অভিধান বিজ্ঞান (Lexicography)
আধুনিক ভাষা বিজ্ঞানে শব্দার্থ তত্ত্বে শব্দের কাল, সময়, পরিবেশগত কারণে অর্থের নানা ভিন্নতা আলোচিত হয়। এছাড়া অভিধান বিজ্ঞান, লিপি বিজ্ঞান, শিল্প বিজ্ঞান, উপভাষা বিজ্ঞানের আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ।
অভিধান বিজ্ঞান ভাষা বিজ্ঞানের একটি সমৃদ্ধ শাখা। এখানে অভিধান রচনার বৈজ্ঞানিক রীতি-পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। বর্তমানে শব্দার্থ নয়, প্রয়োগ ব্যুৎপত্তি, পদ পরিচয় ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় অভিধান রচনায় স্থান পেয়েছে। কোনো শব্দের প্রতিশব্দ কি কি, ঐ শব্দের ব্যুৎপত্তি কিরূপ, তা জানা যায় অভিধান থেকে। বস্তুত ভাষার ধ্বনিগত ও অর্থগত দিকের সংযোগ রক্ষা করে অভিধান। বহু প্রাচীন কাল থেকেই প্রায় সব দেশেই অভিধান রচনার প্রবণতা লক্ষিত হয়। যা পরবর্তীকালে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে রচনার উদ্দেশ্যে ভাষা বিজ্ঞানীরা উদ্যোগী হয়েছেন। ফল স্বরূপ বর্তমানে শব্দের উচ্চারণবিধি, প্রসঙ্গ অনুসারে অর্থের পরিবর্তন, আঞ্চলিক তথা উপভাষাগত উচ্চারণ ও অর্থ পার্থক্য অভিধান থেকে পাওয়া যায়। একসময় অভিধান বিজ্ঞানকে ভাষা বিজ্ঞানের শাখা হিসেবে বিবেচনা করা হত না। কিন্তু এখন এটি একটি সংযোগমূলক শাখা হিসেবে আধুনিক ভাষা বিজ্ঞানে স্বীকৃতি পেয়েছে।
জার্মান ভাষায় অভিধানকে বলে 'Worterbuch', এর ইংরেজী অনুবাদ Word Book. এই সূত্রে স্পষ্ট বা মৌলিক ধারণা হল অভিধানে প্রাধান্য রয়েছে শব্দ তালিকার। সংস্কৃত ভাষায় একটা অভিধানের নাম দেওয়া হয় 'শব্দকল্পদ্রুম'। যে শব্দ চাওয়া হবে এতে সে শব্দ পাওয়া যাবে। কাজেই অভিধান মাত্রই শব্দ সংগ্রাহক। 'অভিধা' কথার অর্থ 'নাম'। স্বভাবতই, ভাষার যে নাম-উপাদান, অভিধান হল তারই সংগ্রহ। যা সংস্কৃতে ছিল 'ধাতৃপাঠ' নামে পরিচিত এবং ভাষা শিক্ষার্থীর অবশ্যপাঠ্য। তখন অভিধান নয়, বলা হত 'কোষ' বা 'নামমালা'। ইংরেজী Dictionary শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে আধুনিককালে প্রচলিত হয়েছে অভিধান শব্দটি। ইংরেজীতে গ্রীক শব্দ Lexis > Lexicon থেকে আধুনিক ভাষা বিজ্ঞানে Lexicography শব্দের প্রচলন। এর অর্থ অভিধান-বিষয়ক বিজ্ঞানসম্মত চর্চা, এককথায় অভিধান বিজ্ঞান।
আধুনিক অভিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে ইংরেজ ভাষা বিজ্ঞানী ড. স্যামুয়েল জনসন সম্ভবত প্রথম অভিধান নির্মাতা। তিনি দি প্ল্যান অফ অ্যান ইংলিশ ডিক্সনারি (১৭৪৭ খ্রি.) প্রবন্ধে একেবারে বিধিবদ্ধভাবে পূর্বসুরীদের কাজের বৈশিষ্ট্য, ক্ষমতা, দুর্বলতা, অভিধান তৈরির সাধারণ প্রথা-পদ্ধতি ব্যাখ্যা করেন। ১৭৫৫ খ্রি. তৈরি করেন 'Dictionary of the English Language', জনসন পরবর্তীকালের অভিধান নির্মাতাদের জন্য সুনির্দিষ্ট নির্দেশনামাও রেখে গেছেন। পরবর্তীকালে বিশ্ব বিখ্যাত 'অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিক্সনারি' তৈরির কাজ শুরু (১৮৭৯) হয়, ১৯২৮-এ প্রকাশিত হয় অন্তিম খণ্ড। শুরু হয়েছিল জেমস্ মারের সুযোগ্য নেতৃত্বে। এরও পরে অভিধানের সম্পুরক খণ্ড নির্মাণের কাজ শুরু হয়। কম্পিউটারে তথ্য তোলার কাজ শুরু হয় ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে। 'অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিক্সনারির' দ্বিতীয় সংস্করণ প্রায় চার লক্ষ সাতচল্লিশ হাজার শব্দ ও ব্যাখ্যা নিয়ে প্রকাশিত হয় ১৯৮৯-এ, ২০টি খণ্ডে। এই ধারা অব্যাহত। নানা কারণে এটি অভিধানের জগতে মহীরূপ, এর সমতুল্য কাজ এখনও পৃথিবীর কোন ভাষায় করা সম্ভব হয়নি।
আমাদের দেশে সংস্কৃত অভিধানগুলোর রচনাকালের সঠিক তথ্য পাওয়া কঠিন। সংস্কৃত ভাষায় তিনটি অভিধান প্রধান-'নিরুক্ত', 'অমরকোষ' এবং 'নিঘন্টু'। পালি- প্রাকৃত ভাষার অভিধানগুলোর মধ্যে উল্লেখ্য-ইনপালের 'পাইঅলন্দী', 'মহাবুৎপত্তি', 'নামমালা'; হেমচন্দ্রের 'অভিধান চিন্তামণি' প্রভৃতি দ্বাদশ শতকের রচনা। পরবর্তীকালে ধনঞ্জয়ের 'নামমালা' (১১২৩-৪০) প্রভৃতি স্মরণীয়। প্রাচীন বাংলা ভাষার সঙ্গে যোগ আছে সর্বানন্দের 'টাকা সর্বস্ব' নামক শব্দ সংগ্রহের। বিখ্যাত ভাষাবিজ্ঞানী ফ্রানৎস্ বপ্ন এবং অট্টো বোয়েলিংক সংস্কৃত ভাষার একটি অভিধান জার্মান ভাষায় প্রকাশ করেন রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবুর্গে ১৯ শতকের প্রধমার্ধে। ইংরেজ পণ্ডিত মনিয়র উইলিয়মস বিশাল সংস্কৃত ইংরেজী অভিধান রচনা করেন ১৯ শতকের শেষ দিকে। যা আজও ঐতিহ্য ও শ্রেষ্ঠত্বের অঙ্গ।
প্রথম বাংলা অভিধান সংকলিত হয় ১৭৪৩-এ। সংকলক পর্তুগীজ পাত্রী মানো এল দ্য আসুম্প সাঁও। এটি পর্তুগীজ বাংলা ও বাংলা পর্তুগীজ শব্দকোষ, পৃষ্ঠা সংখ্যা প্রায় ৫০০। পরে আপজনের 'ইংরেজী ও বাঙ্গালি ভোকোবিলরি' (১৭৯৩), হেনরি পিটস্ ফরস্টারের অভিধানের ইংরেজী বাংলা অংশ (১৭৯৯), বাংলা-ইংরেজী অংশ (১৮০২)। বাঙালি রচিত প্রথম অভিধান হল-ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সহ গ্রন্থাগারিক মোহনপ্রসাদ ঠাকুরের 'বাংলা ইংরেজী ভকাবুলারি' (১৮০৫), সংস্কৃত বাংলা (১৮০৯) প্রভৃতি।
বিশ শতকের জনপ্রিয় অভিধান সুবলচন্দ্র মিত্রের 'সরল বাঙ্গালা অভিধান' (১৯০৫), রজনীকান্ত বিদ্যাবিনোদের 'বঙ্গীয় শব্দ সিন্ধু' (১৯০৭), জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের 'বাঙ্গালা ভাষার অভিধান', হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'বঙ্গীয় শব্দকোষ' (দুটিরই প্রথম প্রকাশ ১৯১৬), পরে সাহিত্য একাদেমী দু'খণ্ড নতুন সংস্করণ প্রকাশ করেছে। এছাড়া যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির 'বাঙ্গালা শব্দকোষ' (১৯১৬) প্রভৃতি। ছোট অভিধানগুলোর মধ্যে রাজশেখর বসুর 'চলন্তিকা' (১৯৩০), শৈলেন্দ্রকুমার বিশ্বাস সংকলিত 'সংসদ বাংলা অভিধান' (১৯৬১), এছাড়া আরও শব্দকোষ, সমার্থ শব্দকোষ, পকেট অভিধানের প্রকাশ ও ব্যবহার কম নয়। হাল আমলে বৈদ্যুতিন ভাষাংশের ব্যবহারও শুরু হয়েছে অভিধান তৈরির ইতিহাসে।
অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিক্সনারী থেকেই বর্ণনাত্মক দৃষ্টিকোণে রচিত হয়েও ইতিহাস সচেতনতা প্রথম থেকেই দেখা যায়। অক্সফোর্ড অভিধানে লক্ষ্য মূলত ৫টি-১. শব্দের উচ্চারণ দেখানো (IPA-এর সাহায্যে) এবং শুদ্ধ বানান দেখানো (বিকল্প সহ), ২. শব্দের উৎস নির্দেশ, ৩. শব্দের অর্থবৈচিত্র্য দেখানো (মূল অর্থ, প্রাসঙ্গিক অর্থ, পরিবর্তিত অর্থ ইত্যাদি), ৪. শব্দ প্রয়োগের ইতিহাস (কে, কবে, কোথায়, কি অর্থে সাহিত্যে প্রয়োগ করেছেন) এবং ৫. শব্দের প্রয়োগিক বৈচিত্র্য দেখানো (পদ, যৌগিক রূপ, বাক্যাংশের ব্যবহার)।
সাধারণভাবে মনে রাখা দরকার অভিধানের লক্ষ্য কী? লক্ষ্য অনেক, তাদের মধ্যে উল্লেখ্য-শব্দ তালিকা, শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণয়, শব্দের উৎস সন্ধান, প্রতিশব্দ নির্ণয়, শব্দার্থের নির্দেশ, শব্দের উচ্চারণ নির্দেশ, শব্দের বিভিন্ন অর্থে প্রয়োগের ইতিহাস, নানাভাবে বিবর্তিত ঋণ শব্দ। একটি অভিধানে এই আটটি লক্ষ্য পূরণ নাও হতে পারে। তবুও এই লক্ষ্যগুলোর নিরিখে নানা প্রকারের অভিধান রচিত হয়।
অভিধানের প্রকারভেদ প্রাচীনকালেও ছিল। আধুনিক কালে অভিধান প্রধানত দু'প্রকার-সর্বসাধারণের ও বিশেষজ্ঞজনের জন্য। আমাদের মনে হয় একমাত্র ইংরেজী ভাষাতেই ভাষা বিজ্ঞান সম্মত অভিধান রচিত হয়েছে। কিন্তু বাংলা ভাষায় বিশেষ অগ্রগতি হয়েছে এমন দাবী বোধহয় সঙ্গত নয়। উপযুক্ত উদ্যোগ, সংগঠন, নেতৃত্ব, আর্থিক সঙ্গতির অভাবে কাঙিক্ষত ফল পাওয়া হয়নি আজও। তবুও বাংলা ভাষায় বিভিন্নতর অভিধান রচিত হয়েছে ও হচ্ছে।