রীতিবাদ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা

রীতিবাদ


'রীতি' শব্দটির অর্থ তিনরকম হতে পারে-

ক) প্রণালী, পদ্ধতি, ধরন
খ) প্রথা, ধারা, দস্তুর
গ) প্রকৃতি, স্বভাব বা আচরণ

কিন্তু সংস্কৃতে রীতিবাদ এর চেয়ে অনেক বেশি সম্প্রসারিত এক তাত্ত্বিক ধারণা। সেখানে রীতির অর্থ এক নয়। কখনও তা বিশেষ পদবিন্যাসের কৌশল, কখনও তা মার্গ (- আঞ্চলিক/প্রাদেশিক সাহিত্যের বিভাগ)।

“দণ্ডীর কাব্যাদশ" গ্রন্থে রীতিকে বলা হয়েছে মার্গ। মার্গের অর্থ সাহিত্যভাষার রূপভেদ। অর্থাৎ সাহিত্যিক ভাষা ও কাব্যকৌশলকে দণ্ডী দু-একটি ভাগে ভাবতে চাইলেন। তিনি জানালেন যে গুণ (= রচনার উৎকর্ষ প্রতিপাদন ধর্ম, প্রসাদ, মাধুর্থ) ও অলংকার সমান হয় না। তিনি মার্গকে দুটি ভাগে বিভক্ত করলেন - বৈধর্ভী (পদমাধুর্যসহ সামান্য সমাস বা সমাসহীন রচনা প্রণালী/ যার সঙ্গে বিদর্ভ অঞ্চলের কবিদের সম্পর্ক আছে) এবং গৌড়ী (পূর্ব ভারতের ভাষা যেখানে শব্দাম্বর ও সমাসবদ্ধতার আধিক্য)। দন্ডীর এই ধারণাটি রীতিবাদের সূচনা করেছিল।

রীতিধারণার তিন স্তর

সংস্কৃত সাহিত্যতত্ত্বে এই রীতিধারণা এভাবে স্তরীভূত হয়ে আছে- 

(১)(আঞ্চলিক) / প্রাদেশিক উপভাষায় লেখা রচনার সমালোচনা 

(২) একই পদ্ধতিতে আদর্শীকৃত রীতিব্যাখ্যান,

(৩) কুস্তকের রীতিবাদ ব্যাখ্যানে বক্রোক্তি শব্দটির মধ্যে কবিচরিত্র নিয়ে সচেতন অনুসন্ধান।

রীতিরাত্মা কাব্যস্য

দন্ডীর মার্গের পরে বামন 'রীতি' শব্দটি ব্যবহার করেন। তাঁর 'কাব্যালঙ্কার'-এর দ্বিতীয় অধ্যায়ে আছে : রীতিরাত্মা কাব্যস্য। বিশিষ্টা পদরচনা রীতিঃ। বিশেষো গুণাত্মা। সা ত্রেধা বৈধর্ভী গৌড়ী পাঞ্চালী চেতি। বিদর্ভাদিষু দৃষ্টতাৎ তৎ সমাখ্যা। সমগ্ৰগুণা বৈধর্ভী।' এর অর্থ হল - রীতি কাব্যের আত্মা। রীতির অর্থ বিশিষ্ট পদরচনা। এর আত্মা হল গুণ। এভাবে বৈধর্ভী , গৌড়ী, পাঞ্চালী নামের তিনটি রীতি আছে। এর মধ্যে বৈধর্ভী হল "সমগ্রগুণা' বা 'সমগ্র গুণের আকর'।

বামনের এই রীতি ব্যাখ্যানের মধ্যে কয়েকটি বিশেষত্ব দেখতে পাই-

(১) রীতি হল বিশেষ পদরচনা ভঙ্গি অর্থাৎ বাক্যগঠন।

(২) তিনটি রীতিকল্পনার মূলে তিনি আঞ্চলিক ভাষারূপকে দণ্ডীর মতো ভেবেছেন। যা পরে আঞ্চলিক সাহিত্য-ভাষার রূপভেদ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

(৩) বৈধর্ভীকে তিনি শ্রেষ্ঠ রীতি মনে করেছেন।

বামনের রীতিবাদ -কিছু সমালোচনার মুখোমুখি হতে পারে। যেমন সাহিত্য না অলংকার কোন গুলে বৈদভী শ্রেষ্ঠ? গুণ তাঁর কাছে বড়ো হয়েছে। আবার পদান্বয় তাঁর মনোযোগ কেড়েছে।

পরবর্তী রীতিবাদ

পরে রুদ্রট যখন বামনের ব্যাখ্যা করলেন 'কাব্যালঙ্কারসূত্র' গ্রন্থে তখন তিনি আর একটি মার্গ (= রীতি ) কল্পনা করলেন। এটি হল লাটীয়া। এখানে তিনি রীতির সংজ্ঞা পালটালেন। সংস্কৃত সাহিত্যে সমাসবদ্ধতার পরিমাণ তাঁর কাছে সাহিত্যবিচারের মানদণ্ড হয়েছিল। তাই সমাসের পরিমাণ অনুসারে তিনি রীতিকে ব্যাখ্যা করলেন।

রাজশেখর 'কাব্যমীমাংসা'য় বাচ্যবাচক ছাড়া আর কিছু ভাবতে চাননি - এরকম আলোচনা শোনা যায়। কিন্তু ঐ রচনাতেই 'পাক' বলে একটি ধারণা ছিল। পাক হল ভাষা-নৈপুণ্য (mastery on language) । রাজশেখরের ব্যাখ্যাকার মঙ্গল বলতে চেয়েছেন যে পাক- হল বিশেষ্য-ক্রিয়ার সম্মিতি (agreement)। মঙ্গল এখানে রাজশেখরের সংজ্ঞাকে সংকীর্ণ অর্থে প্রকাশ করেছেন। তাই রুদ্রটের মতে মঙ্গল সাহিত্যভাষার ব্যাকরণ বৈশিষ্ট্যের ওপর পক্ষপাত দেখিয়েছেন। বিশেষ্য-ক্রিয়ার সম্মিতি তো বাক্যগঠনের সাধারণ ব্যাপার। এ থেকে রীতিবাদের কোনো সমৃদ্ধি হয়নি। তবে ক্ষেমেন্দ্র তাঁর 'কবিকণ্ঠাভরণ'-এ উচিত্য, স্বজ্ঞা, উদ্দেশ্য এবং উপলক্ষ্যকে এনে রীতিবাদকে সামান্য উজ্জ্বল করেছিলেন।

কুন্তকের আগে রীতিবাদের খণ্ড আলোচনাই বেশি করা হয়েছে। আলোচকদের ভয় ছিল দীর্ঘ আলোচনার তাদের মুগ্ধচিত্তা ব্যাহত হবে। ব্যাকরণের প্রভাব এবং আলোচকদের ব্যক্তিগত পক্ষপাতিত্ব এর জন্য দায়ী ছিল।

কুন্তকের সমালোচনা :

কুস্তক 'বক্রোক্তিজীবিতিম্' গ্রন্থে রীতিবাদীদের এই খণ্ড আলোচনাকে সমালোচনা করেছেন। তিনি রীতিবাদের সমালোচনা এভাবে করেছেন :

১) আঞ্চলিক/প্রাদেশিক ভাষাকে যদি রীতি ভাগ করার মানদন্ড ধরি, তাহলে রীতির সংজ্ঞায় অতিব্যাপ্তির দোষ জন্মায়। অঞ্চল রীতিভাগের মানদণ্ড হলে রীতির সংখ্যা গুণে শেষ করা যাবে না। রীতির ভূগোল এভাবে নিয়মহীন, ব্যর্থ হয়ে যাবে।

২) আঞ্চলিক সাহিত্যভাষার মধ্যে বিশেষ একটি ভাষা মান্য (prestigious) হয়ে ওঠে। তারই চর্চা বেশি করে করা হয়। এই আদর্শ সাহিত্যভাষা নির্দিষ্ট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকবে, তা নয়। তা একটা সর্বায়ত আদর্শ রূপ নিতে পারে। অর্থাৎ অন্য অঞ্চলের সাহিত্যিকরাও এই বিশেষ রীতিতে সৃষ্টিনৈপুণ্য দেখাতে পারেন। তাই সাহিত্যভাষার এই আঞ্চলিকতার দাবি মেনে নেওয়া যায় না।

৩)রীতি কাব্যের আত্মা আবার তার নানান বিভাগ থাকলে তার মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের বিচার করা যায় না। বৈধর্ভী ছাড়া অন্য রীতিগুলিকে সমালোচক সার্থক কাব্যপ্রণালীরূপে মানতে চাননি। সমাজের মধ্যে গুণ-কর্মের প্রভাবে চারটি বর্ণভাষা হলেও রীতির ক্ষেত্রে বৈদভীর শ্রেষ্ঠত্বের সম্মান দেওয়া যায় না।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন