ভূমিকা:
কোনো দেশ বা কোনো যুগের সভ্যতা বলতে বোঝায় সেই দেশের বা সেই যুগের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের ক্রমবিকাশ বা তার চালচিত্র। সভ্যতা মানুষের ক্রম-উন্নতির রূপরেখা। সভ্যতা ও সংস্কৃতি পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত। বৃহৎ অর্থে এক অঙ্গীভূত। একটিকে বাদ দিয়ে অপরটির কল্পনা করা যায় না। পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানগুলি হল সামাজিক নিয়ম, আচরণ ও কাজ। এইগুলি প্রতিফলিত হয় শিল্প (স্থাপত্য), চিত্রকলা, সাহিত্য, সংগীত ইত্যাদির মাধ্যমে।
ভারতে তুর্কি শাসনে বলা যেতে পারে ভারতের মধ্যে এশীয় তথা মুসলিম সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রবেশদ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। মোগল সভ্যতা তার প্রতিফলন হলেও ভারতীয় সভ্যতা তাকে সমৃদ্ধ করেছে। এভাবে মোগল সভ্যতা ও সংস্কৃতি এক নতুন রূপ ধারণ করেছে। এই যুগের স্থাপত্য, চিত্রকলা ও সংগীতের পরিচিতির মধ্যেই এই যুগের সভ্যতা ও সংস্কৃতির মূল ভাবটি প্রস্ফুটিত হয়েছে।
স্থাপত্য:
বাবর শিল্প, সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি দিল্লি, আগ্রা, ফতেপুর সিক্রি, গোয়ালিয়র প্রভৃতি স্থানে বিভিন্ন অট্টালিকা ও প্রাসাদ, নির্মাণ করেন। এগুলির মধ্যে পানিপথের কাবুলবাগ মসজিদ, সম্বলের জামা মসজিদের স্থাপত্য কাজ বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
আকবরের আমলে স্থাপত্য কাজের অপূর্ব নিদর্শন হল ফতেপুর সিক্রি। এই নগরীর অভ্যন্তরে রয়েছে মহাফেজখানা, দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস, পাঁচমহল, যোধাবাই-এর প্রাসাদ, জাম-ই-মসজিদ, বুলন্দ দরওয়াজা, সেলিম চিস্তির গৃহ প্রভৃতি। তিনি আগ্রার দুর্গে আকবর মহল ও জাহাঙ্গির মহল নামে দুটি অপূর্ব কারুকার্য মণ্ডিত প্রাসাদ নির্মাণ করান।
জাহাঙ্গির সেকেন্দ্রাতে আকবরের সমাধি ভবন নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করেন। এছাড়া তাঁর স্থাপত্য কাজের দ্বিতীয় নিদর্শন হল ইতিমদউদ-দৌলার সমাধি ভবন।
শাহজাহানের আমলে মোগল স্থাপত্যকলা উন্নতির চরম উৎকর্ষ লাভ করে। আগ্রার দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস, মোতি মসজিদ, শাহজাহানাবাদ শহর, তাজমহল, ময়ূর সিংহাসন প্রভৃতির নির্মাণ কাজ তাঁর গভীর শিল্পানুরাগের পরিচয় বহন করে।
চিত্রকলা:
মোগল চিত্রকলা তার নিজস্ব প্রকাশভঙ্গিতে ভারতীয় চিত্রকলায় নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, ভারতীয় ও পারসিক শিল্পরীতির অপূর্ব মিশ্রণ এই চিত্রকলাগুলিতে দেখা যায়।
বাবর নিজে ছিলেন চিত্রশিল্পের পৃষ্ঠপোষক। আকবরের আমলে বিভিন্ন প্রতিভাবান চিত্রশিল্পীর উদয় হয়। তাঁর আমলে যশোবন্ত, তারাচাঁদ, জগন্নাথ, আব্দুল সামাদ, সৈয়দ আলি প্রভৃতি খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী ছিলেন। তাঁদের অঙ্কিত চিত্রাবলি ফতেপুর সিক্রির বিভিন্ন অট্টালিকা ও স্মৃতিসৌধের শোভা বর্ধন করেছে।
জাহাঙ্গিরের আমলে মোগল শিল্পকলা পারসিক রীতির বাইরে এসে নিজস্ব রূপ ধারণ করে। এ সময়ে যুদ্ধ, শিকার, মানুষের মূর্তি, লতা-পাতা, ফুল-ফল, পশু-পাখি, জটায়ু বধ প্রভৃতি ছিল এই শিল্পের বিষয়াবলি। জাহাঙ্গির নিজে ছিলেন চিত্রশিল্পে পারদর্শী।
রাজপুত চিত্রকলা: মোগলযুগে রাজপুত রাজারা চিত্রকলার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। মোগল আঙিনার বাইরে রাজপুত চিত্রকলা নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে সুষমামণ্ডিত হয়েছিল। পুরাণ, রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনি এবং রাধাকৃষ্ণের লীলারও অভিব্যক্তি এই চিত্রগুলিতে প্রস্ফুটিত হয়েছে। এছাড়া ছিল রাজপুত রাজা-রানিদের বীরত্বপূর্ণ জীবনাবলি ও ধর্মীয় আখ্যায়িক চিত্রণ। এই চিত্রগুলির এক বিশিষ্ট রূপ দেখা যায় কাংড়া উপত্যকায়। সে জন্য তা পাহাড়ি চিত্রকলা নামেও খ্যাত।
সাহিত্য:
সাহিত্য সমাজের দর্পণ। মোগল সাহিত্যগুলি বেশিরভাগ ছিল একাধারে ইতিহাস গ্রন্থ ও মোগল সমাজ-সভ্যতার পরিচয় জ্ঞাপক। আবার সাহিত্যগুলি ছিল মূলত আত্মজীবনী বা জীবনী মূলক। বাবরের তুজুক-ই-বাবরি এবং জাহাঙ্গিরের তুজুক-ই-জাহাঙ্গিরি আত্মজীবনী গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। হুমায়ুনের ভগিনী গুলবদন বেগম রচিত হুমায়ুননামা, আবুল ফজল রচিত আকবরনামা মহম্মদ কাজিম রচিত আলমগিরনামা জীবনী গ্রন্থগুলি ছিল এ যুগের সম্পদ। অন্যান্য গ্রন্থগুলির মধ্যে সাহিত্য সৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য ছিল আকবরের আমলে আবুল ফজল রচিত আইন-ই-আকবার, বদায়ুনি রচিত মুন্তাখাব-উল-তারিখ, নিজামুদ্দিন রচিত তবাকৎ-ই-আকবরি, ফেরিস্তা রচিত তারিখ-ই-ফেরিস্তা ফৈজি রচিত আকবরনামা, জাহাঙ্গিরের আমলে আবদুল হামিদ লাহোরি রচিত পাদশাহনামা: শাহজাহানের আমলে এনায়েত খাঁ রচিত শাহজাহাননামা, ঔরঙ্গজেবের আমলে কাফি খাঁ রচিত মুস্তাখাব-উল-লুবাব, ফতোয়া-ই-আলমগিরি, মহম্মদ সাকি রচিত মাসির-ই-আলমগিরি প্রভৃতি গ্রন্থ বিখ্যাত। এই সকল গ্রন্থ মোগল আমলের ইতিহাস রচনার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
মোগল শাসকরা ছিলেন ফারসি ভাষার বিশেষ পৃষ্ঠপোষক। সংস্কৃত ভাষায় সুপন্ডিত দারাশিকোর পৃষ্ঠপোষকতায় উপনিষদ, গীতা, বেদ ফারসি ভাষায় অনূদিত হয়। আকবরের 'নওরতন' বা নবরত্ন সভা ছিল তাঁর আমলে মোগল সংস্কৃতির পরিচায়ক।
সংগীত:
মোগল আমলে হিন্দুস্তানি ও উচাঙ্গ সংগীতের সবিশেষ উন্নতি হয়। বাবর সংগীত পছন্দ না করলেও হুমায়ুন কণ্ঠ ও যন্ত্র সংগীতের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। আকবরের রাজসভায় বিভিন্ন জাতির ৩৬ জন সংগীতজ্ঞ দরবারে উপস্থিত থাকতেন। বিভিন্ন সংগীতের তাল, লয়, রাগিণী তাঁকে আকর্ষণ করত। মিয়া তানসেন ছিলেন তাঁর দরবারের শ্রেষ্ঠ সংগীত শিল্পী। তিনি মল্লার, সবঙ্গ প্রভৃতি রাগের সূচনা করেন। বৈজু বাওড়া ও সুরদাস ছিলেন তাঁর আমলে অপর দুই সংগীতজ্ঞ। জাহাঙ্গির সংগীত ও নর্তকী দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকতেন। শাহজাহান নিজেই অনেক সংগীত রচনা করেন। আঞ্চলিক সংস্কৃতি: মোগল যুগে আঞ্চলিক সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিশেষ বিকাশ পরিলক্ষিত হয়।
শিল্পকলা:
উত্তর ভারত:
এই যুগে রাজপুত শিল্পকলার বিশেষ উন্নতি দেখা যায়। পাঞ্জাবের কাংড়া উপত্যকাতেও এই শিল্পের প্রসারতা লাভ করে। ধর্মীয় কাহিনি, শিকার, যুদ্ধ প্রভৃতিকে উপজীব্য করে রং ও তুলির কাজে বিভিন্ন চিত্রকলার নিদর্শন ছিল অপূর্ব।
বাংলা:
মোগল আমলে বাংলায় নির্মিত বিভিন্ন মসজিদ, সমাধি, স্তম্ভ, তোরণ বাংলা স্থাপত্য শিল্পের পরিচয় বহন করে। এগুলির মধ্যে মালদহের মসজিদগুলি, নারায়ণগঞ্জের বিবি মরিয়মের মসজিদ, চট্টগ্রামের বায়াজিদ মসজিদ প্রভৃতি বিখ্যাত।
সাহিত্য:
মোগল আমলে বিভিন্ন আঞ্চলিক সাহিত্যের বিকাশ হয়।
হিন্দি:
এই সময়ে হিন্দিভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি ছিল গোস্বামী তুলসীদাস রচিত রামচরিত মানস, এছাড়া কবীরের দোঁহা, মহম্মদ জয়সির পদ্মাবৎ ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সুরদাস ছিলেন ব্রজ ভাষায় শ্রেষ্ঠ কবি, হিন্দি সাহিত্য মোগল রাজদরবারে বিশেষ সমাদর লাভ করে।
উর্দু:
হিন্দি ও ফারসি ভাষার সংমিশ্রণে উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের আত্মপ্রকাশ হয়। উর্দু ভাষা ভারতীয় মুসলিম সমাজের কথ্যভাষা হয়ে দাড়ায়। উর্দু শায়ের সকলের কাছেই জনপ্রিয় হয়। বিজাপুর ও গোলকুন্ডায় উর্দু ভাষা বিশেষ সমাদর লাভ করে। আরজু ও ওয়ালি খানু ছিলেন বিশিষ্ট উর্দু কবি।
বাংলা:
মোগল আমল ছিল বাংলা সাহিত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই যুগে বাংলা ভাষায় বৈয়ব সাহিত্যের বিশেষ প্রসার হয়। কাশীরাম দাস মহাভারত বাংলায় অনুবাদ করেন। বিভিন্ন মঙ্গলকাব্য এসময়ে রচিত হয়। চন্ডীমঙ্গল রচনা করেন মুকুন্দরাম।
মারাঠি:
রামদাস, তুকারাম প্রভৃতি লেখকরা মারাঠা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন। তাঁদের প্রধান কীর্তি ছিল ধর্মীয় সাহিত্য রচনা করা।
গুজরাটি ও ওড়িয়া:
এই দুই সাহিত্য প্রধানত রাধা-কৃষ্ণ লীলাকে কেন্দ্র করে রচিত হয়।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন