অলংকারবাদ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা
অলংকারবাদ
কাব্যাদর্শের লেখক দণ্ডী অলংকারের সংজ্ঞা দিয়েছিলেন- 'কাব্যশোভাকরাণ ধর্মান অলঙ্কারান প্রচক্ষ্যতে'। যেসব উপাদান (ধর্ম) কাব্যের শোভা (সৌন্দর্য) বাড়ায়, তারা হল অলংকার।
পরে বামন 'কাব্যালঙ্কার'-এ বলেছেন 'কাব্যং প্রাহাম অলঙ্কারাৎ' – কাব্য অলংকারের দ্বারাই গ্রহণীয় হয়ে ওঠে। এখানে অলংকার বলতে বাইরের কিছু নয়, কাব্যের অন্তরা সৌন্দর্য। বামন অলংকারের সংজ্ঞা জানালেন— 'সৌন্দর্যম্ অলকারম্' অর্থাৎ কাব্যের সৌন্দর্য হল অলংকার। আসলে বামন জানাতে চেয়েছিলেন অলংকার হল 'The beautiful in poetry'।
এই অলংকারবাদ বামনের কাছে রীতি, গুণ এবং কাব্যালংকারের মিশ্রণ। তাই বামন পরে জানিয়েছেন রীতি কাব্যের আত্মা। যমক, উপমা ইত্যাদি অলংকার কাব্যশোভাকে বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু এই অলংকার হল অনিত্য (temporal), গুণই নিত্য (permanent)। বামন মাত্র ত্রিশটি অলংকারকে আমল দিয়েছেন। অর্থাৎ বামনের ভাবনায় অলংকার শেষ কথা নয়, কাব্য তাকে ছাড়িয়ে যায়। কিন্তু অলংকার কাব্যে সৌন্দর্য এনে দেয়। এই মতকে কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে স্পষ্ট করতে পারি।
১) বিকট কটকে পাখা কাটাকাটি
২) চন্দচন্দন নন্দ নন্দন গন্ধনিন্দিত অঙ্গ
৩) তরানিকরোন্নীত তরুণীগণসংকুলা
৪) হাথক দরপন মাথক ফুল/নয়নক অঞ্জন মুখক তাম্বুল।।
৫) চলচপলার চকিত চমকে করিছ চরণ বিচরণ
প্রথম ও দ্বিতীয় উদাহরণে অনুপ্রাস প্রকট। কিন্তু কাব্যত্ব নেই। অর্থাৎ অলংকার জানেন বলেই এধরনের পংক্তি লেখা হয়েছে।
অথচ কাব্যের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য যেখানে অলংকার সুপ্রযুক্ত হয়েছে, সেখানে বোঝা যায় কেন বলা হল অলংকৃত বাক্যই কাব্য। কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে একথার বিস্তার ঘটানো যেতে পারে।
১) মধ্যদিনের রক্তনয়ন অন্ধ করিল কে?
২) অব মথুরাপুরে মাধব গেল। গোকুলমাণিক কো হরি লেল।
৩) দিনান্তের বেড়াটি ধরিয়া বসুন্ধরা আছে চাহি দিগন্তের পানে।
৪) সমুদ্র কি রিক্ত হয়ে যাবে
যদি আমি তার থেকে একমুঠো ফেনা তুলে নিই।
এখানে প্রথম উদাহরণে আছে সমাসোক্তি, দ্বিতীয়টিতে উপমা বা রূপক, তৃতীয়ে আবার সমাসোক্তি, চতুর্থে সংশয়াত্মক অলংকার।
এখানে অলংকার কাব্যত্ব বাড়িয়েছে। কারণ বক্তব্যকে কাব্যগ্রাহ্য করার জন্য অলংকার এসেছে। শুধু অলংকার লেখার অন্য পংক্তিগুলি লেখা হয়নি। ভামহ বলেছিলেন নাবীর মুখ সুন্দর হলেও তা অলংকারহীন হলে শোভা পায় না। তেমনি কাব্যকথাকে সৌন্দর্যে মণ্ডিত করতে হলে অলংকারের প্রয়োজন আছে। পরে ধ্বন্যালোকে এই প্রয়োজনীয়তা এবং স্বতঃস্ফূর্ততার চমৎকার ব্যাখ্যা করেছেন আনন্দবর্ধন:
অনুসন্ধানকারীর কাছে অলংকারগুলি স্বতন্ত্র হলেও প্রতিভাশালী কবির রসসমাহিত চিত্ত থেকে আমি আগে, আমি আগে এইভাবে যেন সংঘর্ষ করে বেরিয়ে আসে। অর্থাৎ কাব্যে রসসকারের সঙ্গে তার অলংকার-শরীরের জন্ম হয় এবং অলংকৃত শব্দগুলি স্বতঃস্ফুর্তভাবে প্রকাশ পেতে থাকে। তাই অতুলচন্দ্র গুপ্ত কাব্যজিজ্ঞাসায় যেভাবে অলংকারকে বহিরভাজ্ঞানে ধারণা করেছেন, তার মধ্যে যুক্তির অভাব আছে। (পৃ ১১, ১৯৭৪, বিশ্বভারতী সংস্করণ)। পাশ্চাত্যে বেনেদিতো কোচে তাঁর 'ইসথেটিক' গ্রন্থে এভাবেই অলংকারের ব্যাখ্যা করেছেন : 'It (=ornament) does part of it and it is not ornament, but a constituent element of expression, indistinguishable from the whole.'
অর্থাৎ অলংকার (রচনার) অঙ্গীভূত হয় এবং তা অলংকার রূপে থাকে না। সমগ্র রচনার নির্বিশেষ অভিব্যক্তির মৌল উপাদান হয়ে দাঁড়ায়। একই কারণে ওয়াল্টার পেটার তাঁর 'অ্যাপ্রিসিয়েশনস্'-এ লিখেছেন : 'permissible ornament being for the most part structural or necessary.' অর্থাৎ কাব্যাঙ্গভূত বা প্রয়োজনভূত অলংকারই কাব্যে ছাড়পত্র পাবে।
অলংকার কীভাবে কাব্যের অংশ হয়ে দাঁড়ায়, তা আলোচনা করা হল, কিন্তু তা কাব্যে কোন কোন ধর্ম (= উপাদান) সঞ্চার করে? এখানে বলতে পারি ধ্বনির আশ্রয়ে গড়া শব্দালংকার কাব্যে একটা সাংগীতিক গুণ (musical quality) আনে আর অর্থালংকারের ফলে কাব্যে আসে চিত্রধর্ম (pictorial quality)। রবীন্দ্রনাথ এদের সম্পর্কে বলেছিলেন সাহিত্যের প্রধান উপকরণ চিত্র ও সংগীত। উদাহরণ এনে এটি ব্যাখ্যা করতে পারি।
সংগীতধর্মের উদাহরণ
১)
দক্ষিণের মন্ত্র গুঞ্জরণে
তব কুঞ্জবনে
বসন্তের মাধবী মঞ্জুরী
সেইক্ষণে দেয় ভরি
মালঞ্চের চঞ্চল অঞ্চল
বিদায়-গোধূলি আসে ধূলায় ছড়ায়ে ছিন্নদল। (রবীন্দ্রনাথ)
২) বদসি যদি কিঞ্চিদপি দত্তরুচিকৌমুদী হরতিদরতিমিরমতিঘোরম্ (জয়দেব)
৩) কশ্চিৎকাস্তা বিরহগুরুণা স্বাধিকারপ্রমত্তঃ (কালিদাস )
৪) চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা (জীবনানন্দ )
চিত্রধর্মের উদাহরণ
১) চন্দ্রোদয়ারম্ভ ইবাম্বুরাশি (কুমারসম্ভব, কালিদাস)
২) দুরাদয়শ্চক্রনিভসা তন্বী তমালতালীবনরাজিলীলা (রঘুবংশ, কালিদাস)
৩) কালো জল ঢালিতে সই কালা পড়ে মনে।
নিরবধি দেখি কালা শয়নে স্বপনে।। (জ্ঞানদাস)
৪) নির্বাণে আছে কি ফল, জলেতে মিশায় কা ওরে চিনি খাওয়া ভাল নয় মন চিনি খেতে ভালবাসি। (রামপ্রসাদ সেন)
• আটটি উদাহরণে যে অলংকার কাব্যের অঙ্গ হয়ে উঠেছে, তা বাইরের নয়। বরং বলা যায় কাব্যভাবনা ও অলংকার মিলেমিশে আছে।
অলংকারবাদের সমালোচনা আমাদের আলোচনায় অলংকারের প্রকৃতি, কাব্যে তার অনিবার্যতা বা অপ্রয়োজনীয়তা খানিকটা ধরা গেছে। সাহিত্যতাত্ত্বিকদের অনেকে একে বহিরা চিহ্ন মনে করে বলেছেন সব অলংকৃত বাক্য কাব্য হতে পারে না। কেননা বহু কবিতায় অলংকার নেই, কিন্তু তা কাব্যে উত্তীর্ণ হতে পেরেছে। এখানে তাঁরা অলংকারের সংজ্ঞার অতিব্যাপ্তি এবং অব্যাপ্তিদোষের সমালোচনা করেছেন। তাঁরা যেসব নিরলংকৃত কবিতার উল্লেখ করেছেন, কয়েকটি উদাহরণ সহযোগে তার একটি আলোচনা করা যাক-
১) সেই কেবা শুনাইল শ্যামনাম
কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ। (চণ্ডীদাস)
2) ...... নীল সরোবর জলে
প্রথম হেরিল আপনারে, সারাদিন
রহিল চাহিয়া সবিস্ময়ে। (রবীন্দ্রনাথ)
3) কিছুই না বলে
কী কথা গেলেন তিনি বলে
ভগবান বুদ্ধ, হাতে তুলে ধরে
পদ্মটি, আলোয় তুলে ধরে। (অমিয় চক্রবর্তী)
৪) মানুষ কাউকে চায়, তার সেই নিহত উজ্জ্বল
ঈশ্বরের পরিবর্তে অন্য কোনো সাধনার ফল (জীবনানন্দ দাশ)
চারটি উদাহরণই বাংলা সাহিত্য থেকে নেওয়া। তাতে অলংকারবাদের সমালোচনার ব্যতিক্রম ঘটছে না। কারণ ওঁরা এসব কবিতাংশের আলোচনায় বলতেন এরা হল স্বভাবোন্ডি। এতে যাঁরা অলংকারের বহিরঙ্গবাদী তাঁরা বিপদে পড়েছেন। তাঁরা সঙ্গে সঙ্গে এই অলংকারহীন কবিতাগুলির মধ্যে অলংকার খুঁজে পেলেন। ফলে স্বভাবোক্তিও অলংকারের শ্রেণিতে চলে এল।
সাধারণভাবে বাংলা ভাষায় ভারতীয় সাহিত্যতত্ত্বের অলংকারবাদকে একেবারে আক্ষরিক অর্থে ধরে নিয়ে, তার ব্যঞ্জনা বাদ দিয়ে আলোচনা করার একটা প্রবণতা আছে। অলংকার হতে পারে ভূষণ, আভরণ। কিন্তু তা কাব্যের আন্তর স্পন্দনের সঙ্গে জড়িত হয়েই আমাদের মনোহরণ করে।