বাংলা গদ্য সাহিত্যে প্যারীচাঁদ মিত্রের ভূমিকা



বাংলা গদ্য সাহিত্যে প্যারীচাঁদ মিত্রের অবদান


⇒ ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে যে সমস্ত বাঙালী মনীষী নবজাত বাংলা গদ্যের সমৃদ্ধি সাধনে যত্নবান হয়েছিলেন এবং তাকে বহুমুখী ভাব প্রকাশের উপযুক্ত শক্তিশালী করে তুলেছিলেন, তাদের মধ্যে প্যারীচাঁদ মিত্র অন্যতম। অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী বিদ্যাসাগরের প্রভাবে যখন সাধুগদ্যের প্রচলন হয়ে গেছে, তখন ব্যঙ্গাত্মক, হাস্যরসাত্মক হালকা বিষয় পরিবেশনের উপযুক্ত কথ্য ভাষার প্রচলন করতে প্যারীচাঁদ যে সব থেকে বেশী উদ্যোগী হয়েছিলেন, সে বিষয়ে কোন সংশয় নেই।


প্যারীচাঁদ উপলব্ধি করেছিলেন যে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সংস্কৃত ঘেঁষা গুরুগম্ভীর বাংলা ভাষা সাধারন মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। তাই সর্বসাধারনের উপযোগী এমন এক ভাষা মাধ্যম তিনি গ্রহণ করেছিলেন, যার ফলশ্রুতি 'আলালের ঘরের দুলাল -এর মতো অনন্য সাহিত্যকর্ম বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আর তাঁর অন্যান্য রচনাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-


'মদ খাওয়া বড়ো দায়, 'জাত যাবার কী উপায়', 'রামারঞ্জিকা', 'কৃষি পাঠ', 'যৎ কিঞ্চিৎ', 'অভেদী', 'আধ্যাত্মিকা', 'ডেভিড হেয়ারের জীবনচরিত' ইত্যাদি।


বিপ্লবী ডিরোজিওর ছাত্র হয়েও তিনি ইয়ংবেঙ্গল কালাপাহাড়ী মনোভাব গ্রহণ করেননি, গ্রহণ করেছিলেন তাদের বুদ্ধিদীপ্ত প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি। অভেদী ধর্ম সমন্বয়গত উদারতার সুস্থ দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক। দীক্ষিত ব্রাহ্মণ না হয়েও তার রচনাবলী ব্রাহ্ম ভাবধারাতেই অনুপ্রানিত। 'যৎ কিঞ্চিৎ' গ্রন্থের মধ্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব, ঈশ্বরের রাজ্যের নিয়ম, উপাসনা, পরমেশ্বরের প্রতি বিশ্বাস ইত্যাদি তত্ত্বকথা ব্যক্ত হয়েছে।


প্যারীচাঁদের শেষ পর্যায়ের বিভিন্ন রচনার মধ্যে 'রামারঞ্জিকা' এবং 'বামাতোষিণী' বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নারী কল্যানমূলক উপন্যাস বামাতোষিণীতে পারিবারিক স্বাস্থ্য, শিশু ও স্ত্রী শিক্ষা ইত্যাদি সম্পর্কে গ্রন্থকারের অভিমত ইউরোপীয় উচ্চনারীদের বিবরণের মাধ্যমে ব্যক্ত হয়েছে।


প্যারীচাঁদ মিত্রের গদ্যরচনার বৈশিষ্ট্য এই যে, তিনি গুরুগম্ভীর বিদ্যাসাগরীয় ভাষা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের সহজবোধ্য ভাষা ব্যবহার করেছেন, যা 'আলালি ভাষা' নামে পরবর্তীকালে প্রসিদ্ধি অর্জন করে। এই ভাষা চলিতরীতির অনেক কাছাকাছি। ক্রিয়াপদে সাধুরীতি গ্রহণ করা হলেও বাক্যরীতি, শব্দ প্রয়োগ ইত্যাদি বিষয়ের ফলে এই ভাষা অনেক সহজ সরল এবং জীবনের অনেক কাছাকাছি। টেকচাঁদ অনেক জায়গায় কলকাতার 'ককনি' অর্থাৎ কথাবুলি ব্যাবহার করেছেন। এই অভিনব গদ্যরীতি তিনি প্রবর্তন করেন তাঁর শ্রেষ্ঠ মাসিক পত্রিকায়। যার প্রথমে লেখা থাকত –


“এই পত্রিকা সাধারণের, বিশেষত স্ত্রী লোকেদের জন্য ছাপা হইতেছে।...... বিজ্ঞ পণ্ডিতেরা পড়িতে চান, পড়িবেন, কিন্তু তাহাদিগের নিমিত্ত এই পত্রিকা লিখিত হয় নাই”।


বস্তুত টেকচাঁদ সর্বপ্রথম চলিত গদ্যরীতির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। আর সেই কারণের জন্যই তিনি ক্রীয়াপদে সাধুয়ান রেখেও ঘরোয়া আলাপ-চারিতার ভাষাকে সাহিত্যকর্মের বাহন করে তুলেছিলেন। 'আলালের ঘরে দুলাল -এ এই রচনারীতি অনুসরণ করা হয়েছে। প্যারীচাঁদের কৃতিত্ব এই যে- মৌলিক ভাষাও যে সাহিত্যের বাহন হতে পারে এটা তিনিই প্রথম দেখালেন । এই প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন -


"প্যারীচাঁদ মিত্র বাংলা গদ্যের একজন প্রধান সংস্কারক, যে ভাষা সকল বাঙালীর বোধগম্য এবং সকল বাঙালী কর্তৃক ব্যবহৃত, প্রথম তিনিই তাহা গ্রন্থ প্রণয়নে ব্যবহার করিলেন।”

 

তাই এই কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, প্যারীচাঁদ ভাবে এবং ভঙ্গীমায় আগামীদিনের পথনির্দেশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।



এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

কলকাতার যীশু কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা বিচার ও সংবাদধর্মীতা

মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্যের নামকরণের সার্থকতা বিচার

ঘোড়সওয়ার কবিতার সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু ও আধুনিকতার লক্ষণ