শশাঙ্কের কৃতিত্ব আলোচনা কর [জ্ঞানমূলক]

গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সময় পর্যন্ত উত্তর ভারতে যে রাজনৈতিক শূন্যতা ও অস্থিরতা বিরাজ করছিল, সেই সময় অসামান্য প্রতিভা নিয়ে শশাঙ্ক বাংলাদেশে আবির্ভূত হন। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, শশাঙ্কই বাংলার প্রথম সার্বভৌম রাজা ছিলেন। তাঁর আবির্ভাব সততই বাঙালি জাতির গর্বের বস্তু। বাঙালির উত্থান পর্ব শুরু হয় শশাঙ্কের আমল থেকে। স্বল্পকালীন রাজত্বে তিনি দীপ্তি বিকিরণ করে ধূমকেতুর মতো বিলীন হয়ে যান।



■ ঐতিহাসিক উপকরণ: বাণভট্টের হর্ষচরিত ও হিউয়েন সাঙের বিবরণ থেকে শশাঙ্কের রাজত্বকাল সম্বন্ধে জানা যায়।


■ রাজ্যলাভ: সম্ভবত প্রথম জীবনে তিনি মগধ ও গৌড়ের অধিপতি গুপ্তবংশীয় মহাসেনগুপ্তের অধীনে এক সামন্ত ছিলেন। কনৌজে মৌখরী ও দাক্ষিণাত্যের চালুক্য রাজাদের ক্রমাগত আক্রমণের ফলে বাংলার গুপ্তবংশীয় রাজারা দুর্বল হয়ে পড়ে, সেই সুযোগে শশাঙ্ক বাংলার গৌড় অঞ্চলে এক স্বাধীন রাজা প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর রাজধানী ছিল মুরশিদাবাদ জেলার কর্ণসুবর্ণে (কালোসোনায়)।


■ রাজ্যবিস্তার: স্বল্পকালের মধ্যে তিনি রাজ্য বিস্তারে উদ্যোগী হন। উত্তর ভারতের উদীয়মান শক্তিগুলির সঙ্গে তাঁর সংঘর্ষ শুরু হয়। তাঁর পররাষ্ট্র নীতির লক্ষ্য ছিল কনৌজের সম্ভাব্য আক্রমণের হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করা। প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি দক্ষিণে দণ্ডভুক্তি (মেদিনীপুর), উৎকল ও কঙ্গদ (গঞ্জাম) রাজ্য জয় করেন। পশ্চিমে মগধ তাঁর করায়ত্ত হয়। স্বল্প সময়ের মধ্যে এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে তিনি মৌখরীদের সঙ্গে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন।


■ গৌড় বনাম কনৌজ ও থানেশ্বর: কনৌজের মৌখরীরাজ গ্রহবর্মা থানেশ্বরের পুষ্যভূতি বংশীয় রাজা প্রভাকরবর্ধনের কন্যা রাজ্যশ্রীকে বিবাহ করেছিলেন। মৌখরী ও পুষ্যভূতি বংশের বৈবাহিক সম্পর্ক মালবরাজ দেবগুপ্তের অস্বস্তির কারণ হয়। থানেশ্বর ও মালব রাজবংশের মধ্যে পুরুষনাক্রমিক শত্রুতা ছিল। শশাঙ্ক এই সুযোগে দেবগুপ্তের সঙ্গে মিত্রতা সূত্রে আবদ্ধ হন। এদিকে শশাঙ্কেন রাজ্যবিস্তারে আতঙ্কিত হয়ে কামরূপের রাজা ভাস্করবর্মা থানেশ্বর-কনৌজ মৈত্রী জোটে যোগদান করেন। শশাঙ্ক যোগ দেওয়ার পূর্বেই দেবগুপ্ত থানেশ্বররাজ রাজ্যবর্ধনের কাছে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। কনৌজের পথে শশাঙ্কের সঙ্গে যুদ্ধে রাজ্যবর্ধন এবং গ্রহবর্মা পরাজিত ও নিহত হন। কনৌজের রানি ও রাজ্যবর্ধনের ভগিনী রাজাশ্রী শশাঙ্কের হাতে বন্দি হন। রাজ্যবর্ধনের কনিষ্ঠ ভ্রাতা হর্ষবর্ধন শশাঙ্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। হর্ষবর্ধন ও কামরূপরাজ ভাস্করবর্মার দ্বারা আক্রান্ত হয়ে শশাঙ্ক কনৌজ পরিত্যাগ করে গৌড়ে ফিরে আসেন।


■ শাসক: শশাঙ্ক প্রায় ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন এবং নিজের সাম্রাজ্য অক্ষুণ্ণ রাখেন। রাজ্য পরিচালনায় তিনি সমান দক্ষতা দেখিয়েছেন। শশাঙ্ক ছিলেন ধর্মপ্রাণ শৈব। হিউয়েন সাঙ শশাঙ্ককে বৌদ্ধধর্ম-বিদ্বেষী বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এ কথা সত্য নয়। গৌড়ে কোনো বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী অত্যাচারিত বা ধর্মীয় বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন, এরকম কোনো প্রমাণ নেই। হয়তো হর্ষের গুণমুগ্ধ হিউয়েন সাঙ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে শশাঙ্ককে অত্যাচারী ও বৌদ্ধবিদ্বেষী প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন।


■ মূল্যায়ন: শশাঙ্কের ঘটনাবহুল জীবন বিশেষ কৃতিত্বপূর্ণ। তিনি বাংলা তথা সমকালীন উত্তর ভারতের এক বলিষ্ঠ ঐতিহাসিক চরিত্র। অজ্ঞাতকুলশীল সামান্য অবস্থা থেকে জীবন শুরু করে তিনি গুপ্তদের হাত থেকে গৌড় মুক্ত করেন। হর্ষবর্ধনের মতো পরাক্রান্ত সম্রাটের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার নিজের আধিপত্য বজায় রাখেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁর সাম্রাজ্যবাদী নীতি অনুসরণ করেই বাংলার পাল রাজারা সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। হীনম্মন্যতা নয়, যুদ্ধই প্রতিষ্ঠা আনে, শশাঙ্ক তার প্রথম উদাহরণ। গৌড় তথা বাংলাকে তিনি ভারত ইতিহাসের পাদপ্রদীপে নিয়ে আসেন। সর্ববিধ বিচারে শশাঙ্ককেই বাংলার প্রথম 'জাতীয় রাজা' রূপে আখ্যা দেওয়া যায়।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কলকাতার যীশু কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা বিচার ও সংবাদধর্মীতা

মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্যের নামকরণের সার্থকতা বিচার

ঘোড়সওয়ার কবিতার সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু ও আধুনিকতার লক্ষণ