সুফিবাদের উৎপত্তি:
সুফিবাদ ইসলামের মানবতা থেকেই উদ্ভূত হয়। সুফিবাদ ইসলামের বাইরে নয়। রক্ষণশীলতার আবর্ত থেকে এবং হিন্দু-মুসলমানের সমন্বয়ের বাণী দ্বারা সুফিবাদ ভক্তিবাদের মতোই উদারতার বাণী প্রচার করে। কিন্তু সুফিবাদের অবলম্বন ছিল অতীন্দ্রিয়বাদ।
আরবি সুফ শব্দের অর্থ পশম। সুফ থেকেই সুফি শব্দের উৎপত্তি। সুফি-সাধুরা পশমের বস্ত্র দ্বারা নিজেদের আচ্ছাদিত রাখতেন বলে তাদের সুফি বলা হয়।
বিভিন্ন ধর্মের প্রভাব:
হিন্দু ভক্তিবাদীরা যেমন ইসলামের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, সুফি সাধকরাও তেমনি বৌদ্ধ ধর্ম ও হিন্দু বেদান্ত দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। মধ্য এশিয়ায় বৌদ্ধ ধর্ম প্রসারিত হয়েছিল ইসলামের আবির্ভাবের আগেই। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই বৌদ্ধধর্মের দ্বারা সুফিরা কিছুটা প্রভাবিত হয়েছিলেন। সুফিবাদ হল এক মিশ্র রহস্যবাদী মতবাদ। পবিত্র কোরান ও হজরত মহম্মদই এই মতবাদের মূল উৎস। ইসলামের প্রথম পর্বেই রহস্যবাদের সূচনা হয়, পরে একেই সুফিবাদ বলা হয়। ইসলাম ধর্মের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবে উৎপত্তি হয় সুফিবাদের। আল গজালিকে গোঁড়া ও সুফি উভয় সম্প্রদায়ই যথেষ্ট শ্রদ্ধা করত। একাদশ শতকে তিনি চেষ্টা করেছিলেন উভয় মতাবলম্বীদের মধ্যে বিরোধের অবসান ঘটিয়ে একটা আপস মীমাংসার। যুক্তিবাদী দর্শনকে নস্যাৎ করে, দিয়ে আল গজালি প্রচার করেন যে, যুক্তি দিয়ে ঈশ্বরের মহিমার সম্যক জ্ঞান হয় না; তাঁর প্রকাশের মাধ্যমেই এই জ্ঞান সম্ভব।
আচরণ:
আরবগণ সিন্ধুদেশ জয় করার পর থেকেই ভারতে সুফি ধর্মের প্রসার ঘটতে থাকে। হিন্দু বা অন্যান্য ধর্মের মতো সুফি ধর্মেও গুরু-শিষ্যের সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুফি ধর্মে গুরুকে বলা হয় পির আর শিষ্যকে বলা হয় দরবেশ। সুফি সন্ন্যাসীর জীবন গুরুকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। গুরুর প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য, সকল জীবের প্রতি গভীর প্রেম, ঈশ্বরের প্রতি অকৃত্রিম ভক্তি-এই হল সুফি মতবাদের মূল আদর্শ।
একটি অংশ ইসলামের অনুশাসন মেনে চলতেন, অপর অংশ ওই অনুশাসন সম্পূর্ণভাবে মানতেন না। তাঁরা পরিব্রাজকের জীবন গ্রহণ করতেন ও জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের মঙ্গল চিন্তা করতেন। এদের অনেকেই হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই গভীর শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন।
সম্প্রদায়:
এদেশে সুফিরা কয়েকটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে। দ্বাদশ শতকে আজমিরে মইনউদ্দিন চিস্তি চিস্তি সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন। সমাজের নীচু বর্ণের মধ্যে এই সম্প্রদায় জনপ্রিয়তাঅর্জন করে। তাঁর শিষ্য শেখ কুতুবউদ্দিন কাকি ইলতুৎমিসের শ্রদ্ধা অর্জন করেন। নিজামউদ্দিন আউলিয়া ছিলেন এই সম্প্রদায়ের অন্যতম ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সাধু। পান্ডিত্য ও ধর্ম-সহিষ্কৃতার জন্য হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই তিনি শ্রদ্ধা অর্জন করেছিলেন। এই দুই সম্প্রদায়ের বহু মানুষ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। সম্রাট আলাউদ্দিন খলজি আউলিয়াকে খুব শ্রদ্ধা করতেন এবং তাঁর দরগায় মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। তাঁর প্রধান শিষ্য ছিলেন নাসিরউদ্দিন চিরাগ। ভারতে সুফিদের আর একটি সম্প্রদায় ছিল যা সুহরাবর্দি সম্প্রদায় নামে পরিচিত। এই সম্প্রদায়ের উল্লেখযোগ্য সন্ত ছিলেন শিহাবউদ্দিন সুহরাবর্দি ও হামিদউদ্দিন নাগোরি। এই সম্প্রদায় মূলত বাংলা, পাঞ্জার ও মুলতানে সীমাবদ্ধ ছিল।
চিস্তি ও সুহরাবর্দি সম্প্রদায়ের মূল পার্থক্য হল:
(১) চিন্তি সম্প্রদায় ধর্মীয় জীবনে অর্থ-সম্পদের প্রয়োজন আছে বলে মনে করতেন না, কিন্তু সুহরাবদি সম্প্রদায় অর্থ-সম্পদের ব্যাপারে নিস্পৃহ ছিলেন না।
(২) চিক্তি সম্প্রদায় রাজনীতি থেকে দূরে থাকতেন, পক্ষান্তরে 'সুহরাবর্দিরা' স্থানীয় রাজনীতি। সম্বন্ধে আগ্রহান্বিত ছিলেন।
পঞ্চদশ শতকে ভারতে আরও তিনটি সুফি সম্প্রদায়ের উৎপত্তি হয়- কাদিরি, শাক্তারি ও নকস্বন্দি। এরা শরিয়ত-বিধি মেনে চলত। এছাড়া কালন্দর নামে আরেকটি সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয় যারা শরিয়ত-বিধি অগ্রাহ্য করত।
হাফিজ, সাদি, রুমি, ওমর খৈয়াম প্রভৃতি উদারপন্থী পারসিকদের রচনায় সুফিবাদের প্রভার দেখা যায়। মোটের ওপর ইসলাম ধর্মে উদারনৈতিক সংস্কার আন্দোলন সুফিবাদে প্রকাশ পায়।
মন্তব্য:
সুফিবাদে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব থাকলেও এর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী। হিন্দু ও মুসলিম দুই বিপরীত ভাবধারায় সুফিবাদ ছিল মিলনাত্মক। সুফিবাদ রাষ্ট্রনেতাদের ধর্মীয় সহনশীলতাকে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছিল। সুফিবাদ শুধু ধর্মীয় সংকীর্ণতার প্রতিষেধক ছিল না, সমস্যাসংকুল জাতিধর্মনির্বিশেষে সকলকেই শাস্তির বারি দান করেছিল।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন