বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন

ভূমিকা

কংগ্রেসের জন্মলাভে (১৮৮৫ খ্রিঃ) ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় আন্দোলনের সূচনা হয়। জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বদানে বাংলা ছিল প্রথম সারিতে। নরমপন্থী, চরমপন্থী বা ব্রিটিশ-বিরোধী সন্ত্রাসবাদে মুখ্যত বাঙালিরাই ব্রিটিশ প্রশাসনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। সরকার প্রতিক্রিয়াশীল নীতি দ্বারা বাংলায় মারণাস্ত্র প্রয়োগ করে। এই অস্ত্র ছিল রাজনৈতিক চক্রান্ত যা বঙ্গভা নামে পরিচিত।

    আন্দোলনের সূচনা

    সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্য নিয়ে ভাইসরয় লর্ড কার্জন ১৯০৫ সালের ১৯শে জুলাই বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলে সমগ্র বাংলাদেশে এক তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে তা বাতিলের দাবি জানানো হয় বিভিন্ন সভা-সমিতিতে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এই সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করা হয়। বজাভঙ্গের প্রতিবাদে প্রায় দুই হাজার সভা অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন গ্রামে-গঞ্জে। কলকাতা টাউন হলে এক বিশাল জনসমাবেশে ব্রিটিশ পণ্যসামগ্রী বর্জনের সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হয়। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে ১৬ই অক্টোবর বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে সর্বত্র শোকের চিহ্নস্বরূপ অরন্ধন পালন করা হয়। রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে অবিচ্ছেদ্য ঐক্যের অঙ্গীকার করে সর্বস্তরের জনগণ রাখিবন্ধন দিবস পালন করে।

    আন্দোলনের কর্মসূচি

    বয়কট বা বিদেশি পণ্য বর্জন ও স্বদেশি দ্রব্য ব্যবহার ছিল স্বদেশি আন্দোলনের দুটি অবিচ্ছেদ্য কর্মসূচি। এই কর্মসূচি দুটি পরস্পরের পরিপূরক ছিল। বয়কট ছিল নেতিবাচক, অপরপক্ষে স্বদেশি ছিল ইতিবাচক। বিদেশি পণ্যসামগ্রী বর্জনের মূল লক্ষ্য ছিল যে, বয়কট আন্দোলন সফল হলে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ আর্থিক ক্ষতির আশঙ্কায় বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হবে। অপরদিকে, স্বদেশি দ্রব্যের উৎপাদন ও ব্যবহারও বৃদ্ধি পাবে। স্বদেশি দ্রব্য ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে জনগণের মনোবল, আত্মত্যাগ ও আত্মনির্ভরতা প্রসারিত হবে।

    আন্দোলনের প্রসার

    বাংলাদেশে প্লাবনের মতো প্রসার লাভ করে স্বদেশি আন্দোলন। সভা-সমিতি ও বক্তৃতার মাধ্যমে গ্রামে-গঞ্জে বিলাতি দ্রব্য বর্জন ও স্বদেশি দ্রব্য ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা প্রচার করা হয়। বাংলার বিভিন্ন স্থানে কুটির শিল্প ও বড়ো বড়ো শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় বাংলায় বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানা স্থাপন করেন। ডাঃ নীলরতন সরকার জাতীয় সাবান কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। ছাত্রসমাজ ছিল স্বদেশি আন্দোলনের প্রধান শক্তি। ব্রিটিশ সরকার তাদের বিরুদ্ধে দমনমূলক নীতি গ্রহণ করে। ছাত্রদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে কার্লাইল সার্কুলার বিরোধী সমিতি গঠন করা হয়। বহিষ্কৃত ছাত্রদের শিক্ষা দেবার জন্য জাতীয় শিক্ষার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে এই উদ্দেশ্যে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয়।

    স্বদেশি আন্দোলনের প্রচারে সংবাদপত্রের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কুরকুমার মিত্র সম্পাদিত সঞ্জীবনী, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত বেঙ্গলি, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত যুগান্তর, অরবিন্দ ঘোষ সম্পাদিত বন্দেমাতরম্ এবং ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় সম্পাদিত সন্ধ্যা পত্রিকার ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণীয়। স্বদেশি আন্দোলনের প্রসারে বাংলা পত্রপত্রিকাও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে। ময়মনসিংহ থেকে প্রকাশিত চারুমিহির এবং বরিশাল থেকে প্রকাশিত বরিশাল হিতৈষী সরকারি দমননীতির কবলে পড়ে। সংবাদপূত্রের বলিষ্ঠ ও নির্ভীক ভূমিকায় ব্রিটিশ সরকার বিশেষভাবে বিচলিত হয়ে পড়ে। বন্দেমাতরম্, সন্ধ্যা, যুগান্তর এই তিনটি পত্রিকার প্রকাশন বন্ধ করে সরকার।

    আন্দোলনের দুর্বলতা

    ব্যাপকভাবে প্রসারিত হলেও স্বদেশি আন্দোলন মধ্যবিত্ত শ্রেণি এবং ছাত্র-যুব সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। শ্রমিক ও কৃষকদের এই আন্দোলনে অংশগ্রহণের সুযোগ করে না দেওয়ায় স্বদেশি আন্দোলন গণআন্দোলনে পরিণত হয়ে দীর্ঘ সংগ্রামে বুপান্তরিত হয়নি।

    আন্দোলনের গুরুত্ব ও ফলাফল

    স্বদেশি আন্দোলন আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে তা ব্যর্থ হয়নি। প্রবল আন্দোলন ও জনমতের চাপে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার বাধ্য হয়ে বঙ্গভঙ্গ রদ করে এবং খন্ডিত বাংলা পুনরায় অখন্ডিত রূপ ফিরে পায়।

    প্রথমত, স্বদেশি আন্দোলন শুধুমাত্র বাংলায় নয়, সমগ্র ভারতের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। স্বদেশি আন্দোলনের ফলে ভারতের জাতীয় আন্দোলন প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে জাতীয়তাবাদী ঐক্য ও সংহতি স্থাপনে স্বদেশি আন্দোলন প্রভূত সাহায্য করেছে।

    দ্বিতীয়ত, এই আন্দোলনের প্রভাবেই কংগ্রেসে চরমপন্থী রাজনীতি প্রাধান্য লাভ করে। ১৯০৬ সালে অনুষ্ঠিত কলকাতা অধিবেশনে জাতীয় কংগ্রেস স্বরাজ লাভ মূল লক্ষ্য হিসাবে ঘোষণা করে। যদিও জাতীয় আন্দোলনের গতি নির্ণয়ের ব্যাপারে নিজেদের মধ্যে মতভেদ প্রকট হয়। ১৯০৭ সালে সুরাট কংগ্রেসে নরমপন্থী ও চরমপন্থী গোষ্ঠীর বিরোধ চরমে ওঠে।

    তৃতীয়ত, ব্রিটিশের দমননীতির চাপে নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ আন্দোলন ব্যর্থ হয়, বৈপ্লবিক সন্ত্রাসবাদ দেখা দেয় এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সশস্ত্র বিপ্লবর অভ্যুত্থান শুরু হয়।

    চতুর্থত, বাঙালি জীবন ও মননের ক্ষেত্রে স্বদেশি আন্দোলন বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। বাংলা সাহিত্য, গান, নাটক, সংস্কৃতি স্বদেশি ভাবধারায় সমৃদ্ধ হয়। রজনীকান্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল, রবীন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ প্রমুখের রচনায় স্বাদেশিকতার প্রভাব পড়ে।

    পঞ্চমত, স্বদেশি আন্দোলন প্রথম ব্যাপক গণআন্দোলনের সূচনা করে। পরবর্তীকালের অসহযোগ আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, বৈপ্লবিক প্রচেষ্টা সমস্তই স্বদেশি আন্দোলনের দ্বারা প্রভাবিত ছিল। স্বদেশি আন্দোলনের গুরুত্ব প্রসঙ্গে গান্ধিজি মন্তব্য করেছিলেন যে, 'বঙ্গভতা মূলত ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ভেঙে যাবার প্রথম অবস্থা। নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, স্বদেশি আন্দোলনই ভারতে যথার্থ স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনা করে এবং এর ফলেই ভারতে প্রকৃত গণজাগরণ সম্ভব হয়।

    Post a Comment

    নবীনতর পূর্বতন