ভারতে ভক্তিবাদ

ভক্তিবাদ কী?


ভক্তির ধারণা ভারতের মধ্য যুগে প্রথম নয়। প্রাচীন ভারতে জ্ঞানতপস্বী আর্য ঋষিরা জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তির সমাহারের মধ্যে মানবজীবনের সার্থকতা খুঁজে পেয়েছেন। গীতার ভক্তিযোগ মানবপ্রেম। ঈশ্বর যদি সৃষ্টিকর্তা হন তবে মানব সমাজ তাঁর সন্তান। মানবপ্রেম তাই ঈশ্বর-সেবার নামান্তর। ভক্তিবাদের মূলকথা হল আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন, অর্থাৎ মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের মিলন। মানুষকে অবজ্ঞা করার তথাকথিত কুচিন্তাগুলি, যথা-শোষণ, নিপীড়ন, কুসংস্কার, জাতিভেদ, স্বার্থান্ধতাগুলি দূর করার বাস্তব প্রয়োগই ভক্তিবাদ।

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মহাবীর, শাক্যমুনি তাঁদের অহিংসা নীতির দ্বারা কুসংস্কারাবদ্ধ যাগযজ্ঞ সার বিপথগামী ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করে মানবপ্রেমের প্লাবন এনেছিলেন।

    ঐতিহাসিক প্রয়োজন:


    মধ্য যুগে মানবপ্রেম তথা ভক্তিবাদ নতুন আলোকে দেখা গেল। মুসলিম শাসকদের হাত ধরে ভারতে ইসলামের আবির্ভাবে হিন্দু সম্প্রদায় শঙ্কিত হয়। ব্যাপক ধর্মান্তকরণ থেকে রক্ষা পেতে হিন্দু ধর্ম ব্রাহ্মণ নেতৃত্বাধীনে আরও রক্ষণশীল হয়ে পড়ল। হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে প্রভেদ গভীরতর হল। শাসক সম্প্রদায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় রাজধর্ম ইসলামের আধিপত্য বিস্তার শুরু হল। এর বিরুদ্ধে হিন্দু ধর্মের রক্ষাকবচ হিসাবে ভক্তিবাদ আবির্ভূত হল। এই প্রয়োজনীয় কাজটি পরিচালনা করলেন কবীর, রামানন্দ, নানক, শ্রীচৈতন্য প্রমুখ ভক্তিবাদী নেতাগণ।

    তাঁরা মানব হৃদয়ের বিকাশের জন্য এবং উভয় সম্প্রদায়ের রেষারেষি দূর করার জন্য ঈশ্বরলাভের সূত্র হিসাবে মানবপ্রেমকে অবলম্বন করে মহামিলনের সূত্র উদ্ভাবন করলেন। তাঁরা সর্বস্তরের মানুষেরমিলনের সূত্র হিসাবে জাতিভেদ প্রথা, কুসংস্কার, অস্পৃশ্যতাকে দূর করার চেষ্টা করলেন ঈশ্বর ভক্তির মাধ্যমে। তাঁরা হিন্দু ধর্মের সহনশীলতার দ্বার উন্মোচন করে তাকে রক্ষা করলেন।

    ভক্তিবাদ প্রচারকগণ:

    রামানন্দ:


    ভক্তিবাদের আদি প্রচারক ছিলেন সাধক রামানুজ। রামানুজের শিষা ছিলেন রামানন্দ। তিনি উত্তর ভারতে ভক্তিধর্মের প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। নিজে ব্রাহ্মণ হওয়া সত্ত্বেও তাঁর প্রধান শিষ্যদের মধ্যে ছিল নাপিত, মুচি প্রভৃতি নিম্নশ্রেণির মানুষ। তিনি জাতিভেদ প্রথাকে ঘৃণা করতেন। কবীর ছিলেন তাঁর অন্যতম শিষ্য।

    কবীর:


    মধ্য যুগে ভারতে ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান সাধক ছিলেন কবীর। তিনি ছিলেন তত্ত্ববায় শ্রেণির। বাল্যকাল থেকেই তাঁর মধ্যে দিব্যজ্ঞানের উদ্ভব হয়। পূজা, উপাসনা ইত্যাদি পরিত্যাগ করে তিনি ভক্তি ধর্মকেই গ্রহণ করেন। হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠাই তাঁর অন্যতম লক্ষ্য ছিল। তিনি ঈশ্বর ও আল্লার মধ্যে কোনো পার্থক্য করতেন না। মূর্তি পূজা, জাতিভেদ প্রথা, তীর্থযাত্রা প্রভৃতিকে তিনি ঘৃণা করতেন। কবীর তাঁর বাণীগুলি গীতিকবিতা বা দোঁহা-র আকারে রচনা-করেন।

    গুরু নানক: 


    শিখ ধর্মের প্রবর্তক গুরু নানক ছিলেন মধ্য যুগের ভক্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা। তাঁর শিষ্যদের বলা হয় শিখ। তাঁর ধর্মীয় শিক্ষার প্রথম কথা হল ঈশ্বরের অদ্বিতীয়ত্ব। তাঁর ঈশ্বর লাভের জন্য প্রয়োজন গুরুর। আর প্রয়োজন নামজপের অর্থাৎ মনে নিয়মিত ঈশ্বর স্মরণ। যারা নিয়মিত নামজপ করে তারাই পরলোকে মুক্তিলাভ করে। নানক পরলোকে বিশ্বাসী ছিলেন। হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতি ও মানুষের সমানাধিকারকে তিনি স্বীকার করতেন। স্বভাবতই তিনি ছিলেন প্রথার বিরোধী। হিন্দুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও অস্পৃশ্যতারও তিনি নিন্দা করতেন। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে মুসলমানেরাও ছিল। নানকের উপদেশ গ্রন্থ সাহেব গ্রন্থে সংকলিত হয়।

    শ্রীচৈতন্য:


    ভক্তি আন্দোলনে প্রকৃত অর্থেই এক প্লাবন সৃষ্টি করেছিলেন শ্রীচৈতন্য। বৈয়ব ধর্মের প্রচারকদের, মধ্যে তিনিই ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ। সর্বশাস্ত্রজ্ঞ ও দার্শনিক শ্রীচৈতন্য ভক্তিবাদকেই আশ্রয়, করেন। প্রকৃতপক্ষে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষাই ছিল তাঁর ধর্মীয় পথ। জীবে দয়া, ঈশ্বরে ভক্তি এবং ভক্তিভাব জাগরণের জন্য নাম সংকীর্তন-এই ছিল চৈতন্যদেবের ধর্মীয় মত। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষই আধ্যাত্মিক শক্তির অধিকারী হতে পারে-এই ছিল চৈতন্যদেবের বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের ওপর ভর করেই বাংলাদেশে তিনি ভক্তিভাবের প্লাবন এনেছিলেন।

    অন্যান্য:


    এইরূপে অন্যান্য ভক্তিবাদী নেতা নামদেব, বল্লভাচার্য, শংকরদেব, মীরাবাঈ, দাদু প্রভৃতি আরও অনেকে ভক্তি ও প্রেমকে কেন্দ্র করে ঈশ্বরসেবা করেছেন। তাঁদের পূত জীবন ও পবিত্র সান্নিধ্য সকল সম্প্রদায়কেই আকৃষ্ট করতে পেরেছিল। তাঁরা সকলেই ছিলেন জাতিভেদ প্রথার বিরোধী।

    অবদান:


    এই সব সাধু-সন্তরা যদিও হিন্দুদের বর্ণভেদ প্রথার বিশেষ কিছু পরিবর্তন করতে পারেননি, তাহলেও তাঁরা বর্ণভেদ প্রথার কঠোরতা রোধ করতে সক্ষম হন। সমকালীন ও পরবর্তী যুগের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে ভক্তিবাদের প্রভাব ছিল ব্যাপক। দীর্ঘদিন ধরে যে হিন্দু-মুসলিম বিভেদ চলছিল, ভক্তিবাদের ফলে তার তীব্রতা বহুলাংশে হ্রাস পায়।


    অবশ্য ভক্তিবাদের ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভের পেছনে ছিল তৎকালীন সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা। মুসলিম শাসক গোষ্ঠী, হিন্দু উচ্চ বর্ণের লোকেরা ছিল সামন্ত শ্রেণির। নিম্ন বর্ণের মানুষেরা ছিল কৃষক ও. কারিগর সম্প্রদায়ের। ভক্তিবাদের মাধ্যমে তারা খুঁজে পেয়েছিল নিরাপদ আশ্রয়।

    ভক্তিবাদের বিবর্তনে সমসাময়িক পরিস্থিতির প্রভাবও লক্ষ করা যায়। পরবর্তীকালে ভক্তিবাদী তুলসীদাস রামচন্দ্রের গুণকীর্তনে সংসার ধর্মপালনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। গুরু অর্জুন থেকে গুরু গোবিন্দ সিংহ শিখদের সামরিক জাতিতে পরিবর্তন করেন।

    Post a Comment

    নবীনতর পূর্বতন