একখানা হাত একটি প্রেমের কবিতা হিসেবে কতখানি সার্থক


ভূমিকা

রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা আধুনিক কাব্য আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা হলেন বুদ্ধদেব বসু। রবীন্দ্রনাথের অতীন্দ্রিয় প্রেম কল্পনাকে অস্বীকার করে বুদ্ধদেবের কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে তীব্র দেহ বাসনার সুর। রবীন্দ্রনাথের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা থাকলেও দেহবাসনার এই অকুণ্ঠ ঘোষণাতেই তিনি আধুনিক। এক খানা হাত কবিতাটি কবির প্রতিনিধি স্থানীয় কবিতা না হলেও এই কবিতাটিতে তার সেই দেহ কামনার সুর স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে। 

কবিতাটির বিষয়বস্তু


বুদ্ধদেব বসুকে সমালোচকেরা চিহ্নিত করেছেন ত্রিশের দশকের শরীরী প্রেমের কবি হিসেবে। তাঁর কবিতার ছত্রে ছত্রে মর্ত্য পৃথিবীর মাটি মাখা শরীরের গন্ধ পাওয়া যায়। তাঁর কবিতায় যে কামনার আর্তি ধ্বনিত হয় তা রবীন্দ্র প্রেম চেতনার ইন্দ্রিয়াতীত, দেহাতীত সৌন্দর্য্যলোক থেকে অনেক দূরবর্তী। স্বর্গের সৌরভের পরিবর্তে বুদ্ধদেবের কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে মর্ত্য পৃথিবীর মাটিমাখা শরীরের গন্ধ। এখানেই বুদ্ধদেব বসুর প্রেমচেতনার অকুণ্ঠ সত্য উচ্চারণের শক্তির বিশিষ্টতা ও বিশ্বাসযোগ্যতার প্রকাশ ঘটেছে।


একখানা হাত কবিতায় নিস্তব্ধ রাত্রে একটি আলোকিত জানালায় হঠাৎ দেখা সাদা হাতটাকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে প্রেমের আকুতি। সেই সুন্দর হাতটির অপ্রকাশ হাতছানিতে কবি একটি প্রেমময়ী কল্প প্রতিমার সঙ্গসুখ পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এই প্রত্যাশা ও আসঙ্গ তৃষ্ণা কবিকে বিনিদ্র করেছে।


আলোচ্য কবিতায় প্রেম চেতনার এক আশ্চর্য বর্ণবিভা লক্ষ করা যায়। বুদ্ধদেব বসু দেহ কামনাকে অস্বীকার করতে চাননি। কেননা আধুনিক কবি হিসেবে প্রেমের অতীন্দ্রিয়তাকে তিনি স্বীকার করতে পারেন না। শরীরকে অস্বীকার করলে বুদ্ধদেবের প্রেমানুভূতি অসাড় হয়ে পড়ে। আলোচ্য কবিতায় শাদা হাতটি সেই পূর্ণ শরীরের খণ্ড প্রতীক হিসেবেই কবির প্রেম চেতনাকে জাগ্রত করেছে। অপরিচয়ের রহস্যময় অন্ধকার থেকে কবি মুক্তি পেতে চেয়েছেন শাদা হাতের অধিকারিণীকে পূর্ণদৃষ্টিতে দেখার মধ্যে। তাকে সম্পূর্ণ রূপে জানার মধ্যদিয়েই রহস্য যবনিকার উন্মোচন ঘটতে পারে। কবির এই কামনাকে শরীরী বলতে কোনো বাধা নেই। 


অন্যদিকে শাদা হাতটির আশ্রয়ে যেহেতু কবির এই প্রেমচেতনা একটি পূর্ণ শরীরবিহীন রোমান্টিক চেতনা মাত্র। নিস্তব্ধ রাত্রির নির্জনতায় যে তীব্র আবেগে আলোড়িত হলেন কবি, তা পুরোপুরি ভাবেই কল্পনাসঞ্জাত। এই প্রেমের বা আকর্ষণের বীজভূমি সম্পূর্ণ ভাবেই কবির মন। কবির আক্ষেপ -


"যার হাত, কাল তার মুখ দেখি যদি
আমি চিনিব না।"


প্রেমানুভূতির স্বরূপ এইভাবে কবির কাছে চিরকাল অনাবিষ্কৃত থেকে যাবে। এবং এই কারণেই কবি খুব বেদনাহত হয়েছেন। 

উপসংহার 

দেহকে প্রাথমিকভাবে আশ্রয় করেও যেন বুদ্ধদেবের প্রেম দেহাতীত কোনো অনুভবলোকের। বস্তু শরীরের সীমায় যে কবি তার প্রেমানুভবকে যথাযথ চিনতে পারেন না, তার সরল ও সার্থক দৃষ্টান্ত 'একখানা হাত' কবিতাটি। আত্মকথন রীতিতে লেখা একখানা হাত কবিতাটি তাই একটি উজ্জ্বল প্রেমের কবিতা। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে রচিত এই কবিতায় চিত্রকলা ও প্রতীক ব্যঞ্জনা রচনায় মুন্সীয়ানা দেখিয়েছেন কবি বুদ্ধদেব বসু। প্রেমঋদ্ধ কবিতাটি তাই এক সার্থক মাত্রালাভ করেছে।

Bonus Knowledge 🙂

১৯৭৫-১৯৭৬ এই এক বছরের মধ্যে শক্তি চট্টোপাধ্যায় পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করে বাংলা ভাষায় কোনো একজন কবির কাব্যগ্রন্থ প্রকাশনার ধারাবাহিকতার ক্ষেত্রে এক সর্বকালীন রেকর্ড তৈরি করেন।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন