বঙ্কিম-স্মৃতি - জ্ঞানেন্দ্রনাথ গুপ্ত

কৈশোরে যখন সাহিত্য সেবায় নিযুক্ত ছিলাম ও যখন 'সাহিত্য' পত্রিকার সহযোগী সম্পাদকের ভার আমার উপরে ন্যস্ত ছিল, তখন বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে একবার গিয়াছিলাম-সে সময় তাঁহার নিকট হইতে যথেষ্ট উপদেশ ও উৎসাহ প্রাপ্ত হইয়াছিলাম। তাঁহার সহিত আমার সম্বন্ধ কতকটা পুরুষানুক্রমিক বলিতে পারি, কারণ আমার পূজ্যপাদ শ্বশুর মহাশয় রমেশচন্দ্র দত্ত যখন বঙ্কিমচন্দ্রের কাছে বাঙ্গালা রচনা করিবার ইচ্ছা ও অসামার্থ্য জানান, তখন বঙ্কিমচন্দ্র তাঁহাকে সাহিত্য সেবায় উৎসাহিত করিয়া বলেন যে, আপনাদের মত শিক্ষিত লোকের বাঙ্গালা রচনায় কুণ্ঠাবোধ করা উচিত নহে-আপনারা যাহাই লিখিবেন, তাহাই বাঙ্গালা হইবে। বঙ্কিমচন্দ্র আমার পত্নীকে তাঁহার গ্রন্থাবলী নিজ হস্তে নাম লিখিয়া উপহার দিয়েছিলেন। সে গ্রন্থাবলী আমি সযত্নে তুলিয়া রাখিয়াছি।

বহুদিন প্রবাসের ফলে যেমন দেশের সহিত সংস্রব বিচ্ছিন্ন হইয়া আইসে, তেমনই নানা কারণে বঙ্গসাহিত্যের সহিত আমার সম্বন্ধ ক্ষীণ হইয়া আসিয়াছিল। জীবনের অপরাহ্ণে সেই সম্বন্ধ দৃঢ় করিবার এই সুযোগলাভে আমি কৃতার্থ হইয়াছি।

বঙ্গবাসীর নিকট বঙ্কিমচন্দ্র এত সুপরিচিত যে, তাঁহার জীবন-বৃত্তান্ত আলোচনা করা বাহুল্য দোষযুক্ত মনে হইতে পারে। কিন্তু ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের সংখ্যা এ দেশে অতি অল্প এবং দেশবাসী তাঁহাদের স্মৃতিরক্ষণে ও তাঁহাদিগের প্রদর্শিত প্রথানুসরণে সাধারণতঃ উদাসীন। এই সকল মহাজনের জীবনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত যে কোন প্রকারে সদাসর্বদা দেশবাসীর সমক্ষে প্রদীপ্ত রাখিতে পারিলে অসাড় শরীরে প্রাণসঞ্চারের সম্ভাবনা হইতে পারে। সেই কারণ তাঁহাদিগের জীবন-বৃত্তান্তের আলোচনা নিতান্ত নিষ্ফল ও নিষ্প্রয়োজন নহে।

১৭৬১ শকাব্দে ১৩ই আষাঢ় তারিখে বঙ্কিমচন্দ্র এই ভিটায় জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যে হুগলী কলেজে বিদ্যাশিক্ষা করেন। ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দে প্রেসিডেন্সী কলেজ হইতে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বি এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াই ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদ প্রাপ্ত হয়েন। কর্মসূত্রে নানা স্থান পরিভ্রমণ করিয়া শেষজীবনে আলিপুরে আইসেন ও ১৮৯১ খ্রীষ্টাব্দে কর্ম হইতে অবসর গ্রহণ করেন।

১৩০০ সালের ২৬শে চৈত্র তারিখে দেশবাসীকে শোক-সাগরে নিমজ্জিত করিয়া তিনি দেহত্যাগ করেন।

বাল্যকাল হইতেই তাঁহার সাহিত্যানুরাগ অত্যন্ত প্রবল ছিল। পাঠ্যাবস্থাতেই পদ্য রচনা করিয়া মধ্যে মধ্যে 'প্রভাকর' ও অন্যান্য পত্রে প্রকাশ করিতেন।

সুকবি ও আমার পূর্বপুরুষ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ইঁহার প্রথম সাহিত্যগুরু। পঞ্চদশ বৎসর বয়সে "ললিতা ও মানস" নামক একখানি ক্ষুদ্র গ্রন্থ তিনি প্রণয়ন করেন। ২৭ বৎসর বয়সে তাঁহার প্রসিদ্ধ উপন্যাস "দুর্গেশ নন্দিনী" প্রকাশিত হয়। এই একখানি গ্রন্থেই বঙ্কিমচন্দ্র সর্বোচ্চ শ্রেণীর লেখক বলিয়া পরিচিত হয়েন। তাহার পর যে সকল উপন্যাস রচনা করেন, তাহার মধ্যে কোনও একখানি লিখিলেই বোধহয় তিনি অমরত্ব লাভ করিতে পারিতেন। এই উপন্যাসগুলির মধ্যে কয়েকখানি ঘুরোপীয় ভাষায় অনূদিত হইয়াছে।

১২৭৯ বঙ্গাব্দে তিনি "বঙ্গদর্শন" নামে একখানি নূতন ধরনের মাসিকপত্র প্রকাশ করিতে আরম্ভ করেন। বঙ্গে "বঙ্গদর্শন" বিদ্যালোচনা বিষয়ে যুগান্তর উপস্থিত করিয়াছিল। বঙ্কিমচন্দ্র উহার সম্পাদন ভার পরিত্যাগ করিলে ১২৬২ সালে ঐ মাসিকপত্র বন্ধ হইয়া যায়।

বঙ্কিমচন্দ্র কেবল যে উপন্যাস রচনাতেই কৃতিত্ব প্রকাশ করিয়াছিলেন, এমন নহে। "ধর্ম্মতত্ত্বে" ও "কৃষ্ণচরিত্রে" তাঁহার সূক্ষ্মদর্শিতার, দূরদর্শিতার ও সুযুক্তিপূর্ণ গবেষণার পরিচয় পাওয়া যায়।

যে সময় সাহিত্যক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের উদয় হয়, তখন অনাদৃতা, অসম্মানিতা বঙ্গভাষায় অতি দীন-মলিন অবস্থা। সেই সময় বঙ্কিম আপনার সমস্ত শিক্ষা, অনুরাগ ও প্রতিভা উপহার লইয়া সেই উপেক্ষিতা দীনহীনা বঙ্গভাষার চরণে সমর্পণ করেন। তখন নবপ্রবর্তিত ইংরাজী শিক্ষার স্রোতে সকলেই ভাসমান। ইংরাজীতে দুই ছত্র রচনা করিতে পারিলেই শিক্ষিত যুবক গর্বে স্ফীত হইতেন। বঙ্গ ভাষার প্রতি অনুরাগ গ্রাম্য বর্বরতা বলিয়া পরিগণিত হইত। সেই সময় বঙ্কিম তাঁহার সুশিক্ষা ও অসাধারণ ধীশক্তি প্রসূত ধনরত্নরাজি বঙ্গভাষায় পদে নিবেদন করেন। সৌভাগ্যগর্বে সেই অনাদর-মলিন ভাষার মুখে সহসা অপূর্ব লক্ষ্মীশ্রী প্রস্ফুটিত হইয়া উঠে। তাঁহার অলৌকিক প্রতিভার আলোকে বঙ্গবাসী বঙ্গভাষায় স্বরূপ অন্বেষণে প্রবৃত্ত হয় ও তাঁহারই উৎসাহে সাদরে মাতৃভাষার পূজা করিতে আরম্ভকরে।

সাহিত্যক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের স্থান নির্দেশ অথবা তাঁহার অশেষবিধ রচনাবলীর সমালোচনা করা আমার ক্ষমতাতীত এবং এই অভিভাষণের অভিপ্রায় বহির্ভূত। বঙ্কিমচন্দ্র যে বঙ্গ-সাহিত্যের নবযুগ প্রবর্তক, তাহা সর্ববাদিসম্মত। তিনি কেবল যে দেশব্যাপী একটি ভাবের আন্দোলন উপস্থিত করিয়াছিলেন, তাহা নহে। সেই আন্দোলন উপযুক্ত সীমা অতিক্রম করিয়া ভাষাকে বিপথে না লইয়া যায়, সে বিষয়েও তিনি বিশেষ মনোযোগী ছিলেন। প্রায় অনেক স্থলেই লেখক ও সমালোচক সম্প্রদায় স্বতন্ত্র হইয়া থাকে। কিন্তু বঙ্গসাহিত্যের যে অবস্থায় বঙ্কিমের উদয়, সে সময়ে একই লোক দুই কার্যের ভার গ্রহণ না করিলে সাহিত্য এত দ্রুত উন্নতি লাভ করিতে পারিত না। বঙ্কিম ভিন্ন আর কেহ উভয়কার্য দক্ষতার সহিত পরিচালনা করিতে পারিতেন না। এক দিকে গঠন-অপর দিকে রক্ষণ ও বিপথ হইতে নিবারণ এই দুই কার্য বঙ্কিম তাঁহার রচনা ও সমালোচনার দ্বারা একাকী করিয়াছিলেন। সাহিত্যের পক্ষে যাহা কিছু কণ্টকস্থানীয়-যাহা কিছু অমার্জনীয়, তাহা তাঁহার কঠোর কশাঘাতে ও সুতীক্ষ্ণ বিদ্রূপে নির্মূল করিতেন। সাহিত্যে উচ্চাদর্শ গঠনের ও সেই আদর্শ রক্ষণের ভার তিনি স্বহস্তেই রাখিয়াছিলেন। তাই যখন সাহিত্যের গভীর প্রশান্ত-সরোবর হইতে প্রস্রবণের প্রবল উৎস তিনি উদঘাটন করিয়াছিলেন, তখন তাহাকে উদ্দাম অপ্রতিহতরূপে প্রবাহিত হইতে দেন নাই। লেখক হিসাবে তিনি যেমন নির্মল শুভ্র সংযত হাস্যরস সাহিত্যে প্রথম আনয়ন করেন এবং হাস্যরসকে উপদ্রববিজড়িত আদি রসের এবং নিম্নশ্রেণীর প্রহসনের পংক্তি হইতে উন্নত করিয়া উচ্চতর শ্রেণীতে অধিষ্ঠিত করেন, সমালোচক হিসাবে তেমনই সুসঙ্গতি, সুরুচি ও শিষ্টতার সীমা নির্দেশ করিয়া দেন।

সাধারণতঃ একটি ধারণা অনেকের আছে যে, সরকারী কার্য করিলে মানুষ সকল কর্মের অযোগ্য হইয়া পড়ে। বঙ্কিমের জীবন অনুধাবন করিলে এই ধারণা ভিত্তিহীন বলিয়া প্রমাণিত হইবে। রাজকার্যে তাঁহাকে কখন হয় ত সাময়িক অপ্রীতিকর জীবন যাপন করিতে হইয়াছে, কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন সুখ ও শাস্তি এই জরামৃত্যু শোক-বিজড়িত সংসারে কাহারও ভাগ্যে সম্ভব হয় না এবং তিনি যে ব্যবসায়ী হউন না কেন, সুখ ও দুঃখের ভার সমভাবে তাঁহাকে বহন করিতে হয়। যিনি সেই সুখ ও দুঃখের ভার সমভাবে বহন করিয়া কর্তব্যপালনে অবিচলিত থাকিয়া জীবনসংগ্রামে জয়লাভ করেন, তিনিই প্রকৃত মহাপুরুষ। বঙ্কিমচন্দ্রের অসামান্য প্রতিভার সহিত কর্তব্যনিষ্ঠা ও অসামান্য স্বদেশ-প্রেম সুন্দরভাবে মিশ্রিত ছিল।

অধিকাংশ গ্রন্থেই তাঁহার সেই উদার হৃদয়ের স্বদেশ-প্রেমিকতার উচ্ছ্বাস সপরিস্ফুট। তাঁহার তিরোভাবের কত বৎসর পরে তাঁহারই মন্ত্রমুগ্ধ হইয়া দেশবাসী স্বদেশ-প্রেমের আবেগ অনুভব করে। তিনি বাঙ্গালার যে বিচিত্র রূপ তাঁহার মানসনেত্রে দেখিয়াছিলেন, কত বৎসর পরে সেই ছবির ছায়া আমাদের নয়নপথে উদিত হইতেছে। মঙ্গলময়ের বিধানে কত কালে-কত চেষ্টার ফলে যে সেই ছবি পরিস্ফুট হইয়া উঠিবে, তাহা কল্পনা করিতেও সাহস হয় না।

বঙ্কিমচন্দ্রের স্বর্গারোহণের অব্যবহিত পরে কবীন্দ্র রবীন্দ্রনাথ কোন শোক-সভায় আক্ষেপ করিয়াছিলেন, "আজ বঙ্কিমচন্দ্রের মৃত্যুর পরেও আমরা সভা ডাকিয়া সাময়িক পত্রে বিলাপসূচক প্রবন্ধ প্রকাশ করিয়া আপনার কর্তব্য সাধন করিতে উদ্যত হইয়াছি। তার অধিক আর কিছুতে হস্তক্ষেপ করিতে সাহস হয় না। প্রতিমূর্তি প্রতিষ্ঠা বা কোনরূপ স্মরণচিহ্ন স্থাপনের প্রস্তাব করিতে প্রবৃত্তি হয়না। পূর্ব অভিজ্ঞতা হইতে জানা গিয়াছে যে,চেষ্টা করিয়া অকৃতকার্য হইবার সম্ভাবনা অধিক। "উপুর্যুপরি বারংবার অকৃতজ্ঞতা ও অনুৎসাহের পরিচয় দিলে ক্রমে আর আত্মসম্ভ্রমের লেশমাত্র থাকিবে না এবং ভবিষ্যতে প্রবন্ধ লিখিয়া শোকের আড়ম্বর করিতেও কুণ্ঠা বোধ হইবে।"

তাঁহার মৃত্যুর ৩১ বৎসর পরে আজও তাঁহার পুণ্য জন্মভূমির উপর মর্মরপ্রস্তর মূর্তি প্রতিষ্ঠানকল্পে সাহায্যের জন্য দ্বারে দ্বারে আমাদের ঘুরিয়া বেড়াইতে হইতেছে!

রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম, ভাষা ও স্বদেশ-প্রীতি প্রবুদ্ধ করিতে স্বর্গীয় রাজা রামমোহন রায়ের পরবর্তী বোধহয় কোন বাঙ্গালীই বঙ্কিমচন্দ্রের ন্যায় অকুণ্ঠিতভাবে সাহায্য করিতে সমর্থ হয়েন নাই। দেশবাসীর সেই চিরঋণের কণামাত্র একটি মর্মর প্রতিমূর্তি প্রতিষ্ঠার দ্বারা পরিশোধ করিবার জন্য আজও আমাদের এতই লুব্ধ আশা-এতই নিষ্ফল প্রয়াস!

আমার বিশ্বাস বঙ্গবাসী-বঙ্গভাষী-সাহিত্যসেবী ও দেশকর্মী অকৃতজ্ঞতা-কলঙ্ক-মুক্ত হইতে পরাম্মুখ হইবেন না।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন