বাঙালি সংস্কৃতির স্বরূপ ও বিকাশ
আচার্য সুনীতিকুমার বিচার করে দেখিয়ে দিয়েছেন অস্ট্রিক, দ্রাবিড় ও ভোট-জাতীয় লোকেদের সঙ্গে উত্তর ভারত ও বিহারের আর্যভাষাভাষী ঔপনিবেশকদের অর্থাৎ আর্যদের সমভাষিত্বে মিশ্রিত হবার পরই বাঙালী একটি nation বা জাতিরূপে গড়ে ওঠে। অতএব বাঙালী জাতির সংস্কৃতি বল্লে এই ভিন্ন প্রজাতির মিশ্রিত সংস্কৃতিকেই বোঝায়। কিন্তু বাঙলাদেশে এক এক সময় এক একটি জাতি এসে বসবাস করবার ফলে তাদের প্রত্যেকের সংস্কৃতি প্রথমে স্বতন্ত্রভাবে এবং পর্যায়ক্রমে মিশ্রিতভাবে রূপ থেকে রূপান্তরের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে সংমিশ্রিত হতে হতে যখন চারিটি ভিন্নজাতির সমীকরণের ফলে এক অভিন্ন জাতি-রূপে পরিণত হলো, তখনই তা 'বাঙালী সংস্কৃতি' রূপে পরিচিত হবার যোগ্যতা অর্জন করলো। কাজেই বাঙালী জাতির উদ্ভবকাল-রূপে যদি খ্রীঃ অষ্টম শতাব্দীকে ধরে নেওয়া যায়, তবে তার উৎস-রূপে পাওয়া যাচ্ছে, পৃথক পৃথক ও সম্মিলিতভাবে অস্ট্রিক বা কোল-সাঁওতাল জাতি, দ্রাবিড় জাতি, ভোট-চীন এবং আর্যভাষী জাতির যে ধারাগুলি বাঙলাদেশে এসে এক জাতিত্বে পরিণত হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের স্বকীয় সংস্কৃতি এবং মিলিত সংস্কৃতিকেই। সেই বাঙালী সংস্কৃতি জড় নয়। প্রাগার্যরা বাঙলার বুকে যে সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল, আর্য-সংস্কৃতির সঙ্গে সমন্বয় হেতু তা আবার নোতুন সংস্কৃতির রূপ লাভ করে। ইতিহাসের সুদীর্ঘ পথ- পরিক্রমার কতকটা আপন স্বভাব ধর্মে কতকটা বহিঃ-প্রভাবহেতু সেই বাঙালী-সংস্কৃতি নব নব রূপে পরিবর্তিত হতে হতে আজ বিশ্ব সংস্কৃতির সঙ্গে মেলবন্ধন ঘটাতে যাচ্ছে। বাঙালী সংস্কৃতির স্বরূপ এবং তার বিকাশের একটা রূপরেখা দান প্রয়োজন।
প্রাগার্য অস্ট্রিক বা কোল-সাঁওতাল, দ্রাবিড় এবং ভোট-চীনা গোষ্ঠীর কারা কখন কোথায় এসে বাঙলার বুকে স্থায়িভাবে বসতি স্থাপন করেছিল, সে বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কারো পক্ষে কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে আর্যদের আগমন ঘটেছিল অন্ততঃ মৌর্যযুগেই, এটুকু নিশ্চিতভাবেই বলা যেতে পারে। তৎপূর্বে অর্থাৎ পূর্ববর্তী কালে বাঙলাদেশে যে সভ্যতার পরিচয় পাওয়া যায়, তা কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু-নিদর্শন। বাঙলার বিভিন্ন স্থানে যেমন পাণ্ডুরাজার ঢিবি, চন্দ্রকেতুর গড় প্রভৃতি উৎখননের ফলে আবিষ্কৃত কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু-নিদর্শন থেকে এদের উদ্ভব কাল প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার সমকাল বলে অনুমান করা হয়। এরপর আর্য আগমন ও সমভাষিতার ফলে "প্রাচীন অনার্য ভাষা, অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় স্বয়ং লুপ্ত হইয়া গিয়াছে, কিন্তু এগুলি প্রাচীন আর্যভাষার প্রকৃতিকে নানা বিষয়ে পরিবর্তিত করিয়া দিয়াছে, এবং প্রছন্নভাবে খিড়কি দরজা দিয়া বহু অনার্য শব্দ আর্যভাষায় স্থান করিয়া লইয়াছে।" নৃতাত্ত্বিক বিচারে গড় বাঙালীর দেহে রয়েছে বিভিন্ন প্রাগার্য ও আর্যজাতির মিশ্রণ এবং বাঙালীর ভাষা প্রধানতঃ আর্যকুলজাত হলেও তাতে যেমন বেশ কিছু প্রাগার্য শব্দ প্রবেশ লাভ করেছে, তেমনি বাঙলার মূলভাষা-প্রকৃতিকেও প্রাগার্য ভাষা কিছু পরিমাণে প্রভাবিত করেছে। এ ছাড়া বাঙলাদেশে বাঙালী সংস্কৃতির উদ্ভবের কালে প্রাগার্যদের উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য- ভাস্কর্য-সাহিত্য আদি কোন বাস্তব সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া যায়নি। কিন্তু যা পাওয়া যায়, তা হলো তাদের ভাবনা-কামনা, ধ্যান-ধারণা, এক কথায় তাদের জীবন চর্যায় প্রতিফলিত আচার-অনুষ্ঠান, ধর্ম-দেবতা প্রভৃতি সম্বন্ধীয় নিদর্শন। এগুলিকে তারা যে শুধু সযত্নে নিজেদের ব্যবহারে সীমাবদ্ধ রেখেছে, তা নয়, তা সমগ্রভাবে বাঙালী জাতির সম্পদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সৃজনকালে বাঙালী জাতি ঐ সংস্কৃতিরই অধিকারী ছিল এবং তার সঙ্গে আর্য সংস্কৃতির সমীকরণের ফলে বাঙালী-সংস্কৃতি পূর্ণায়ত রূপ লাভ করে। নিম্নে উভয় সংস্কৃতির কিছু পরিচয় প্রদত্ত হ'লো।
প্রাচীন আর্যজাতির তথা বৈদিক আর্যদের ধর্ম ছিল 'হবন'-মূলক অর্থাৎ যাগ- যজ্ঞানুষ্ঠানমূলক, আর অনার্য-জাতির ছিল 'পূজার্চনা' মূলক ধর্মানুষ্ঠান। এই উভয়ের সমীকরণেই পরবর্তী পৌরাণিক তথা হিন্দু ধর্মের উদ্ভব ঘটে। আর এরি ফলে হিন্দুশাস্ত্রে "যে কর্মবাদ, জন্মান্তরবাদ, যোগদর্শন ও যোগের নির্দিষ্ট সাধনা, আদ্যাশক্তির আরাধনা ও শিব-শক্তিবাদ, বিষ্ণুর আরাধনা প্রভৃতি লইয়া হিন্দুধর্মের বৈশিষ্ট্য, সে সমস্ত জিনিষ মুখ্যতঃ অনার্য ধর্মজগৎ হইতেই গৃহীত।" আমাদের লোকধর্মেরও অনেক কিছু প্রাগার্য সমাজ থেকে গৃহীত। পশ্চিম ও দক্ষিণবঙ্গে প্রচলিত ধর্মঠাকুরকে বিষ্ণু, শিব কিংবা সূর্যের সঙ্গে অভিন্নরূপে দেখাবার চেষ্টা হলেও তা যে প্রাগার্য কোল গোষ্ঠীর 'দড়াম্' (কচ্ছপ-রূপী) প্রস্তরখণ্ডের পূজা, এ সত্য অস্বীকার করবার উপায় নেই। ডোম-জাতীয় পুরোহিত, মোরগ-মদ্য প্রভৃতি পূজার উপকরণই এর অন্যতর প্রমাণ। আবার বাঙলাদেশে প্রচলিত সহজিয়া উপাসনা, তান্ত্রিকতা, ধর্ম, সর্পদেবতা মনসাপূজা, ব্যাঘ্রদেবতা দক্ষিণরায়ের পূজা প্রভৃতি বাঙালী সংস্কৃতির বিভিন্ন রূপ প্রাগার্য সমাজ থেকেই আগত। বৌদ্ধদের স্তূপ, চৈত্য-আদি, বাঙলায় তথা ভারতে আগত মুসলিমদের 'মাজার' এ সব ও দরগা প্রভৃতি প্রথাও মূলতঃ আদি অনার্য সমাজ থেকে আগত।
পাল ও সেন রাজবংশের রাজত্বকালেই প্রকৃতপক্ষে বাঙালীর জাতীয় সংস্কৃতি তার বিশিষ্ট রূপ পেতে আরম্ভ করে। মূলতঃ কৃষিভিত্তিক বাঙলাদেশে তখন কৃষি, মৎস্যশিকার এবং অল্পস্বল্প গোচারণ ছিল বাঙালীর আজীবিকার উপায়। বাঙলার বণিকেরা ক্বচিৎ কখনো বাণিজ্য ব্যপদেশে পূর্বভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে বা সিংহলে, এমন কি সুদূর পারস্য দেশে গেলেও বাঙলাদেশ কখনো স্বাভাবিক বাণিজ্যস্থল হয়ে উঠতে পারে নি। এমন কি এখানে দক্ষিণ ভারত কিংবা উত্তর বা পশ্চিম ভারতের মতো কোন বড় নগরও গড়ে উঠেনি। এখানকার অর্থনীতিক ইতিহাস বিশ্লেষণে দেখা যায়, গুপ্তযুগে এখানে আর্যবংশীয় বণিক ও ব্যবসায়ীদেরই প্রাধান্য ছিল, তবে পাল-সেন বংশের রাজত্বকালে প্রাগার্য কৃষিজীবী সম্প্রদায়ের প্রাধান্যও ক্রমস্বীকৃতি লাভ করে। খ্রী: দশম শতকের দিক থেকেই বাঙালী সংস্কৃতিতে সম্ভবতঃ নিরক্ষর ও অনার্যসমাজোদ্ভূত বাঙালী জনগণের প্রয়োজনভিত্তিক বাঙলা তথা গৌড়ীয় ভাষা সাহিত্যে ব্যবহৃত হতে আরম্ভ করে প্রধানত বেদ-বিরোধী বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্য ও নাথপন্থী সাধকদের দ্বারা; অন্যদিকে ব্রাহ্মণ্য সমাজও বৈষ্ণব ভক্তিবাদ এবং তান্ত্রিক শক্তিপূজার সঙ্গে পৌরাণিক ধর্মের সংমিশ্রণে একটা নবশক্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে সচেষ্ট ছিল। এমন সময় তুর্কী- আক্রমণ সমস্ত ভাবনা-চিন্তায় একটা বিপর্যয় সৃষ্টি করলো। ঐস্লামিক শক্তির সঙ্গে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে দেখা দিল। এ সংঘর্ষের পরিণতিতে বাঙলার সংস্কৃতিতে একটা সমন্বয় সাধিত হলো। একদিকে শরীয়তী ইস্লামের বিরুদ্ধে আত্মরক্ষার জন্য পৌরাণিক ভক্তিবাদ ও রামায়ণাদির অনুবাদ শুরু হলো, অন্যদিকে তেমনি ইসলামী উদার সুফীবাদ-প্রভাবিত একটা সাধনমার্গও বাঙালী সংস্কৃতিতে স্থান ক'রে নিল, বৈষ্ণবধর্মে, কীর্তন গানে যার প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
ইসলাম ধর্মের আগমনে বাঙালী অধিবাসীদের একটা বিরাট অংশই, তাদের মধ্যে রয়েছে বৌদ্ধ, হিন্দু এবং অনার্য প্রকৃতি-পূজকরাও ইস্লাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। কিন্তু তারা শরীয়ত পথে না গিয়ে প্রধানতঃ সুফীধারার পথিক ছিল বলেই বাঙালী সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে অসুবিধে হয়নি। বিশেষতঃ ষোড়শ শতকে চৈতন্য-প্রভাবিত বাঙালী হিন্দুসমাজও মোটামুটি এই ধারাই অনুসরণ করে চলছিল। খ্রি: ত্রয়োদশ শতকের প্রারম্ভেই বাঙলাদেশে তুর্কী আক্রমণের কাল থেকে শুরু করে মোটামুটি অষ্টাদশ শতকের মধ্যবর্তী পলাশীর যুদ্ধ পর্যন্ত সুদীর্ঘকালব্যাপী বাঙালী সংস্কৃতির এই ধারায় হিন্দু-মুসলিম বিভেদ বড় একটা ছিল না।
অষ্টাদশ শতকের শেষভাগ থেকে উনিশ শতাব্দীরও কতকটা জুড়ে বাঙলায় বিদেশীয়, বিজাতীয় ও বিধর্মীয় ইংরেজদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কালে বাঙলার রাষ্ট্র, সমাজ ও সংস্কৃতি - সর্বত্র একটা প্রবল আলোড়ন দেখা দিয়েছিল এবং সম্পূর্ণতঃ প্রভাব বিস্তার করেছিল বাঙালী হিন্দুসমাজের উপর। কারণ, ইংরেজরা মুসলমান নবাবের হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছিল বলেই সাধারণতঃ মুসলমানরা ইংরেজদের প্রতি এবং তাদের তথা পাশ্চাত্তের শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি ছিল সম্পূর্ণ উদাসীন। এই অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করে এতকালের পেছনে-পড়ে-থাকা বাঙালী হিন্দুরা মুসলমানদের ডিঙিয়ে অনেকটা সামনের দিকে এগিয়ে গেলো। উভয়ের পা আর সমতালে পড়ছে না। পাশ্চান্ত সভ্যতা-সংস্কৃতি যাতে বাঙলার গ্রাম্য সংস্কৃতিকে গ্রাস করে না ফেতে পারে, সেইজন্য বাঙালী মনীষীরা প্রাচীন ধ্রুপদী সাহিত্যের অনুশীলনীর মাধ্যমে আমাদের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত সংস্কৃতি দ্বারা গ্রাম্য সংস্কৃতিকে সবল করে তুলে তার সঙ্গে সদ্যঃ আগত পাশ্চান্ত সংস্কৃতির সমন্বয় সাধন করে বাঙলার সংস্কৃতিকে আরও পূর্ণতর, মহত্তর করে তুললেন। উনিশ শতকের মাঝামাঝি এই কালটিকেই বলা হয় বাঙালীর নবজাগরণ বা রেনেসাঁসের যুগ।
প্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত অথচ পাশ্চাক্ত ভাবধারা-পুষ্ট এই সংস্কৃতি কিন্তু প্রায় সম্পূর্ণভাবে সমাজের একাংশের অর্থাৎ হিন্দু-সংস্কৃতি, স্বল্প-সংখ্যক জাতীয়তাবাদী শিক্ষিত মুসলমান এই সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্মতার ভাব পোষণ করলেও বৃহত্তর অংশই ছিল উদাসীন। বরং তারা একটা বিচ্ছিন্নতাবাদের পথ অবলম্বন করলো। সাময়িকভাবে কখনো কখনো মুসলমানদের মধ্যে একটা দ্বিধার ভাব এলেও তার একটা প্রবলতর ধারা ক্রমে 'দ্বিজাতিতত্ত্বে'র ভিত্তিতে ভারতভূমিকে ত্রিখণ্ড করে মূল ভারতের পশ্চিম এবং পূর্বপ্রান্তস্থ দুটি খণ্ডকে মুসলিম রাজ্য পাকিস্তান রূপে গড়ে তুললো। তারা ধর্মের ভিত্তিতে জাতি ও সংস্কৃতিকে বিভক্ত করে পশ্চিমখণ্ডের প্রধানতঃ উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধুপ্রদেশ ও পাঞ্জাবের পশ্চিমাংশ নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্বদিকে বাঙলার পূর্ববঙ্গ ও উত্তরবঙ্গের কতকটা ও আসামের শ্রীহট্ট জেলা নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিল।
কৃত্রিম ধর্মের বন্ধন অপেক্ষা জাতীয় সংস্কৃতি ও ভাষার বন্ধন যে অনেক দৃঢ়, সেই অদূরদর্শী রাজনৈতিক নেতারা এই পরম সত্যকে ভুলে গিয়ে সেদিন তারা বাঙালীর সংস্কৃতিকেও দ্বিধাবিভক্ত করতে দুঃসাহসী হয়েছিলেন। ১৯৭১ খ্রীঃ পূর্ববঙ্গের বাঙালীরা পাকিস্তানের হাত থেকে মুক্তি নিয়ে আবার স্বাধীন বাঙলাদেশে পরিণত হয়েছে। আজ বঙ্গদেশ রাজনৈতিকভাবে দ্বিধাবিভক্ত হলেও ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গের ও বাঙলাদেশের তথা পূর্ববঙ্গের 'বাঙালী সংস্কৃতি' এক ও অভিন্ন।