মৌর্যযুগ থেকে গুপ্তযুগ পর্যন্ত (খ্রিঃ পূঃ চতুর্থ শতাব্দী থেকে ষষ্ঠ খ্রিস্টাব্দের শেষ ভাগ) প্রায় এক হাজার বছর ভারতীয় জনসমাজের পরিপূর্ণ সঠিক চিত্র পাওয়া না গেলেও তার সমাজ-জীবন সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করা যায়।
মৌর্যযুগ (খ্রিঃ পূঃ ৩২৪-খ্রিঃ পূঃ ১৮৫)
মৌর্যযুগের সামাজিক অবস্থা জানার জন্য তৎকালীন ব্রাহ্মণ্য, বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থাবলি, বৈদেশিক বিবরণ এবং বিভিন্ন লেখমালার ওপর নির্ভর করতে হয়।
মৌর্যযুগের সমাজ বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র ছিল সমাজে চারটি প্রধান বর্ণ: এছাড়া ছিল অনেক নীচু বর্ণের মানুষ। বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ায় সমাজে মিশ্র বর্ণের সৃষ্টি হয়। ব্রাহ্মণরা সমাজের কর্তৃত্ব করত। পুরোহিতরূপে ও রাজার উপদেষ্টারূপে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে প্রভাবিত করত। ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের সামাজিক মর্যাদা ছিল ব্রাহ্মণদের পরেই। ক্ষত্রিয়েরা যথারীতি রাজ্য পরিচালনা করত। তবে সমাজে বৈশ্য ও শূদ্রের মধ্যে ব্যবধান ক্রমশ কমে আসছিল। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যরা ছিল সমাজের প্রথম স্তরে।
সমাজের দ্বিতীয় স্তরের মানুষ ছিল কৃষক। কৃষকরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়। কৃষকরা উৎপন্ন ফসলের এক-চতুর্থাংশ রাজকোশাগারে জমা দিত।
বৌদ্ধ ও জৈনদের মধ্যে পশুপালন ও শিকারিরা ছিল সমাজের তৃতীয় স্তরের। সমাজের চতুর্থ স্তরে ছিল কারিগরগণ। আর পঞ্চম স্তরে ছিল সাধারণ সৈন্যদল। এইভাবে কর্মের ভিত্তিতে সমাজবিন্যাসে নতুন ধারা প্রবর্তিত হয়।
মৌর্যোত্তর ও গুপ্ত-পূর্ব যুগ (খ্রিঃ পূঃ ১৮৫-৩২০ খ্রিস্টাব্দ)
মৌর্যোত্তর যুগ ও গুপ্তযুগের পূর্ববর্তীকালে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় সংকট উপস্থিত হয়েছিল। মৌর্যযুগের মতো এ যুগেও বর্ণাশ্রম প্রচলিত ছিল। তবে এ সময়ে নীতিগতভাবে ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় থাকলেও অনেক সময়ে ক্ষত্রিয়কে ব্রাহ্মণের সমকক্ষ, বা ক্ষেত্রবিশেষে ক্ষত্রিয়কে ব্রাহ্মণের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করা হত।
সকল বর্ণ বা সর্বস্তরের মানুষের দ্বারা পুষ্ট ছিল ক্ষত্রিয় শ্রেণি। ক্ষত্রিয়রা প্রয়োজনে জীবিকা হিসাবে ব্যাবসা ও কারুশিল্পকে গ্রহণ করতে পারত। তবে নানাকারণে সমাজে ক্ষত্রিয়দের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হতে থাকে, বিশেষত ভাড়াটে সৈন্য সংগ্রহের ফলে ক্ষত্রিয়দের মর্যাদাহানি হয়। যে গণরাজ্যগুলিতে ক্ষত্রিয়দের ভূমিকা ছিল প্রধান, সেগুলিরও অবনতি ঘটেছিল। ফলে ব্রাহ্মণদের মতো ক্ষত্রিয়দেরও ধীরে ধীরে মর্যাদা ও সম্পদ হ্রাস পেতে থাকে।
এই সময়ে সামাজিকভাবে স্বতন্ত্র শ্রেণি হিসাবে বৈশ্যরাও তাদের গুরুত্ব হারায়। গো-পালন ও কৃষিকার্যে তাদের জীবিকা সংকুচিত হয়ে পড়ে।
প্রকৃতপক্ষে খ্রিস্টীয় শতাব্দীর প্রথম দিকে বিদেশিরা ভারতে বসবাস শুরু করে। গ্রিক, শক ও পার্থীয়গণ আচার-অনুষ্ঠান মানত না বলে মনুস্মৃতিতে তাদের যবন বা ব্রাত্য (পতিত) বলা হয়েছে। প্রায়শ্চিত্তের মাধ্যমে তাদের হিন্দু সমাজ ব্যবস্থায় পুনর্বাসন স্বীকৃত ছিল। আচার-আচরণে তারা ভারতীয় হয়ে গেলেও ভারতীয় সমাজে তাদের আত্তীকরণ এক সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। বিদেশিরা হিন্দু সমাজে অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় গ্রিক, শক ও কুষাণগণ বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে। হিন্দুদের নিয়মিত চার বর্ণের পরে 'মিশ্র জাতি'র উদ্ভব হয়। অনুলোম (পিতা উচ্চবর্ণের ও মাতা নিম্নবর্ণের) ও প্রতিলোম (পিতা নিম্নবর্ণের ও মাতা উচ্চবর্ণের) বিবাহাদির ফলে মিশ্র জাতির সৃষ্টি হয়। অনুলোম বিবাহের ফলে জাত সন্তানের সামাজিক মর্যাদা হ্রাস পেত। প্রতিলোম বিবাহের ফলে জাত সন্তান একপ্রকার শূদ্র হিসাবেই বিবেচিত হত।
শূদ্রদের মধ্যে নিকৃষ্টতর বিভাগ হল অস্পৃশ্য। সমাজে তাদের অবজ্ঞা করা হত। বিদেশি বর্বর জাতিকে 'ম্লেচ্ছ' বলা হত। আক্রমণকারী হিসাবে তারা ঘৃণ্য বিবেচিত হলেও ভারতীয় আচার-আচরণ গ্রহণ করে তারা সামাজিক মর্যাদা লাভ করত।
গুপ্তযুগ (৩২০ খ্রিঃ-৪৬৭ খ্রিঃ)
গুপ্তযুগে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। গুপ্ত রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্রাহ্মণ্য ধর্মের নবজাগরণ হয়।
বর্ণের মতো জাতি ছিল বংশানুক্রমিক। সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে জাতি ছিল স্বতন্ত্র, নির্দিষ্ট বৃত্তিভোগী। আঞ্চলিক অবস্থান থেকে এই জাতি গড়ে উঠত।
পাল-সেন যুগে সমাজ (৭৫০-১২০৩ খ্রিঃ)
বর্ণভিত্তিক সমাজ-পাল রাজারা ছিলেন বৌখ। বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে পাল আমলে বর্ণভেদ প্রথার তীব্রতা বিশেষ ছিল না। তবু ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র-এই চার বর্ণের অস্তিত্ব মেনে নেওয়া হয়েছিল। সেন যুগে অবশ্য ব্রাহ্মণ্য ধর্ম গুরুত্ব পেয়েছিল। সেন রাজারা সমাজের উচ্চ শ্রেণির মধ্যে কৌলীন্য প্রথা প্রবর্তন করেন। কুলীনবাদ বর্ণভিত্তিক সমাজের শ্রেষ্ঠ মাপকাঠিতে পরিণত হয়। এই সময় থেকেই বাংলাদেশের সমাজে ব্রাহ্মণ ছাড়া বৈদ্য ও কায়স্থ শ্রেণির প্রভাব ও প্রাধান্য শুরু হয়। সেন যুগে বাংলায় সংকর শ্রেণির সৃষ্টি হয়। আবার এই যুগেই স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য ভেদাভেদ ছিল; তাছাড়া প্রায়শ্চিত্ত প্রভৃতি সংস্কার চালু হয়।
বর্ণভিত্তিক শ্রেণিবিভাগ ছাড়াও জীবিকা অনুসারে বিভিন্ন জাতির নাম পাওয়া যায়। মালাকার, তত্ত্ববায়, প্রামাণিক, গন্ধবণিক প্রভৃতি সম্প্রদায়ের পরিচয় পাওয়া যায়। পাল আমলে ব্রাহ্মণরা মন্ত্রী ও সেনাপতি পদেও নিযুক্ত হত, ক্রমে পাল ও সেন যুগের সমাজজীবনে একটি সামগ্রিক ঐক্যবোধ গড়ে ওঠে। এই সময় থেকেই বাংলাদেশের আধনিক হিন্দু সমাজ গড়ে উঠতে থাকে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন