বক্রোক্তিবাদ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা

বক্রোক্তিবাদ

ভামহ বক্রোত্তির কথায় জোর দিয়েছিলেন সামান্যই। তিনি সাহিত্যের ভাষা যে জীবনের ভাষা থেকে আলাদা হয়ে একটু বক্র অর্থে প্রকাশিত হবে, একেই বক্রোক্তি বলতে চেয়েছিলেন। তাঁর বিখ্যাত উক্তি হল “সৈষা সর্বৈব বক্রোক্তি" (তাই সবকিছুই বক্রোক্তি)। তিনি অলংকারবাদীদের অগ্রণী পথিক ছিলেন। তিনি লিখেছিলেন 'শব্দার্থ সহিতৌ কাব্যম্' (শব্দ ও অর্থ মিলিত হলে কাব্য হয়)। ব্যাকরণের শুদ্ধতা, প্রয়োগের যথার্থতা এবং উপলক্ষ্যের বাঁধন ভামহ প্রথম ভেবেছিলেন। কিন্তু ব্যাকরণের শুদ্ধতা তো কোনো রচনার প্রাণ হতে পারে না। হয়তো সেকালের রচনায় ব্যাকরণগত বিচ্যুতি তাঁকে এমন চরম মত নিতে উৎসাহিত করেছিল। কুন্তক ভামহ রীতিবাদের চিন্তাকে একটা তত্ত্বে পরিণত করলেন। তিনি ভাষানিরপেক্ষ কবিচিত্তের বিশেষত্ব নিয়ে আগ্রহী ছিলেন। স্রষ্টার মনের কামারশালায় কুন্তক প্রবেশ করতে চাইলেন। তাহলে কি সাহিত্যের সংজ্ঞার প্রথম সার্থক চিন্তা তিনিই উপহার দিলেন? কুন্তক তা মনে করলেও এই দাবি মেনে নেওয়া যায় না। বরং কবিদের "অন্তরামোদমনোহারিত্ব" ব্যাখ্যা তাঁর স্বাতন্ত্র্যের চিহ্ন বহন করে।

ভামহ রাজশেখরের সহিতত্ব (শব্দ অর্থের মিলনতত্ত্ব) কুন্তক মানলেন। আবার তাঁর তন্ময় বিশ্লেষণ করলেন। তিনি মাত্রাজ্ঞানের (sense of propriety) ওপর জোর দিলেন। শব্দ ও অর্থের মিলনে দুজনেই সমতা বজায় রেখে মিলে যাবে, এমন সংযম তাঁর কাছে প্রয়োজনীয় মনে হয়েছিল। শব্দ ও অর্থ কেউ কারোর চেয়ে বড়ো বা ছোটো হবে না। তাঁরা একে অপরের সমান হলেও একটা পারস্পরিক স্পর্ধার (challenge) সম্পর্ক থাকবে। সে সম্পর্ক কোনো তিক্ততায় পৌঁছবে না। বরং তা হবে কুন্তকের ভাষায় পরস্পর-স্পর্ধিত রমণীয়। তিনি বলেছেন সুকাব্যে শব্দার্থের যথার্থ মিলন ঘটে। শুধু শব্দ-সৌন্দর্য কেবল পাঠকের বা শ্রোতার শ্রবণশক্তিকে পরিতৃপ্ত করতে পারে। প্রকাশভঙ্গি নেই অথচ দারুণ ভাবনা আছে এমন কাব্য তাঁর কাছে প্রাণহীন মৃতদেহের মতো। আবার বিষয়ভাবনা নেই, প্রকাশের চাকচিক্য আছে – এমন রচনাকে তিনি বলেছেন ঘৃণ্যরোগ।
কুন্তকের বলা এই ভাব ও প্রকাশের যুগলবন্দি কীভাবে আসবে? কবি কীভাবে সার্থক কাব্য সৃষ্টি করছেন? বক্রতাই তাই কীভাবে কাব্যের প্রাণ হবে? এর উত্তরে কুন্তক ছটি বক্রতা ব্যাপার কল্পনা করেছেন :

১) বর্ণবিন্যাসবক্রতা - বর্ণের বিশেষ প্রয়োগ ( অনুপ্রাস ?)

২) পদপূর্বার্ধবক্রতা- সমার্থক শব্দ, প্রচলিত শব্দ, শব্দের গৌণ অর্থ, বিশ্লেষণ, গূঢ়োক্তি, সমাস, অনুসর্গ, ধাতু, লিঙ্গ ও ক্রিয়ায় বিশেষ প্রয়োগ

৩) পদপরার্ধবক্রতা— কাল, কারক, বচন, বাচ্য, পুরুষবাচক সর্বনাম, অব্যয় এবং বিভক্তিহীন শব্দ প্রযোগ

৪) বাক্যবক্রতা – সব অলংকার (বিশেষ করে অর্থালংকার) প্রয়োগ

৫) প্রকর্ণবক্রতা – বিভিন্ন অধ্যায়ের রচনা ও গঠনকৌশল

6) প্রবন্ধবক্রতা – সমগ্র রচনার মধ্যে নূতন সৌন্দর্যসৃষ্টির নিপুণতা

কুন্তকের এই বক্রতা কল্পনার প্রথম চারটি ব্যাকরণ ও অলংকারকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে। এখানে তা ধ্বনি বা রসবাদকে অগ্রাহ্য করতে পারেনি। পঞ্চম ও ষষ্ঠ বক্রতাব্যাপারে রসবাদ ছায়াপাত করেছে। ধ্বনিকে স্বীকার করে, আনন্দবর্ধনের অনেক শ্লোক নিজের রচনায় যুক্ত করে কুন্তক তাঁর বক্রতা-ধারণাকে প্রকাশ করেছিলেন। কুন্তক অর্থের ব্যাখ্যা এভাবে দিয়েছেন :

কবির অভিপ্রেত অর্থের বিশেষ প্রকাশক্ষমতাই বাচকত্ব বা শব্দের লক্ষণ। ... পদার্থগুলি কবিপ্রতিভায় সেই সময়ের উপযোগী এক বিশেষ পরিস্পন্দ (= বিশেষ স্পন্দন) দ্বারা পরিস্ফুরিত হয়। প্রকৃত বস্তুর উপযুক্ত এক বিশেষ উৎকর্ষ দ্বারা তাদের স্ব-ভাব সমাচ্ছাদিত হয়। কবির অভিপ্রায় প্রকাশ করতে পারে বলেই তাকে অর্থ বলা হয়।'

কুন্তকের এই অর্থ-ব্যাখ্যানের পাশে আর একটি উপমা মনে পড়ে। তা হল পানক রসের উপমা। 'অর্থের উপলব্ধি হলে পদ ও বাক্যের অর্থ ছাড়িয়ে তা সুধীদের মনে পানক-রসের আস্বাদের মতো অনির্বচনীয় কিছুর আস্বাদদান করে।' অর্থের ক্ষেত্রে পানক রস এবং পরিস্পন্দেন পরিস্ফুরন্ত' আমাদের রসবাসের কাছাকাছি। ওয়াল্টার পেটার তাঁর 'অ্যাপ্রিসিয়েশনস' গ্রন্থের শৈলী আলোচনায় বলেছেন :

"The one word for the one thing, the one thought, amid the multitude of words, tenns that might just do: ... the unique word, phrase, sentence, paragraph, essay or song absolutely proper to the single mental representation of vision within."
(Appreciations with an essay on style, p.19) 

কুন্তকের ‘বক্রোক্তিজীবিতম্'-এ তিনজাতের কবি-স্বভাব ব্যাখ্যাত হয়েছে। তিনি মনে করেন সুকুমার, মধ্যম এবং বিচিত্র বলে তিন ধরনের কবিস্বভাব আছে। সুকুমার কবিমনের অধিকারী প্রায় নিরলংকৃতভাবে সহজাত শক্তিতে কাব্য লেখেন। হৃদয়ের কথা সেখানে এত স্বাভাবিক যে অলংকারের কোনো প্রয়োজন থাকে না।

সমাসের বাড়াবাড়ি বা জটিলতা সেখানে নেই। শুধু বিশ্ব প্রসাদগুণে সে রচনা প্রাণবান হয়ে ওঠে। একে সুকুমার বললেও উঁচুদরের কবিত্ব এখানে আছে বলে এর অপর নাম 'অভিজাত'। মিডলটন মারি যাকে বলেছিলেন 'grand style'। এখানে কালিদাসকে স্মরণ করতে পারি।

দ্বিতীয় জাতের কবিস্বভাব হল বিচিত্র। এখানে হৃদয়ের অনুভবের চেয়ে বুদ্ধির ঝলক বেশি। কবি এখানে পরিশ্রমী। কিন্তু শব্দ ও অর্থের মিলন ঘটেনি। মারির বলা প্রকাশ-কৌশল (technique of expression) থাকলেও কার্যসিদ্ধি সর্বত্র আসে না। বাণভট্ট, ভবভূতিকে এই ধরনের কবিস্বভাবের অধিকারী বলা যায়।

শেষ কবিরা হলেন মধ্যম বা মিশ্র। এখানে সুকুমার ও বিচিত্র রীতি মিলে যায়। মহান কবিদৃষ্টি নেই বলে এঁরা মধ্যমপথ বেছে নেন। যেমন মাতৃগুপ্ত।

কুস্তককে তাই ধ্বনিবিরোধী বলা যাচ্ছে না। অথচ কুন্তকই প্রথম সাহিত্যতাত্ত্বিক যিনি কবিমনের হদিশ দিতে চেয়েছিলেন। প্রবন্ধবক্রতা বলে ষষ্ঠ বক্রতা ব্যাপারে তিনি সেই কবিহৃদয়কে রচনার সঙ্গে মেলাতে চেয়েছিলেন। এই প্রথম রচয়িতা সাহিত্যতত্ত্বে মুখ্য হলেন। এর সঙ্গে পাশ্চাত্য 'style'-এর কোনো কোনো অংশে মিল থাকলেও একে ভারতীয় সাহিত্যালোচনার চোখে দেখা প্রয়োজন।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন