বাংলা গদ্যের বিকাশে রামমোহন রায়ের ভূমিকা




⇒ রামমোহন রায় আধুনিক বাংলার প্রথম সুচিহ্নিত বলীষ্ট ব্যক্তিত্ব। সাহিত্যে না হলেও সেদিনকার জাতির জীবনে নতুন সৃষ্টির মহৎ প্রেরণা নিয়ে তিনি আবির্ভূত হয়েছিলেন। সেই সৃষ্টিশীল ব্যাক্তিত্ব বাংলা পদ্যকে দিয়েছে প্রথম স্বকীয়তাধর্মী স্টাইলের সমৃদ্ধি।


রামমোহন কোন সৃষ্টিশীল সাহিত্য রচনায় ব্রতী ছিলেন না। ধর্ম এবং সমাজ ছিল তার লক্ষ। রক্ষনশীল হিন্দুসমাজ এবং ধর্মবিদ্বেষী পাদরী সম্প্রদায়- এই দুইয়ের বিরুদ্ধে তিনি লেখনী ধারন করেছিলেন। নিজ মত প্রতিষ্ঠা ও তত্ত্ব প্রতিপালনের আগ্রহে মূলত ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের মূল উদ্দেশ্য নিয়ে রামমোহন প্রয়োজনের তাগিদে গ্রন্থ রচনা ও সাময়িক পত্র প্রকাশে ব্রতী হয়েছিলেন। আর এজন্য বাংলা ভাষাকে তার মাধ্যম করতে গিয়ে তিনি দেখলেন বাংলা ভাষার দুর্বলতা। ধর্ম সংস্কারের ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি গদ্য রচনার ক্ষেত্রেও রামমোহন সচেষ্ট হয়েছিলেন। তার রচনার মধ্য দিয়ে ধর্মের আচার সর্বস্বতা ও কুসংস্কার দূর করে উদার ও স্বাধীন চিন্তাধারা প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন। যার মূল বৈশিষ্ট্য ছিল বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ।


১৮১৫-১৮৩১ খ্রীষ্টাদের মধ্যে মোট পনেরো বছরে রামমোহনের যাবতীয় বাংলা পুস্তিকা রচিত হয়েছিল। সংখ্যায় ছোটো বড়ো মিলিয়ে মোট প্রায় তিরিশ খানা। রামমোহন ধর্মসংস্কার ও সমাজ চেতনার বশবর্তী হয়ে বাংলা গদ্যে কলম ধরেছিলেন । বিশুদ্ধ রস বা শিল্প সৃষ্টি তাঁর একেবারে উদ্দেশ্য ছিল না। শাস্ত্র গ্রন্থাদি বাংলা গদ্যে অনুবাদ এবং তা সর্বসাধারনের মধ্যে বিতরন করে তিনি বহুকাল প্রচলিত ব্রাহ্মণ্য দম্ভের মূলে কুঠারাঘাত করেছিলেন। অনুবাদ, ভাষা ও বিতর্ক এই তিন শ্রেণীর পুস্তক তিনি রচনা করেছিলেন। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- 'বেদান্ত গ্রন্থ', 'বেদান্তসার', 'ঈশোপনিষদ', 'কঠোপনিষদ', 'তলবকার উপনিষদ' ইত্যাদি অনুবাদ গ্রন্থ। এছাড়াও 'ভট্টাচার্যের সহিত বিচার, 'গোস্বামীর সহিত বিচার', 'পথ্যপ্রদান', 'ব্রহ্মোপাসনা', 'ব্রহ্মসংগীত', 'অনুষ্ঠান', সহমরণ বিষয়', 'গৌড়ীয় ব্যাকরণ', 'চারি প্রশ্নের উত্তর' , 'গুরুপাদুকা' ইত্যাদি।


রামমোহন সর্বপ্রথম বাংলা গদ্যকে অনুবাদ, আলোচনা, বিতর্ক ও মীমাংসার বাহন হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ গোষ্ঠী বাংলা গদ্যকে কাহিনী ও গালগালন প্রকাশের বাহন করে তুলেছিলেন আর রামমোহন তাকে যুক্তিতে, তর্কে, চিন্তায় সজ্জিত করে আধুনিক চিন্তাশীল মনের উপযোগী করে তুললেন। আধুনিক মনের জটিলতাকে ফুটিয়ে তুলতে হলে আধুনিক ভাষাবাহন প্রয়োজন। রামমোহন সেই আধুনিক ভাব প্রকাশক বাংলা গদ্যের অন্যতম স্রষ্টা রূপে চিরদিন অম্লান গৌরবে প্রতিষ্ঠিত থাকবেন। এই প্রসঙ্গে ড: অসীত কুমার বন্দোপাধ্যায় বলেছেন -


"বাংলা গদ্য তার হাতে আয়ুধে পরিণত হয়েছিল ............ এজন্য তিনি বাংলা গদ্যের ইতিহাসে দিক নির্দেশক হিসেবে স্মারকস্তম্ভ রূপে দীর্ঘকাল বিরাজ করবেন।"

 

রবীন্দ্রনাথ রামমোহন সম্পর্কে বলেছিলেন-


"কী রাজনীতি, কী বিদ্যা শিক্ষা, কী সমাজ, কী ভাষা, আধুনিক বঙ্গদেশে এমন কিছুই নাই, রামমোহন রায় সহস্তে যাহার সূত্রপাত করিয়া যান নাই।”

 

ভাষা বিকাশের দিক থেকে তার এই মন্তব্য যথার্থ। রামমোহনের গদ্য সম্পর্কে ইশ্বরগুপ্ত বলেছিলেন-


"দেওয়ানজী জলের ন্যায় সহজ ভাষায় লিখিতেন, তাহাতে কোন বিচার ও বিবাদঘটিত বিষয় লেখার মনের অভিপ্রায় ও ভাবসকল অতি সহজে, স্পষ্টরূপে প্রকাশ পাইত, এজন্য পাঠকেরা অনায়াসেই হৃদয়ঙ্গম করিতেন; কিন্তু সে লেখায় শব্দের বিশেষ পরিপাট্য ও তাদৃশ মিষ্টতা ছিলনা।”

 

এটা ঠিক যে রামমোহনের ভাষায় পরিপাট্য ও মিষ্টতার অভাব আছে। কিন্তু এটাও ঠিক যে রামমোহন সাহিত্যিক ছিলেন না। সাহিত্য সৃষ্টির অভিপ্রায় নিয়ে তিনি গদ্য রচনা করেননি । তিনি চেয়েছিলেন সমাজ, ধর্ম, কুসংস্কার, ইত্যাদি বিষয়ে আধুনিক বক্তব্যকে পাঠকের মনে গেঁথে দিতে। সেজন্য ভাষাকে ঋজুধর্মী অর্থাৎ বাচ্যার্থের অনুগামী করতে হয়েছে। ব্যঞ্জনাধর্মী ও মনোহারী করার প্রয়োজন বোধ করেননি, সেজন্যই তার ভাষার মিষ্টতা কম। তবে জ্ঞানমূলক সাহিত্যের মূল বৈশিষ্ট্য - বক্তব্যের স্পষ্টতা, যুক্তির পারম্পর্য, মননশীলতার প্রাখর্য রামমোহনের রচনায় দুর্লভ নয়। আর এই সমস্ত কারণের জন্যই তাকে বাংলা গদ্যের জনক বলা হয়।

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কলকাতার যীশু কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা বিচার ও সংবাদধর্মীতা

মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্যের নামকরণের সার্থকতা বিচার

ঘোড়সওয়ার কবিতার সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু ও আধুনিকতার লক্ষণ