাশাপাশি দুটি জীবন তুলে ধরেছেন। কবিতাটির দুটি অভিজ্ঞতার ভিন্ন জীবনমাত্রা কিন্তু কবির এই অভিজ্ঞতার মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। 


কবিতাটি গদ্যে লেখা। রবীন্দ্রনাথ এই রীতি প্রবর্তন করেন। প্রথমে লিপিকা পরে পুনশ্চে এই রীতিটি প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আধুনিক কবিতার সমালোচকেরা প্রায় সকলেই একমত যে, সমর সেনের কবিতায় গদ্য ছন্দের যথার্থ প্রয়োগ দেখা যায়। আবেগ প্রবাহে ছোটো বড়ো তরঙ্গ অনুসারে তিনি কবিতায় যতি স্থাপন করেছেন নিখুঁত ভাবে। বাক্যের মধ্যে শব্দের বিন্যাসে গদ্যের স্বাভাবিক রীতি তিনি কখনও ভাঙেননি। ফলে তাঁর কবিতার বাক্যগুলি গদ্যের কাঠামোর মধ্যেই থেকে গেছে। যেমন - 


"অনেক, অনেক দূরে আছে মেঘ-মদির মহুয়ার দেশ,
সমস্তক্ষন সেখানে পথের দুধারে ছায়া ফেলে
দেবদারুর দীর্ঘ রহস্য"


এইসব লাইনে ব্যবহৃত শব্দগুলির সাধারণ অর্থের ভিতর দিয়ে গভীর বক্তব্য সঙ্কোচিত হয়েছে। শিশির ভেজা সবুজ সকালের পটভূমিতে খনির শ্রমিকদের অবসন্ন মলিন চেহারা মুহূর্তের মধ্যে কবিতার মূল বক্তব্যকে স্পষ্ট করে তোলে। কবিতাটির ভাষা ভঙ্গিতে যে অনায়াস-হীনতা, উত্তেজনাহীনতা অনুভূত হয় তা কবির পরিমিতিবোধ ও অত্যন্ত শিল্প নৈপুণ্যের ফসল।

উপসংহার

ছোটো হলেও কবিতাটির মধ্যে কাব্য সৌন্দর্যের অভাব নেই। আলস মুখ, গলিত সোনা, উজ্জ্বল স্তব্ধতা, শীতের দুঃস্বপ্ন প্রভৃতি শব্দগুচ্ছের মধ্যে কাব্য সৌন্দর্য আছে। কবির সৌন্দর্য চেতনার পরিচয় ফুটে ওঠে, এর মধ্য দিয়েই। 


Bonus Knowledge 🙂

রবীন্দ্রনাথের মানসসুন্দরী কবিতায় বিহারীলাল চক্রবর্তীর সারদামঙ্গল কাব্যের প্রভাব আছে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন