বাঙালি জীবনে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান

ঊনবিংশ শতকে বাংলার সমাজ ধর্মীয় কুসংস্কার ও রক্ষণশীলতার বেড়াজালে তার প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। অন্যদিকে ব্রিটিশের নতুন ধনবাদী অর্থনীতি, নতুন প্রকৃতির শাসন, পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং ইউরোপে উদারনৈতিক দর্শন বাংলার নিদ্রাকাতর জীবনকে প্রচন্ড আঘাত করে জাগিয়ে তোলে। বাংলায় নবজাগরণের সূচনা হয়। এই নবজাগরণের মহানায়ক ছিলেন রাজা রামমোহন রায়।
    হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামে এক জমিদার বংশে তাঁর জন্ম হয়। অল্পবয়সেই তাঁর মনে স্বাধীন চিন্তার স্ফুরণ ঘটেছিল। তিনি সংস্কৃত, ফারসি, আরবি, উর্দু ও হিব্রু ভাষায় তথা ইংরেজিতেও সুপণ্ডিত। ছিলেন। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বেদ, বেদান্ত, উপনিষদ প্রভৃতিতেও তাঁর জ্ঞান ছিল প্রগাঢ়।

    সমাজ-সংস্কার


    প্রথমে রামমোহন জাতির উন্নতির জন্য সমাজ-সংস্কারকের ভূমিকা গ্রহণ করেন। তৎকালীন ধর্মজীবনে যে সকল অনাচার ও কুসংস্কার প্রচলিত ছিল তিনি তার তীব্র বিরোধিতা করেন। এই সময় হিন্দুসমাজে সহমরণ প্রথা নামে একটি কু-প্রথা প্রচলিত ছিল। এই প্রথা অনুসারে স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীকে স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় আত্মবিসর্জন দিতে হত। এইভাবে যাঁরা সহমৃতা হতেন তাঁদের সতী আখ্যায় অভিনন্দিত করা হত। কেউ কেউ সদিচ্ছায় সতী হলেও অনেককেই জোরপূর্বক স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় ফেলে দেওয়া হত। এই নিষ্ঠুর প্রথাকে বলা হয় সতীদাহ। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে রামমোহন এই প্রথার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। রামমোহনের এই মানবতাবাদী আদর্শের প্রবল সমর্থক ছিলেন তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক। শেষপর্যন্ত ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে সপ্তদশ বিধি নামে এক আইন পাস করে বেন্টিঙ্ক এই নিষ্ঠুর প্রথা নিষিদ্ধ করেন।


    স্ত্রী-শিক্ষার বিস্তার ও হিন্দু বিধবাদের পুনর্বিবাহের জন্যও তিনি চেষ্টা করেন। বিষয় সম্পত্তিতে নারীদের উত্তরাধিকারের দাবি প্রতিষ্ঠা করার ব্যাপারেও তিনি আইন প্রবর্তন করানোর চেষ্টা করেন। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, রামমোহনের অক্লান্ত সহযোগিতা ও অকুণ্ঠ সমর্থন না পেলে বেন্টিঙ্কের পক্ষে সামাজিক সংস্কারগুলির রূপদান করা সম্ভব হত না। তিনি ছিলেন ভারতে নারীমুক্তি আন্দোলনের পুরোধা।

    শিক্ষাসংস্কার


    রামমোহনের বিশ্বাস ছিল, পাশ্চাত্য শিক্ষার আলোকে শিক্ষিত হতে না পারলে ভারতীয়দের পক্ষে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে সমতালে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইনবা চার্টার অ্যাক্ট-এ ভারতে শিক্ষাবিস্তারের জন্য বার্ষিক এক লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়। এই অর্থে ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার জন্য রামমোহন তৎকালীন বড়োলাট লর্ড আমহার্স্টকে অনুরোধ জানিয়ে পত্র লেখেন। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড বেন্টিঙ্ক এদেশে শিক্ষাবিস্তারের জন্য অনুমোদিত একলক্ষ টাকা পাশ্চাত্য শিক্ষার জন্য ব্যয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কলকাতায় হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রামমোহন সক্রিয় ভূমিকা নেন।

    ইংরেজি শিক্ষার পক্ষপাতী হলেও রামমোহন ভাববিলাসীদের মতো দেশের সমগ্র মূল্যবোধকে বিসর্জন দেননি। পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার সঙ্গে তিনি বেদান্ত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি মাতৃভাষাকে কখনও অবজ্ঞা করেননি। বাংলা গদ্য সাহিত্যে তাঁর অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। রামমোহন সম্পাদিত সংবাদ কৌমুদী পত্রিকা বাংলা সংবাদপত্রে এক নবযুগ এনেছিল। রামমোহনকেই আধুনিক বাংলা সাহিত্যের জনক বলা যেতে পারে।

    ধর্মসংস্কার


    ধর্মসংস্কারকরূপেও তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। খ্রিস্টধর্ম প্রচারকদের নিন্দনীয় আচরণের বিরুদ্ধে হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির উৎকর্ষ প্রমাণ করবার জন্য তিনি বাংলা ভাষায় বেদান্তের ভাষ্য রচনা করেন। তিনি প্রমাণ করলেন যে, বেদান্ত একেশ্বরবাদের তত্ত্বে বিশ্বাসী, পৌত্তলিকতার কোনো স্থান বেদান্তে নেই। অপরদিকে তিনি খ্রিস্টানদের ঐশ্বরবাদ সম্পর্কে আলোচনা করে তীব্রভাবে আক্রমণ করলেন। একেশ্বরবাদের প্রচার করায়, গোঁড়া পৌত্তলিকতাবাদী হিন্দুরাও তাঁর ওপর অসন্তুষ্ট হলেন। শেষপর্যন্ত প্রাচীনপন্থী হিন্দুসমাজের গোঁড়ামি ও বিরোধিতায় অতিষ্ঠ হয়ে রামমোহন হিন্দুসমাজে ও ধর্মে যুগোপযোগী সংস্কার সাধনের প্রয়োজন অনুভব করলেন। হিন্দুসমাজ ও হিন্দুধর্মকে গতিশীল করার উদ্দেশ্যে তিনি ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে আত্মীয়সভা এবং ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মসভা প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর আশা ছিল যে, এই সমন্বয়বাদী আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতীয়গণের মধ্যে ভেদাভেদ দূর করা সম্ভব হবে।

    রাজনীতি


    রামমোহন ছিলেন ভারতের জাতীয়তাবাদের জনক। ভারতে রাজনৈতিক সচেতনতা উন্মেষের ক্ষেত্রেও রামমোহন উদ্যোগী হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ ও ফরাসি বিপ্লবের ভাবধারায় আস্থাশীল। যদিও তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা প্রত্যক্ষভাবে বলেননি। ১৮২৯ সালে এক জনসভায় তিনি বলেন, 

    "যত ইউরোপীয়দের সংস্পর্শে আমরা আসব, তত আমাদের সাহিত্যের, সমাজের এবং রাজনীতির জ্ঞান বাড়বে।"

    ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে প্রেস অর্ডিন্যান্সের বিরুদ্ধে মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য ইংল্যান্ডের রাজার কাছে এবং সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানান। বৈষম্যমূলক জুরি আইন বন্ধ করবার জন্য ও কৃষকদের ওপর করের বোঝা কমাবার জন্যও রামমোহন আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেন। তিনি সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও দাবি করেন। বিলাত যাত্রার প্রাক্কালে রামমোহন মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের কাছ থেকে রাজা উপাধি পান। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ভারত পথিক বলে অভিনন্দিত করেছিলেন।

    ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে ব্রিস্টলে এই যুগস্রষ্টার মৃত্যু হয়।

    মন্তব্য


    রামমোহন রায়কে বলা যায় আধুনিক ভারতের বাস্তববাদী নিয়মতান্ত্রিক সংস্কারবাদী নেতা। ভারতের জাগরণে তাঁর অসামান্য অবদান স্মরণ করে তাঁকে আধুনিক ভারতের স্রষ্টারূপে অভিহিত করলে অত্যুক্তি হয় না।

    Post a Comment

    নবীনতর পূর্বতন