জাতিসংঘের ব্যর্থতার কারণ

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি ও ধ্বংসলীলা বিশ্ব সভ্যতার সংকট সৃষ্টি করেছিল। বিশ্বে স্থায়ী শান্তি প্রচেষ্টার জন্য জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয় (২৮শে এপ্রিল, ১৯১৯ খ্রিঃ)।




জাতিসংঘের সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতাই ছিল বেশি। জাতিসংঘের ব্যর্থতার মূলে বহুবিধ কারণ ছিল।


• ভার্সাই চুক্তির ত্রুটি: পর্যালোচনায় দেখা যায়, ভার্সাই সন্ধি ছিল জার্মানির প্রতি প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা। জার্মানি ভার্সাই সন্ধিকে কোনোক্রমেই মেনে নিতে পারেনি। অন্যদিকে আমেরিকা, রাশিয়া বা অন্য কিছু রাষ্ট্রও ভার্সাই সন্ধির শর্তগুলি মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি। জাতিসংঘের চুক্তিপত্রটি ভার্সাই সন্ধির অঙ্গীভূত বলে ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই কারণে এই রাষ্ট্রগুলি জাতিসংঘের ভাবধারাকে প্রথম থেকেই সুনজরে দেখেনি।


• অস্পষ্ট ধারণা: বিশ্বের নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘ গঠিত হয়। কিন্তু জাতিসংঘের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সংগঠকরা কোনো সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারেননি। প্রতিষ্ঠানটি ছিল সদস্যরাষ্ট্রদের প্রয়োজন সাপেক্ষ কিন্তু আন্তরিকতাহীন। প্রতিষ্ঠানটির রক্ষণাবেক্ষণ বা ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁদের চিন্তা ছিল না।


• সাময়িক সমাধান: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মারণযজ্ঞে মিত্রশক্তি বা অক্ষশক্তি উভয়েই জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। ক্রমে বিধ্বংসী যুদ্ধে তারাও ক্লান্ত হয়ে পড়ে। জার্মানির পরাজয় ও আত্মসমর্পণের সঙ্গে তারা স্থায়ী শাস্তির অনুসন্ধানে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা করেছিল। সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে বৃহৎ শক্তির বিভীষিকা দূর হলে জাতিসংঘের প্রতি তাদের নিঃস্বার্থ চিন্তাভাবনা দূর হয়। জাতিসংঘের অস্তিত্ব রক্ষার গুরুত্ব কমে যায়। তারা সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাধারা নিয়ে স্বরূপ ধারণ করে।


• আমেরিকা ও রাশিয়ার অনুপস্থিতি: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে আমেরিকা ও রাশিয়া দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে। আমেরিকা লিগের সদস্যপদ গ্রহণ করেনি। শ্রমিক শ্রেণির শাসনাধীন সাম্যবাদী রাশিয়াকে প্রথমে ধনতান্ত্রিক সদস্যরাষ্ট্ররা জাতিসংঘে প্রবেশ করতে দেয়নি। স্বাভাবিকভাবে আমেরিকা ও রাশিয়ার অনুপস্থিতি বিশ্বে জাতিসংঘের অস্তিত্বকে দুর্বল করে রেখেছিল।


• বৃহৎশক্তির খবরদারি: ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী রাষ্ট্র। বিজয়ীর অহমিকায় তারা ছিল জাতিসংঘের নেপথ্য পরিচালক। ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলিকে তাদের তাবেদারি করতে বাধ্য করা হত। তারা লিগের আন্তর্জাতিকতা ও কার্যকারিতাকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় অধিক তৎপর ছিল। মৌলিক সমস্যার সমাধান নিয়ে তাই কোনো আত্মিক ঐক্য গড়ে ওঠেনি ("Lacked the spiritual unity to cope successfully with the major issues of the day.")। এর ফলে জাতিসংঘের বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয়। ব্রিটেন ও ফ্রান্স জাতিসংঘের প্রতি একনিষ্ঠ ছিল না।


• দণ্ডহীন সমিতি: অন্যায়কারী বৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে জাতিসংঘ কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারত না। প্রকৃতপক্ষে সে ক্ষমতাও তাদের ছিল না। সাংবিধানিক ত্রুটিও জাতিসংঘকে অচল করে ফেলে। আক্রমণকারী দেশের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে সার্বিক ঐকমত্যের প্রয়োজন হত। কোনো একটি রাষ্ট্র বাধা দিলে আক্রমণকারী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শাস্তিদান বানচাল হয়ে যেত। ওই আক্রমণকারী রাষ্ট্রকে সংযত করতে জাতিসংঘকে অসুবিধায় পড়তে হত।


• সামরিক বাহিনীর অভাব: জাতিসংঘের নিজস্ব কোনো সৈন্যবাহিনী ছিল না। আন্তঃরাষ্ট্র বিরোধ উপস্থিত হলে আক্রমণকারী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ নিজস্ব সৈন্য মোতায়েন বা যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারত না। সদস্যরাষ্ট্রের সৈন্যদলের ওপর তাকে নির্ভর করতে হত। সদস্যরাষ্ট্র এই সৈন্যদল পাঠাতে বাধ্য ছিল না। স্বার্থ ছাড়া সদস্যরাষ্ট্র এই সৈন্যদল পাঠাতও না। ফলে আগ্রাসী রাষ্ট্র লিগের নির্দেশ বা আদেশ উপেক্ষা করতে সাহস পেত। স্বাভাবিকভাবেই জাতিসংঘ দুর্বল হয়ে পড়ে।


• নৈতিক বলের অভাব: জাতিসংঘের গঠন ছিল দুর্বল নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত। অন্যায়কারী রাষ্ট্রের ওপর কোনো দৃঢ় ও কঠোর নীতি সে গ্রহণ করতে যথেষ্ট অসুবিধায় পড়ত। জার্মানির নাৎসিবাদ ও ইটালির ফ্যাসিবাদের উত্থানের ফলে অবিশ্বাস, ঈর্ষা ও সন্দেহের ঘূর্ণিচক্র সৃষ্টি হয়েছিল। জাপান মাঞ্চুরিয়া (১৯৩১ খ্রিঃ) আক্রমণ করলে জাতিসংঘ কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি। জার্মানি অস্ট্রিয়া ও চেকোস্লোভাকিয়া অভিযান করলে এবং ইটালি আবিসিনিয়া দখল (১৯৩৫-৩৬ খ্রিঃ) করলে জাতিসংঘ ছিল নীরব দর্শক। জার্মানি ও ইটালিকে প্রতিরোধ করার মতো নৈতিক বল জাতিসংঘের ছিল না।


• নিরস্ত্রীকরণে ব্যর্থতা: প্রকৃত অর্থে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অন্তত সদস্যরাষ্ট্রদের নিরস্ত্রীকরণ প্রয়োজন ছিল। কিন্তু জাতিসংঘের বৃহৎ রাষ্ট্ররা কেউ নিরস্ত্রীকরণে আদৌ উৎসাহী ছিল না। জেনেভা নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলন (১৯৩২-৩৩ খ্রিঃ) ব্যর্থ হয়েছিল।


• ব্রিটেন ও ফ্রান্সের দ্বিচারিতা: ব্রিটেন লিগের সদস্য হয়েও নাৎসি জার্মানিকে তোষণ করা শুরু করেছিল। ব্রিটেনের পরোক্ষ সমর্থনে জার্মানি লিগকে অগ্রাহ্য করে ভার্সাই চুক্তি ভাঙতে আরম্ভ করে। ফ্রান্স নিজের নিরাপত্তা রক্ষার্থে জাতিসংঘকে গুরুত্ব না দিয়ে আলাদা করে লোকার্নো চুক্তি, কেলগ-ব্রিয়া চুক্তি সম্পাদন করে। ব্রিটেন ও ফ্রান্সের দু-মুখো নীতির ফলে লিগের কার্যকারিতা কমে যায়, লিগের মানমর্যাদা ও গুরুত্ব নষ্ট হয়।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কলকাতার যীশু কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা বিচার ও সংবাদধর্মীতা

মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্যের নামকরণের সার্থকতা বিচার

ঘোড়সওয়ার কবিতার সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু ও আধুনিকতার লক্ষণ