বাংলা গদ্য সাহিত্যে ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের অবদান
⇒ একদিকে ভারতের প্রাচীন আদর্শ, তার আধ্যাত্ম সাধনা, সামাজিক ও পারিবারিক চেতনা আর আরেকদিকে নবাগত পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বিজ্ঞান, যুক্তি, তর্কবাদ আর মুক্ত আচরণ - নব্য বাংলার বুকে এই যে দুটি বিপরীতমুখী সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল, এরই সন্ধিক্ষণে যথার্থ যুগনায়কের মতো দাড়িয়েছিলেন ভূদেব মুখোপাধ্যায়। প্রাচ্যের অবাস্তর ভাবাদর্শকে যেমন তিনি বর্জন করেছিলেন, তেমনি যা কিছু পাশ্চাত্যের বিকৃত আদর্শ, তাকেও তিনি গ্রহণ করেননি । বিদ্যাসাগরের মতো তিনি বিরাট প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেননি সেকথা ঠিক কিন্তু নিজের নির্মিত পরিবেশে তিনি ছিলেন সম্রাট।
ভূদেব মুখোপাধ্যায় সে যুগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেযুগ হিন্দু কলেজকে ঘিরে পাশ্চাত্যভাবের জাগরণের কাল। হিন্দু কলেজের শিক্ষক ডিরোজিওর সংস্কারমুক্ত আদর্শ ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীকে প্রভাবিত করেছিল। ভূদেববাবু সে যুগে জন্মগ্রহণ করেও অন্ধ পাশ্চাত্য প্রীতিতে নিমজ্জিত হননি। বরং পাশ্চাত্যভাবের আলোকে হিন্দুধর্মকে নতুন করে ব্যাখ্যা করলেন। নব্য শিক্ষিত সমাজের কাছে পুরাতন আদর্শের অনুধ্যান ও তাকে সাহিত্যকর্মে প্রকাশ ভূদেব বাবুর প্রধান কৃতিত্ব। মৃত্যুর কয়েকদিন পূর্বেও তিনি লিখেছেন -
"আমার সমস্ত কামনা ত্যাগ করিতে পারিতেছি, কেবল আমার দেশের লোক সত্য সনাতন ধর্মের মহত্ব উপলব্ধি করিয়া যাহাতে ভালো লোক হয় এর সাধ এখনও ছাড়িতে পারি না।”
ভূদেব মুখোপাধ্যায় ছিলেন মূলত প্রাবন্ধিক। বাংলা ভাষায় তিনি পাঠ্যপুস্তকও রচনা করেছিলেন। সেগুলির মধ্যে রয়েছে 'শিক্ষা বিধায়ক প্রস্তাব', 'ইংলন্ডের ইতিহাস, 'রোমের ইতিহাস', 'পুষ্পাঞ্জলী', 'ক্ষেত্রতত্ত্ব' ইত্যাদি। একমাত্র 'বাঙ্গালার ইতিহাস” ছাড়া অন্য সবকটি রচিত হয়েছিল ১৮৫৬ থেকে ১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে।
সমালোচনা গ্রন্থ হিসেবে তিনি লিখেছেন 'বিবিধ প্রবন্ধ'। এই গ্রন্থটিতে তিনি সংস্কৃত শাস্ত্র এবং সাহিত্যের দীর্ঘ বিশ্লেষণ এবং পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু যে তিনটি গ্রন্থের জন্য তার খ্যাতি, সেগুলি হলো ১. পারিবারিক নিবন্ধ ২. সামাজিক প্রবন্ধ ও ৩. আচার প্রবন্ধ। তখনকার সামাজিক প্রয়োজনেই গ্রন্থগুলি লিখিত হয়েছিল। এই গ্রন্থগুলিতে তিনি দেখাতে চেষ্টা করেছেন লোক, ব্যক্তি থেকে পরিবার, পরিবার থেকে সমাজ এবং সমাজ থেকে বৃহত্তর পরিধির দেশের প্রতি কর্তব্য পালন করে ধীরে ধীরে উচ্চমানব ধর্ম লাভ করে। এই তিনটি গ্রন্থে তিনি তাঁর উদার, অসাম্প্রদায়িক, আধুনিক ভারতীয় মনের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। একজাতীয় গুরুগম্ভীর শিক্ষামূলক প্রবন্ধের ভার বহন করার মতো শক্তি তিনি বাংলার গ্রন্থের মধ্যে সঞ্চার করেছিলেন। এদিক থেকে বিদ্যাসাগরের ফেলা আসা কাজটিকে তিনি অনেক দূরে টেনে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন।
উপন্যাস যে তিনি একেবারেই রচনা করেননি তা নয়। যৌবনে কিছু ইতিহাস ভিত্তিক কথিকা রচনার চেষ্টা করেছিলেন। সেগুলির নাম হচ্ছে 'ঐতিহাসিক উপন্যাস', 'স্বপ্নলব্ধ ভারতের ইতিহাস'। তাঁর ইতিহাস ভিত্তিক গ্রন্থ 'ঐতিহাসিক উপন্যাস' রচিত হয়েছিল কন্টার সাহেবের লেখা ইতিহাস নামে পরিচিত 'The Romance of History : India' নামক গ্রন্থ থেকে। মারাঠা শক্তির পরাজয় না হলে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক চেহারা কী হত তাহলে, তার একটি কাল্পনিক চিত্রকে উপন্যাসের আকারে স্বপ্নলব্ধ ভারতের ইতিহাসে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। ১৮৬৩ সালে তাঁর একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়েছিল 'পুষ্পাঞ্জলী'। এটাতে হিন্দু ধর্মের আদর্শ ও মহিমা কীৰ্তন করেছেন তিনি।
ভূদেব মুখোপাধ্যায় কোনদিনই সাহিত্যিক ছিলেন না। সেজন্য সাহিত্যের বাটখারা দিয়ে তার রচনাগুলিকে ওজন করা যাবে না। কিছু বাংলা গদ্যের মধ্যে কারুকার্য করেছিলেন। তার মধ্যে তিনি সঞ্চার করেছিলেন ভাষার প্রবাহমানতা। সেই ভাষা প্রবন্ধেরই উপযুক্ত ছিল, সেটি ছিল ঋজু, সরল ও গম্ভীর ভাবের পরিবাহক। তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের আগমনের জন্য পথ সুগম করে তুলেছিলেন। বাংলা গদ্য ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের কাছে সে কারণেই ঋণী।