চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত

    আগের কথা

    ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লাভ (১৭৬৫ খ্রিঃ) ছিল বাংলায় তাদের রাজস্ব আদায়ের প্রাথমিক পদ্ধতি। কোম্পানি বাংলায় রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করে কোম্পানির খরচ নির্বাহ এবং স্বাচ্ছন্দ্য বিধানের জন্য প্রথমেই রাজস্ব আদায়ে নজর দিয়েছিল। কোম্পানির দ্বৈত শাসনে রেজা খাঁ ও সিতাব রায় অমানুষিকভাবে কৃষকদের ওপর অত্যাচার করে কোম্পানির ঘরে রাজস্ব জমা দিতেন। স্বাভাবিক বেনিয়াবৃত্তির ইংরেজ কোম্পানি জনজীবন বা কৃষককূলের ওপর সহানুভূতিশীল ছিল না। কিন্তু বাংলায় অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং ভয়াবহ ছিয়াত্তরের মন্বন্তর দেখা দিলে কোম্পানির দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়। পরবর্তী শাসনকর্তা ওয়ারেন হেস্টিংস এই রাজস্ব আদায়কে একটি নিয়মবন্ধ কাঠামোর ওপর দাঁড় করান। কৃষকের ওপর কর্মচারীদের অর্থ আদায়ের জন্য অত্যাচার তিনি রোধ করেছিলেন সত্য, কিন্তু তাঁর নিয়মবদ্ধ পরীক্ষাগুলি যথা পাঁচসালা, একসালা, দশসালা বন্দোবস্ত বা এই বন্দোবস্তের সুচারু রূপায়ণের নিমিত্ত আমিনি কমিশনের কাজগুলি ছিল জটিল ও ত্রুটিপূর্ণ। কোম্পানির আয় এতে আশানুরূপ বৃদ্ধি পেল না। কৃষকদেরও জমিদার কর্তৃক নির্ধারিত রাজস্ব দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না। মধ্যস্বত্বভোগীরাই (ইজারাদার) বেশি লাভবান হত।

    বন্দোবস্তের কারণ

    মূলত কোম্পানির রাজস্ব আয় আরও বৃদ্ধি, নিয়মিত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ করার জন্য ইংল্যান্ডের ভূম্যধিকারী সন্তান বাংলার তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস (১৭৮৬-৯৩ খ্রিঃ) আরও পরিকল্পিতভাবে ভূমিরাজস্ব আদায়ের পদ্ধতি প্রবর্তন করেন।

    চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কী নিলামের মাধ্যমে সর্বোচ্চ হারে কোম্পানিকে রাজস্ব আদায়ের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার ভিত্তিতে তিনি জমির মালিকানা দিতেন জমিদারদের। শর্ত ছিল নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের পূর্বে কোম্পানির রাজস্ব দপ্তরে প্রদান করতে হবে। এই পদ্ধতি জমিদারদের পক্ষে যথাযথ থাকলে তিনি স্থায়ীভাবে জমির অধিকারী থাকবেন। 'চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত' নামে এই ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় (১৭৯৩ খ্রিঃ)।

    অন্যান্য কারণ

    লর্ড কর্নওয়ালিস চিন্তা করেন যে চিরস্থায়ী ব্যবস্থা প্রবর্তিত হলে ভূমি-আয়ের অনিশ্চয়তা কমবে এবং জমিদারদের কোম্পানির প্রতি আনুগত্য বাড়বে। ফলে শাসনকার্য আরও সুষ্ঠুভাবে চালানো যাবে। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন, 

    "চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত থেকে আদায়িকৃত অর্থ কোম্পানির সাম্রাজ্য বিস্তার, যুদ্ধ পরিচালনা এবং বাণিজ্যিক কারণে বিশেষ প্রয়োজন ছিল। এই প্রথায় আদায়িকৃত অর্থের শতকরা ৯০ ভাগই জমিদারদের কোম্পানির হাতে তুলে দিতে হত"।**
    তথ্যসূত্র - Economic History of India. Vol-1.

    সমাজজীবনে প্রভাব

    প্রথমত,
    এই বন্দোবস্তের ফলে জমিদার ও রাজস্ব আদায়কারী মধ্যস্বত্বভোগীরাই জমির প্রকৃত মালিক হয়ে ওঠে। কৃষকশ্রেণি সব কিছু হারিয়ে খাজনা দেওয়ার যন্ত্রে পরিণত হয়। এমনকি খাজনা আদায়ের জন্য জমিদারেরা কৃষকদের ওপর অমানুষিক অত্যাচার করত।

    দ্বিতীয়ত, 
    জমিদারদের রাজস্ব প্রদান নির্দিষ্ট হলেও কৃষকদের ক্ষেত্রে তা নির্দিষ্ট হয়নি। তাই কৃষক সমাজের ভবিষ্যৎ হয়ে পড়ে একান্ত অনিশ্চিত।

    তৃতীয়ত,
    জমিদারশ্রেণি জমির স্থায়ী অধিকারী হয়ে জমির উন্নতিতে মন দেয়, ফলে অন্যান্য শিল্পে এই অর্থবান লোকদের লগ্নি কমে যায় এবং শিল্পবাণিজ্য খুব ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে কুটিরশিল্পের অবনতি হওয়ায়, বৃত্তিধারীরা বেকার হয়ে পড়ে এবং সমাজে দারিদ্র্য বৃদ্ধি পায়।

    চতুর্থত, 
    কুটিরশিল্প বিনষ্ট হওয়ায় বহু কারিগর ও শিল্পী শ্রেণির লোক বংশানুক্রমিক পেশা হারিয়ে ভূমিহীন কৃষকে পরিণত হয়। গ্রামের এই আর্থসামাজিক পরিবর্তন লক্ষ করে কার্ল মার্কস তাঁর British Rule in India গ্রন্থে লেখেন, "এই আর্থিক পরিবর্তন সামাজিক বিপ্লব আনে"।

    পঞ্চমত, 
    কৃষকদের আর্থিক দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে বাংলার সমাজজীবনে মহাজন ও সুদখোর শ্রেণির আবির্ভাব হয়। এই মহাজনেরা মোটা সুদে কৃষকদের ঋণ দিতে এগিয়ে আসে এবং স্বাভাবিকভাবেই অনাদায়ী ঋণের জন্য কৃষকদের জমি দখল করে নেয়। এতে গ্রামীণ জনজীবন এক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। ঐতিহাসিক হোমসের মতে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল একটি দুঃখজনক ভুল।।

    ষষ্ঠত, 
    আবার সূর্যাস্ত আইনের (Sunset Law) কঠোরতায় অনেক সম্ভ্রান্ত ও ঐতিহ্যবাহী জমিদার তাঁদের জমিদারি হারান। ওই স্থান পূর্ণ করে শহরে ভুঁইফোঁড় অর্থবান বেনিয়া ও মুৎসুদ্দি সম্প্রদায়। গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ছিল না।

    সপ্তমত, 
    গ্রামের সঙ্গে শহুরে নবীন জমিদারদের যোগাযোগ না থাকায় তাঁদের জমিদারির কোনোরকম উন্নতি হত না। ফলে ওই গ্রামীণ জমিদারি হয়ে পড়ত আরও দীনহীন। এখানে তাঁদের নিয়োজিত গোমস্তারাই প্রজাদের অত্যাচার করত।

    কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উদ্ভাবক নন কেন?

    লর্ড কর্নওয়ালিস কিন্তু এই ব্যবস্থার উদ্ভাবক ছিলেন না। 'বোর্ড অব্ ডাইরেক্টরস' এবং 'বোর্ড অফ কন্ট্রোল'-এর সভাপতি স্যার হেনরি ডানডাস এদেশের ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার করে চিরস্থায়ী ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলা-বিহারে এবং ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে ওড়িশায় তিনি দশসালা ব্যবস্থা চালু করেন। এই ব্যবস্থাকে চিরস্থায়ী করার অন্য চার্লস গ্রান্ট, অন শোর প্রমুখের সঙ্গে তিনি পরামর্শ করেন। মূলত জমিদার ও কোম্পানির মধ্যে এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত গড়ে উঠেছিল বলে একে 'জমিদারি বন্দোবস্ত'ও বলা হয়।

    "It was a change in the property relation which caused the social revolution"-Karl Marx.

    এভাবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত সমাজজীবনে বিশেষ কিছুই মঙ্গল না করে ভারতের ঐতিহ্যবাহী সমাজজীবনকে আরও বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দেয়। এককথায় বাংলার সমাজজীবনে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ছিল এক অভিশাপ।

    মন্তব্য:

    চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ইতিহাস হল জমি-কৃষক উচ্ছেদের ইতিহাস। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থেই জমিদার সৃষ্টি হয়েছিল। এই বন্দোবস্ত চিরাচরিত সরল গ্রাম্য জীবনের শান্তি বিঘ্নিত করে।

    Post a Comment

    নবীনতর পূর্বতন