প্রাচীনকাল থেকেই এমনকি মোগল যুগে ভারতের বস্ত্রশিল্প ছিল বিশ্ববিখ্যাত। ভারতীয় অর্থনীতিতে এক বিরাট ভারসাম্য রক্ষা করত এই বস্ত্রশিল্প। ইংরেজ বেনিয়াদের অতিরিক্ত লোভ ও মুনাফা লাভের চেষ্টা, সর্বোপরি তাদের সাম্রাজ্যবাদের নগ্নতা ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের পরিবেশকে নষ্ট করে এবং এই শিল্পের ধ্বংসসাধনকে ত্বরান্বিত করে। মূলত পলাশি ও বক্সারের যুদ্ধের পর থেকে ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের অবক্ষয় শুরু হয়।
বস্ত্রশিল্পের অবনতির কারণ:
প্রথমত, তাঁতিদের ওপর অত্যাচার:
পলাশির যুদ্ধের পর থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে বাংলায় শোষণ ও অত্যাচার শুরু করে। কোম্পানির কর্মচারীরা নামমাত্র মূল্যে দেশীয় ব্যবসায়ীর জিনিসপত্র জোর করে নিয়ে যেত। তাঁতিদের ক্ষেত্রেও কোম্পানির এই অত্যাচার ও বলপ্রয়োগ আরও বেশি করে প্রযুক্ত হয়েছিল।
কোম্পানির দালালরা তাঁতিদের একমাত্র কোম্পানির জন্য বস্ত্র বুনতে বাধ্য করত। জোর করে তাঁতিদের অগ্রিম নিতে বাধ্য করা হত। তাঁতিরা বাজারদর থেকে অনেক কম মূল্যে কোম্পানির কাছে বস্ত্র বিক্রয় করতে বাধ্য থাকত। এককথায় বাংলার তাঁতি কোম্পানির লালসা, বঞ্চনা ও অত্যাচারের শিকার হয়। তারা অর্থকষ্ট, অনাহার থেকে মুক্তি পেতে অন্য বৃত্তি গ্রহণ করে।
লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক নিজেই তাঁতিদের নিদারুণ অবস্থা বিবৃত করেছেন,
"ব্যাবসার ইতিহাসে এই করুণ অবস্থার নজির নেই, সুতিবস্ত্র উৎপাদনকারীদের হাড় ভারতবর্ষের মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছিল।""The misery hardly finds a parallel in the history of commerce. The bones of the cottonweavers are bleaching the plains of India."
দ্বিতীয়ত, ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব:
ইংল্যান্ড তথা ইউরোপে ছিল ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের বিশাল বাজার। ইউরোপীয় বণিকেরা ভারতীয় পণ্য ক্রয় করে ইউরোপে রপ্তানি করত। ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব শুরু হলে এই অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন হল। যন্ত্রচালিত সুতিবস্ত্রের উৎপাদন ও জোগান এত বেশি বেড়ে গিয়েছিল যে তার সঙ্গে ভারতীয় কুটিরশিল্পের প্রতিযোগিতা করা সম্ভব ছিল না। ব্রিটিশ বস্ত্রশিল্পের উৎপাদন এত বৃদ্ধি পেয়েছিল যে ভারতীয় বস্ত্রশিল্পকে রক্ষা করা অসম্ভব ছিল। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র দত্তের ভাষায়,
"ইউরোপের পাওয়ার লুমের আবিষ্কার ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের পতন সম্পূর্ণ করে"।"The invention of powerloom completed the decline of Indian industries." -R. C. Dutta.
তৃতীয়ত, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের নীতি:
ভারতের সম্পদ লুণ্ঠনের ফলেই ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব সম্ভব হয়। কারণ, ইংল্যান্ডের বস্ত্রশিল্পের কাঁচামাল জোগাত ভারত। ভারতের লুণ্ঠিত অর্থ শিল্পবিপ্লবে বিনিয়োগ করা হত। ইংল্যান্ডে উৎপাদিত বস্ত্র বিক্রয়ের জন্য, ইংল্যান্ডের স্থানীয় বণিকদের স্বার্থে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট তাদের দেশে ভারতীয় বস্ত্রের রপ্তানি আইন করে বন্ধ করল। ভারতীয় বস্ত্রের মূল বাজার ছিল ইংল্যান্ড। রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় ভারতীয় বস্ত্রের উৎপাদনও মারাত্মকভাবে হ্রাস পেল।
চতুর্থত, কোম্পানির অনীহা:
এই অবস্থায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বস্ত্রশিল্পকে রক্ষা করার কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা নিল না। তাদের অনীহা বা অক্ষমতা বস্ত্রশিল্পকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতীয় বস্ত্রশিল্পকে অসম প্রতিযোগিতা থেকে রক্ষা করার কোনো চেষ্টাই করেনি। বরং তারা ভারতীয় বস্ত্রশিল্পে অন্তরায় সৃষ্টি করে।
পঞ্চমত, ব্রিটিশ শুল্ক নীতি:
ব্রিটিশ সরকারের শুল্ক নীতিও ভারতীয় বস্ত্র উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রতিকূলতা সৃষ্টি করেছিল। ব্রিটিশ সরকার ভারত থেকে ইউরোপে বস্ত্র রপ্তানির ওপর চড়া শুল্ক ধার্য করে। পক্ষান্তরে, ব্রিটেন থেকে ভারতে আমদানিকৃত বস্ত্রের ওপর শুল্ক ছিল নামমাত্র। ডঃ বি. ডি. বসু তাঁর Ruin of Indian Trade গ্রন্থে লেখেন যে, মূলত মাত্রাতিরিক্ত শুল্কের বোঝার জন্য প্রতিযোগিতায় ভারতীয় বণিকরা বিপর্যস্ত হয়।
ষষ্ঠত, কাঁচামালের দেশ:
ব্রিটিশ সরকার বেনিয়া স্বার্থে ভারতকে প্রস্তুতকারীর দেশ থেকে কাঁচামাল উৎপাদনকারী দেশে পরিণত করে। শিল্পবিপ্লবকে বাঁচিয়ে রাখতে, ম্যাঞ্চেস্টার (ইংল্যান্ড)-এর বস্ত্র উৎপাদনকারী মিলগুলিকে বাঁচিয়ে রাখতে এই পন্থা নিতে হয়েছিল।
সপ্তমত, কম মূল্যে মিলের কাপড়:
ইংল্যান্ডের উৎপাদিত মিলের কাপড় ভারতের বাজারে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে বিক্রি হতে থাকে। কম মূল্যে সাধারণ মানুষ তাদের ব্যবহার উপযোগী বস্তু ক্রয় করতে পারে। অপরদিকে, ভারতীয় তাঁতিদের হাতে বোনা কাপড় উৎপাদন ব্যয় বজায় রেখে এত কম মূল্যে বিক্রি করা সম্ভব ছিল না।
অষ্টমত, দুর্বল সংগঠন:
ভারতীয় বস্ত্রশিল্প ছিল দুর্বল, শিল্পীদের আর্থিক সচ্ছলতা ছিল না। ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের বিশেষ কোনো সংগঠন ছিল না, যারা সংঘবদ্ধভাবে তাদের শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করতে পারে না। এছাড়া ভারতীয় বস্ত্রশিল্প উৎপাদনও যুগোপযোগী ছিল না। উপরন্তু যুগের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার ক্ষমতাও ছিল না। নতুন বাজার অনুসন্ধান করার মানসিকতা বা উদ্যোগ কোনোটাই এই শিল্পের ছিল না।
নবমত, বিদেশি প্রভুত্ব:
ইংরেজদের প্রভুত্ব অর্জনের পূর্বেই ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য চলে যায় বিদেশিদের হাতে। ভারতের কারিগর, শিল্পী ও উৎপাদকরা রপ্তানির জন্য তাদের ওপরই নির্ভরশীল ছিল। এই অবস্থায় ইংল্যান্ড ও অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলির সংরক্ষণ নীতি ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের বিপর্যয় ডেকে আনে।
ফলাফল:
প্রথমত, ভারতীয় বস্ত্রশিল্প ধ্বংসের ফলে ভারতীয় তত্ত্ববায় সম্প্রদায় অর্থনৈতিকভাবে একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। অভাবের তাড়নায় অনেকেই কৃষিজীবীতে পরিণত হন।
দ্বিতীয়ত, ভারতীয় বস্ত্রশিল্প ছিল বিশ্ব গুণমানে শ্রেষ্ঠ। অভাবের তাড়নায় হারিয়ে গেল শিল্পীর শিল্প নৈপুণ্য। সূক্ষ্ম মসলিন কাপড় হয়ে রইল ইতিহাস। অবক্ষয়ের সঙ্গে একটি শৈল্পিক সত্তাও ধ্বংস হল।
তৃতীয়ত, এই শিল্পের সঙ্গে পরোক্ষভাবে যুক্ত মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। সুতা কাটুনি, রঞ্জক, ধুনারি প্রভৃতি বৃত্তিধারীরা বেকার হয়ে পড়ে।
চতুর্থত, কর্মচ্যুত বস্ত্রশিল্পীরা জীবন ধারণের তাগিদে কৃষিকাজ শুরু করলে কৃষিতেও চাপ সৃষ্টি হয়। কৃষিজমি নিয়ে বিরোধ শুরু হল।
পঞ্চমত, বস্ত্রশিল্পের ধ্বংসের সঙ্গে অন্যান্য কুটিরশিল্পও বিপর্যয়ের সম্মুখীন হল। আর কুটিরশিল্পের ধ্বংসের ওপর গড়ে ওঠে ব্রিটিশ ভারতে বৃহদায়তন শিল্প কারখানা। কুটিরশিল্পে নিয়োজিত শিল্পীরা পরিণত হল শৃঙ্খলিত শ্রমিকে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন