সেন যুগের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের গুরুত্ব আলোচনা [জ্ঞানমূলক]
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন একটি দেশের শাসন কাঠামোর প্রতিচ্ছবি। জনজীবনের মাপকাঠি, অর্থনৈতিক ভারসাম্য, শাসকদের সদিচ্ছার প্রতিফলন পড়ে ওই সময়ের জীবনযাত্রার প্রণালী ও তার বিভিন্ন অনুষঙ্গের ওপর। পাল-সেন যুগ বাংলার ইতিহাসে নতুন গতি আনে। শশাঙ্কের সাম্রাজ্যস্থাপনের কৃতিত্ব থাকলেও বাঙালি জাতির মনীষার বিকাশ হয় পাল-সেন যুগ থেকে। পাল যুগের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে যে উদারতা সৃষ্টি হয়েছিল সেন যুগে তা আরও প্রসারিত হয়। আর সেন যুগ থেকেই বর্তমান বাঙালিয়ানার সূত্রপাত।
• ধর্মঃ পাল যুগে বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের প্লাবনের পর সেন যুগে পৌরাণিক ধর্ম প্রবল হয়। জোয়ারের পর ভাটার মতোই সেই যুগে বাংলায় বৌদ্ধ ধর্ম স্তিমিত হয়ে আসে। অবশ্য এর বড়ো কারণ ছিল সেন রাজাদের পৌরাণিক ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা। সেন যুগে বিঘ্ন, শিব, পার্বতীর পূজা শুরু হয়, বহু মন্দিরও তৈরি হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আবিষ্কৃত মূর্তিগুলি থেকে মনে হয় সে সময়ে বৈয়ব ধর্মের প্রাধান্য বেশি ছিল। অন্যান্য দেবতার মধ্যে কার্তিকেয় ছিল উল্লেখযোগ্য।
• বর্ণভিত্তিক সমাজ: এই যুগে ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের বর্ণভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠে। ব্রাহ্মণভিত্তিক সমাজব্যবস্থায় ব্রাহ্মণদের স্থানই ছিল সর্বাগ্রে। বাংলার হিন্দু সমাজে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থদের মধ্যে
• কৌলীন্য প্রথার প্রচলন হয়। ব্রাহ্মণদের মধ্যে তিনটি শ্রেণি ছিল কুলীন, শ্রোত্রিয় ও বঙ্গজ। কায়স্থদের মধ্যে ছিল-কুলীন কায়স্থ ও মৌলিক কায়স্থ। কুলীনবাদ বাঙালি হিন্দু বর্ণভিত্তিক সমাজের প্রধান অঙ্গ হয়ে পড়ে। শূদ্রদের মধ্যে ছিল-উত্তম সংকর, মধ্যম সংকর ও অধম সংকর। সব বর্ণের মানুষের মধ্যে সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান ও বৈবাহিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করা হত। অন্যান্য নিম্ন শ্রেণিদের সমাজব্যবস্থায় কোনো স্থান ছিল না। জাতপাতের বেড়াজালে অর্থনৈতিক শোষণ ও সামাজিক কঠোরতায় তারা হয়ে পড়ে বঞ্চনার শিকার।
• সমাজের অশ্লীলতাঃ সেন যুগে ধনবান ব্যক্তিদের মধ্যে ব্যভিচার ও চরিত্রহীনতা লক্ষ করা যায়। পূজা-পার্বণে অশ্লীল নৃত্য-গীতের আসর বসত। সাহিত্যের ক্ষেত্রেও অশ্লীলতার উদাহরণ দেওয়া যায়। কাব্যের বিচারে জয়দেব রচিত গীতগোবিন্দম উচ্চস্তরের কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই বিষয়বস্তু অশ্লীলতায় পরিপূর্ণ।
• নারীর স্থান: সেন যুগে পুরুষ শাসিত সমাজে নারীর কোনো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল না। অনেক সময় একাধিক স্ত্রী গ্রহণ করা হত। 'সতীদাহ' ও 'সহমরণ প্রথা' প্রচলিত ছিল। বৈধব্য জীবন ছিল দুর্বিষহ। নাচ-গানে নারীর অংশগ্রহণের কথা জানা যায়। নারীদের মধ্যে বেশভূষার পারিপাট্য অলংকারপ্রিয়তা ছিল। সেন যুগে বাংলায় দেবদাসী প্রথা বিশেষ জানা যায় না।
• সাহিত্য: সন্দেহ নেই পাল যুগে বাংলায় সাহিত্যের যে মননশীলতা শুরু হয় সেন যুগে তা আরও একধাপ উন্নত হয়। সেন যুগের ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়। সামাজিক বিধি, দান- ধ্যান, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, ঈশ্বর চিন্তা এ যুগের সাহিত্যের মূল উপজীব্য হয়ে ওঠে। বল্লাল সেনের দানসাগর, অদ্ভুতসাগর; লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি হলায়ুধের ব্রাহ্মণসর্বস্ব; মীমাংসা-সর্বস্ব; ধোয়ীর পবনদূত; উমাপতি ধরের চন্দ্রচূড় চরিত এ যুগের উল্লেখযোগ্য সাহিত্য। কিন্তু, কাব্যিক বিচারে লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি জয়দেবের গীতগোবিন্দম্ সবার ওপরে এবং জয়দেবই ছিলেন এ যুগের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক। ভাষাতত্ত্বের ক্ষেত্রে সর্বানন্দের টীকাসর্বস্ব সারা ভারতে সমাদৃত হয়।
• শিল্পকলা: হিন্দু দেবদেবী ও মন্দিরকে আশ্রয় করেই বাংলায় শিল্পকলার বাতাবরণ সৃষ্টি হয়। উত্তর ভারতের চান্দেল্ল বা দক্ষিণ ভারতের পল্লব, চোল শিল্পের মতোই বাংলার শিল্পকলায় নিজস্ব বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। এই শিল্প-ভাস্কর্যের মধ্যে ছিল সহজ ও স্বাভাবিক অনুভূতি। শূলপাণি, বিষ্ণুভদ্র, কর্ণভদ্র, তথাগতসার প্রভৃতি ছিলেন এ যুগে বাংলার খ্যাতনামা শিল্পী। এছাড়া বরেন্দ্রভূমির শিল্পীসংঘ শৈল্পিক নৈপুণ্যে শিল্পী সংগ্রহের স্থান বলে বিবেচিত হত।
• খাদ্য, পোশাক, অলংকার: বাঙালির প্রধান খাদ্য ছিল ভাত, মাছ, শাক-সবজি, দুধ, মিষ্টান্ন, ফলমূল। নারী ও পুরুষের পোশাক ছিল শাড়ি ও ধুতি। অঙ্গুরীয়, কুন্তল, কণ্ঠহার, বালা প্রভৃতি ছিল বাঙালির প্রধান অলংকার।
■ সেনযুগের অর্থনৈতিক জীবন:
• কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি: নদী-নালা পরিপূর্ণ উর্বর পলিমাটিতে কৃষিই ছিল বাংলার অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মূল উপাদান। কৃষির মধ্যে ধান, পাট, আখ, তুলো ও নীল ছিল প্রধান। মার্কোপোলো বাংলায় উন্নতমানের কার্পাস উৎপাদনের কথা উল্লেখ করেছেন। এছাড়া নানা ফল-ফুলের চাষ হত। জমির ওপর চাষির স্বত্ব সম্বন্ধে বিশেষ জানা যায় না। তবে রাজাকেই প্রকৃত মালিক ধরা হত। চাষিকে নির্দিষ্ট হারে খাজনা দিতে হত। অনেক সময় ব্রাহণ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে নিষ্কর জমি দেওয়া হত। লবণ তৈরির অধিকার দেওয়া হত। পল্লিগুলি ছিল ছায়াঘন সবুজ, কাব্যিক ও প্রাণপ্রাচুর্যে পরিপূর্ণ।
• শিল্প: অর্থনৈতিক জীবনের অপর প্রধান অঙ্গ ছিল শিল্প। কুটির শিল্পই শিল্পের হাতিয়ার। এখনকার মতো বৃহদায়তন শিল্পের প্রশ্ন আসে না। তাঁত শিল্প ছিল প্রধানতম। দেশ-বিদেশে বাংলার তাঁত ও মসলিন সমাদৃত হত। কুটির শিল্পের মধ্যে বস্ত্রশিল্প, মৃৎশিল্প ও ধাতুশিল্প, পিতল-কাঁসা ও সোনা-রূপার অলংকার ছিল প্রধানতম। রাঢ় দেশের জঙ্গলের লৌহখনি থেকে লৌহ উৎপাদিত হত। চিনিশিল্প বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে পালকি, নৌকা তৈরির জন্য কাঠের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। মেদিনীপুর জেলার দাঁতন অঞ্চলের সমুদ্রের জল থেকে লবণ উৎপাদিত হত।
• বাণিজ্য: শিল্পোন্নতির সঙ্গে বাংলার বহির্বাণিজ্যও প্রসার লাভ করে। স্থলপথ ও জলপথে বাণিজ্য চলত। তাম্রলিপ্ত ও সপ্তগ্রাম ছিল প্রধান বন্দর। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ছিল বাংলার বহির্বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র। চিনি, গুড়, সুতিবস্ত্র, রেশমবস্ত্র, লবণ, ধাতুর অলংকার ইত্যাদি ছিল প্রধান রপ্তানি দ্রব্য।
• মুদ্রা: আর্থিক লেন-দেনের মাধ্যম ছিল স্বর্ণ, রৌপ্য ও তাম্রমুদ্রা। এছাড়া কড়িরও প্রচলন হয়।