নীলদর্পণ ট্র্যাজেডি না অতিনাটক?

নীলদর্পণ রচনার পর এই নাটকের প্রকৃতি নির্ণয়ে পণ্ডিত ও সমালোচক মহলে তর্ক বিতর্কের ঝড় বয়ে গেছে। নীলদর্পণের আদি সমালোচক খুব সম্ভব বঙ্কিমচন্দ্র। তিনি দীনবন্ধুর কবিত্বের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, “নীলদর্পণে গ্রন্থকারের অভিজ্ঞতা এবং সহানুভূতি পূর্ণমাত্রায় যোগ দিয়াছিল বলিয়া, নীলদর্পণ তাঁহার প্রণীত সকল নাটকের অপেক্ষা শক্তিশালী।” নাটকটি শক্তিশালী হবার কারণ বঙ্কিমের মতে নীলদর্পণ কাব্যাংশে উৎকৃষ্ট। নীলদর্পণ কাব্যাংশে উৎকৃষ্ট হতে পেরেছে তার কারণ— “গ্রন্থকারের মোহময়ী সহানুভূতি সকলই মাধুর্যময় করিয়া তুলিয়াছে।”
বঙ্কিমচন্দ্রের পর নীলদর্পণের প্রকৃতি নির্ণয়ে প্রথম উল্লেখ্য, সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার। তাঁর 'আধুনিক বাংলা সাহিত্য' গ্রন্থের ‘দীনবন্ধু' প্রবন্ধে নীলদর্পণ ট্র্যাজেডি না মেলোড্রামা তাই নিয়ে তাঁর মত জানিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “নীলদর্পণের ঘটনা বস্তু (action), melodrama-য় অবসিত হইয়াছে, মাত্রাতিরিক্ত emotion-এর উপর বিশেষ জোর দেয়ার প্রয়োজনে লেখকের কল্পনা সংযম হারাইয়াছে। তা ছাড়া লেখক এখানে স্বল্প বস্তু সম্বল লইয়া, সাধারণ চরিত্র অবলম্বনে নাটকখানিকে ট্র্যাজেডির ছাঁচে ঢালিতে গিয়া বিফল মনোরথ হইয়াছেন।

মোহিতলালের মুখেই প্রথম শোনা গেল, নীলদর্পণ ট্র্যাজেডি হয় নি হয়েছে (melo- drama)। এরপরে ড. সুকুমার সেন তাঁর 'বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস' গ্রন্থে নীলদর্পণকে করুণ রসাত্মক বলেছেন। তিনি এখানেই থামেন নি। তিনি বলেছেন, “নীলদর্পণের উপসংহারে মৃত্যুর ঘনঘটা নাটকটির ট্র্যাজেডিকে তরল ও অবাস্তব করিয়া দিয়াছে।”
ড. অজিত কুমার ঘোষ তাঁর 'বাংলা নাটকের ইতিহাস' গ্রন্থে নীলদর্পণ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে এই নাটককে 'বীভৎসতা মূলক' (Horror Tragedy) বলেছেন। প্রখ্যাত নাট্যসমালোচক হেমন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত তার 'বাংলা নাটকের ইতিবৃত্ত' গ্রন্থে নীলদর্পণকে বিয়োগান্ত নাটক বলে মন্তব্য করেছেন।

ড. সুশীলকুমার দে তাঁর 'দীনবন্ধু মিত্র' গ্রন্থে নীলদর্পণে আশ্চর্য স্বভাবাঙ্কন ও করুণরসের অভিব্যক্তি প্রত্যক্ষ করেছেন। কিন্তু তিনি মন্তব্য না করে পারেন নি, আশ্চর্য স্বভাবান ও করুণরসের অভিব্যক্তি থাকিলেও আধুনিককালের বিশিষ্ট সংজ্ঞায় নীলদর্পণ প্রকৃত ট্র্যাজেডি হইতে পারিয়াছে কিনা তাহাতে সন্দেহ আছে।”

উল্লিখিত পণ্ডিত সমালোচকগণ নীলদর্পণের ট্র্যাজেডি হওয়া নিয়ে যে মন্তব্যগুলি করেছেন। তা প্রায় ক্ষেত্রেই আংশিকতায় আচ্ছন্ন। কেবলমাত্র বঙ্কিমচন্দ্র বিনা দ্বিধায় বলেছেন নীলদর্পণ কাব্যগুণে উত্তীর্ণ। তিনি ট্র্যাজেডি শব্দের কোন উল্লেখ করেন নি। মোহিতলাল মজুমদার স্বীকারই করেন নি যে নীলদর্পণ ট্র্যাজেডি হয়েছে। 'নীলদর্পণে'র ট্র্যাজেডি না হওয়ার কারণ এর ঘটনাবস্তুর মেলোড্রামার বৈশিষ্ট্য অর্জন, বিষয়বস্তুর স্বল্পতা ও নায়ক সাধারণ স্তরের। অর্থাৎ মোহিতলাল বলতে চেয়েছেন ট্র্যাজেডি হতে গেলে চাই উত্তুঙ্গ ঘটনা ও অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। নাটকীয় ঘটনা মেলোড্রামায় রূপান্তরিত হলেও ট্র্যাজেডি হতে পারে। আসলে ট্র্যাজেডি অনেক ধরনের হয় এবং তাদের আবেদন স্বতন্ত্র হয়। মোহিতলাল এই সম্পর্কে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেন নি। নীলদর্পণে যে ঘটনা বর্ণিত হয়েছে তাই নিয়ে এবং সেই সঙ্গে নবীনমাধবের মতো মাননীয় ব্যক্তিকে নিয়ে ট্র্যাজেডি হতে পারে। এই উভয়বিধ উপাদানকে কেন্দ্র করে ট্র্যাজেডি হতে বাধা নেই। নীলদর্পণ সেই দিক থেকে ট্র্যাজেডি হয়েছে কিনা, তাই নিয়ে মোহিতলাল মজুমদার কোনও কথা বলেন নি।

ড. সুকুমার সেনের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, তিনি নাট্যতন্ত্রের স্বরূপ সঠিক অনুধাবনই করতে পারেন নি। কারণ তিনি সরাসরি স্বীকার করেছেন যে নীলদর্পণ নাটকই নয় নাট্য চিত্র। যা নাটক নয় নাট্য চিত্র, তা ট্র্যাজেডি হয়েছে কিনা এ ভাবনার কোনও অর্থ নেই। তবুও তিনি নীলদর্পণের ট্র্যাজেডি না হওয়ার জন্য দায়ী করেছেন মৃত্যুর ঘনঘটা, যা ট্র্যাজেডিকে ‘তরল ও অবাস্তব' করে দিয়েছে। ট্র্যাজেডি তরল ও অবাস্তব হয়েছে বললে একথা বলা হল যে নীলদর্পণ ট্র্যাজেডি হতে পারে নি। ট্র্যাজেডির যে অনেক রকমফের আছে, ড. সেন সে ব্যাপারে নীরব।

ড. অজিতকুমার ঘোষ 'নীলদর্পণ'কে 'হরর ট্র্যাজেডি' বলে স্বীকার করে নিয়ে তাঁর সিদ্ধান্তকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। কিন্তু তিনি যখন বলেন, “এই নাটকেও তেমনি বারবার মৃত্যু দেখাইয়া মৃত্যুর ট্র্যাজিক অনুভূতি নষ্ট করিয়া দেওয়া হইয়াছে”, তখন বিভ্রান্তি জাগে। নাট্যতত্ত্বরে ড. ঘোষ নিশ্চয়ই জানেন বারবার মৃত্যু ট্র্যাজিক অনুভূতিকে নষ্ট করে দেয় না। কেননা তাহলে স্বীকার করে নেওয়া হয় 'নীলদর্পণ', 'হরর ট্র্যাজিডি ও হয় নি। বারবার মৃত্যুর দৃশ্য যথার্থভাবে উপস্থাপিত হয়েছে কিনা, ড. ঘোষ সে সম্পর্কে নীরব। তিনি তাঁর বক্তব্যের মধ্যে স্পষ্টতা আনতে পারেন নি একথা সমালোচনার খাতিরে স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।

ড. সুশীলকুমার দে নীলদর্পণ নাটকের প্রকৃতি বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন।
তিনি ট্র্যাজেডির আধুনিক কালের সংজ্ঞার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। কিন্তু শেষে তিনি স্বীকার করেছেন, নীলদর্পণে টাজেডি হয় নি। তিনি প্রতায় দৃঢ় ভঙ্গিতে বলেছেন, “ট্র্যাজেডির মূলে যে সূক্ষ্ম ভাব কল্পনা থাকে, যাহা কেবল বাহিরের ঘটনা রূপ দৈব নয়, অন্তরের পরস্পর দ্বন্দ্ব প্রবণ প্রবৃত্তিকেও মানুষের নিয়তি বলিয়া গ্রহণ করে তাহা নীলদর্পণে নাই বলিলেও চলে।” ড. দের মতে নীলদর্পণে যে দ্বন্দ্ব আছে, তা কিন্তু বহির্দ্বন্দ্ব। তিনি ট্র্যাজেডির আধুনিক সংজ্ঞার কথা বললেও সেই সংজ্ঞা নিয়ে কোনও আলোচনা করেন নি। এমন কি তিনি নীলদর্পণ ট্র্যাজেডি হয়েছে কিনা, সেই মীমাংসায় না গিয়ে নাটকটিকে করুণ রসাত্মক বলে তাঁর দায়িত্ব শেষ করেছেন।

উল্লিখিত আলোচকদের মধ্যে কেবল বঙ্কিমচন্দ্র বাদে আর সবাই ট্র্যাজেডি ও মেলোড্রামার প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। দুঃখের বিষয়ে তারা এই দুটি বিষয়ের বিশদ আলোচনাকে উহ্য রেখেছেন। আরও একটি কথা, এঁরা কেউই ভারতীয় নাট্যাদর্শের ধারে কাছে যান নি। তাঁরা পাশ্চাত্য তথা অ্যারিষ্টটলীয় নাট্যতত্ত্বের দ্বারস্থ হয়েছেন। অ্যারিষ্টটল তাঁর পোয়েটিকস গ্রন্থে কেবল মাত্র দুটি নাট্য প্রকরণের কথা বলেছেন—ট্র্যাজেডি ও কমেডি। তাঁর মতে ট্র্যাজেডিতে সেইসব নায়কের জীবনের ভয়ানক ও করুণ ঘটনার বিবরণ থাকে, যারা নিদারুণভাবে বিপর্যস্ত হয়। কমেডিতে নিম্নস্তরের মানুষের জীবনের হাস্যরসাত্মক ঘটনার উপস্থাপনা প্রাধান্য পায়, যার পরিণাম আনন্দময়।

অ্যারিষ্টটলের নাট্যভাবনা রোমান ট্র্যাজেডি ও কমেডির উপর প্রভাব বিস্তার করে। রোমান নাট্যকার সেনেকার ট্র্যাজেডির ভয়ানক রসই অধিক পরিমাণে প্রাধান্য পেয়েছে। তার ফলে এই ট্র্যাজেডি নৈতিকতার বোধ (moral sense) তৈরি করে দেয়। রোমান ট্র্যাজেডি হরর ট্র্যাজেডি (Horror tragedy) নামে চিহ্নিত হয়। আর কমেডিগুলি হল নিউ কমেডি। রোমান ট্র্যাজেডি ও কমেডি রচনার পরবর্তীকালে নাটকের নানা নতুন শ্রেণী বিভাগের আবির্ভাব ঘটতে থাকে। সেই সঙ্গে ট্র্যাজেডির ভাষায় লক্ষণীয় পরিবর্তন আসে। ট্র্যাজেডির ইতিহাসে এই পরিবর্তন আনে নবতর সংযোজন। পূর্ববর্তী কালে ট্র্যাজেডিতে নায়ক হতেন কোন ঐতিহাসিক ব্যক্তি বা রাজা। অ্যারিষ্টটল অবশ্য ট্র্যাজেডির নায়ককে ঐতিহাসিক হতেই হবে, একথা বলেন নি। তবে তাঁকে উচ্চবংশীয় ও গুরুগম্ভীর হতেই হবে। নবজাগরণের অব্যবহিত পরবর্তীকালের ট্র্যাজেডিতে দেখা যেতে থাকে রাজা বা সম্রাট ধ্বংস বা মৃত্যু। কিন্তু সেই সময় ডোমেষ্টিক ট্র্যাজেডির (Domestic Tragedy) সৃষ্টি হয়। নাট্যকার মার্লোর ডাঃ ফসটাসে ট্র্যাজেডির নায়ক চিত্রণের ভাবনায় প্রভূত পরিবর্তন লক্ষিত হয়। তখন থেকে ট্র্যাজেডিতে রাজপরিবারের কোন ব্যক্তিকে নায়ক বা কোন বিশাল ঘটনাকে বিষয় করতে হবে, এই দীর্ঘদিনের পোষিত ধারণার অবসান ঘটতে থাকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য নবজাগরণের পর ট্র্যাজেডি কমেডি জাতীয় একধরনের নাটকের রচনা প্রাধান্য পেতে থাকে।

অষ্টাদশ শতাব্দীর য়ুরোপে নাটকের নানাবৈচিত্র্য সৃষ্টি হতে থাকল। তখন থেকে নানা বিচিত্র শ্রেণীর নাটকের দেখা মিলল। এই শতাব্দীতেই সিরিয়াস ড্রামা অর্থাৎ ট্র্যাজেডির শ্রেণী বিভাগের মধ্যে একটি উপবিভাগ দেখা দিল। এই উপবিভাগটিতে পড়ে মেলোড্রামা। অ্যাটিল কৃত ট্র্যাজেডির শ্রেণীবিভাগ ৫টি—১. কমপ্লেকস ট্র্যাজেডি ২. সিম্পল ট্র্যাজেডি ৩. প্যাথেটিক ট্র্যাজেডি ৪. এথিক্যাল ট্যাজেডি ও ৫. স্পেকটাকুলার ট্র্যাজেডি। শেষোক্ত ট্র্যাজেডি অ্যারিষ্টটলের মতে নিকৃষ্ট ট্র্যাজেডি। এই নাটকের করুণরস বাহ্য ঘটনা ও দৃশ্যের দ্বারা ঘনীভূত হয়। এইসব বাহ্যদৃশ্য ও ঘটনা রসাবেদন সৃষ্টিতে অনৌচিত্যের আমদানি ঘটায়। এর ফলে অতি নাটকের আবির্ভাব হয়। মেলোড্রামা শব্দটি দুটি শব্দ নিয়ে গঠিত— melos (গীত) ও drame (নাট্য)। এর আভিধানিক অর্থ হল গীতিনাট্য। মধ্যযুগের ইতালিতে অপেরাকে বলা হত গীতিনাট্য। ইতালি থেকে ফ্রান্সে অপেরা গীতিনাট্য হিসাবেই আনীত হয়। কিন্তু অবশেষে শব্দটি একটি বিশিষ্ট অর্থে গৃহীত হতে থাকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে অপেরা বলতে ভেসে উঠতে থাকে এক ধরনের নাট্য রচনা যা নিকৃষ্ট ভাবনার বলগাহীন অসংযত আবেগ সৃষ্টি করে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে এবং বিংশ শতাব্দীতে melodrama কে আর অপেরা বলা হয় না। সেইসব নাট্য রচনাকে melodrama বলা হয়, যা চপল ভাবোচ্ছ্বাসে ভরা চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী ঘটনাযুক্ত ও ধরাবাঁধা চরিত্রের করুণ পরিণতির রসাবেদন জাগায়। melodrama-র স্বরূপ ব্যখ্যা করেছেন অ্যালারডাইস নিকল তাঁর 'থিয়োরী অব ড্রামা' গ্রন্থে। তিনি প্রকারান্তরে বলতে চেয়েছেন ব্যর্থ ট্র্যাজেডিই মেলোড্রামা। নিকলের এই মত অনেককাল ধরে গৃহীত হয়ে আসছে। কিন্তু ইদানীং স্বীকৃত হয়েছে ট্র্যাজেডি ব্যর্থ হলেই মেলোড্রামা হয় না, এমনকি যে ট্র্যাজেডি রসোত্তীর্ণ হয় নি, তাও মেলোড্রামা নয়। অধ্যাপক সাধন ভট্টাচার্য এই মত সমর্থন করেন। তাঁর মতে ব্যর্থ ট্র্যাজেডি প্রকৃত পক্ষে ট্র্যাজেডিই। আসল কথা হল ট্র্যাজেডি ও মেলোড্রামা দুই ভিন্ন নাট্যপ্রকরণ। এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বিচার করতে হবে ‘নীলদর্পণ'–এর প্রকৃতি কোন জাতীয়।

প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো, নীলদর্পণে মেলোড্রামার অনেক বৈশিষ্ট্য আছে, চরিত্রগুলিও অনেক ক্ষেত্রে যথার্থভাবে পরিণত ও বিকশিত হয় নি। এমনকি অনৌচিত্যতার দোষও এই নাটক কাটিয়ে উঠতে পারে নি।

নীলদর্পণ নাটকে নীলকরদের নিগ্রহ মাত্রাহীন ভাবে প্রদর্শিত হয়েছে। অসহায় চাষীরা নির্মমভাবে জর্জরিত হয়েছে। তাদের জমি কেড়ে নেওয়া হয়েছে, সেই সঙ্গে তাদের ঘর থেকে বলদ লাঙল নিয়ে আসা হয়েছে, তাদের ঘরের স্ত্রী ও কন্যারা অপহুতা ও লাঞ্ছিতা হয়েছে। চাষীদের সমবেত প্রতিরোধ ধ্বংস হয়ে গেছে। এই চাষীদের রক্ষা করতে গিয়ে নবীনমাধব নিজের জীবনকে বিপন্ন করেছে। তাদের জমিতে নীলচাষ করা হয়েছে, তাদের প্রাপ্য পাওনা নীলকররা মেটায় নি। তাদের পুকুরঘাটের লাগোয়া জমিও নীলচাষের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে। তবুও নবীনমাধব নীলকরদের কাছে মাথা নোওয়াতে চায় নি। তাকে শায়েস্তা করার জন্য তার পিতৃদেব নীরিহ ভদ্রলোক গোলোকচন্দ্র বসুকে মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে নীলকরেরা কারাগারে পাঠিয়েছে। তিনি আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগায় উদ্বন্ধনে আত্মহত্যা করেছেন। নীলচাষে বাধা দিতে গিয়ে নবীনমাধব নীলকরের হাতে নিহত হয়েছে। স্বামী ও জ্যেষ্ঠ পুত্রের অপ্রত্যাশিত মৃত্যুতে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন সাবিত্রী। উন্মাদিনী অবস্থায় তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র বধুকে নীলকর সাহেবের চরিত্রহীনা বিবি ভেবে নিয়ে তিনি তাকে নিজ হাতে হত্যা করেছেন। সাধুচরণের বিবাহিতা গর্ভবতী কন্যা ক্ষেত্রমণি নীলকরের দ্বারা শারীরিক ভাবে লাঞ্ছিত হয়ে প্রাণ দিয়েছে। এই অসহায় দুঃখ লাঞ্ছনা ও মৃত্যুবরণ কোনটাই আকস্মিক দুর্বিপাক নয়। এগুলি বহিরঙ্গ ঘটনার পরিণতি হতে পারে নাট্যকার এগুলিকে বাস্তব পরিপ্রেক্ষিত রচনার মাধ্যমে অপূর্ব কৌশলে দেখিয়েছেন। গোলোকচন্দ্রকে উপযুক্ত শলা পরামর্শ করেই জেলে ঢোকান হয়েছে। আসলে নবীনমাধবকে শায়েস্তা করার জন্যই এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে নীলকরেরা। নবীনমাধব নায়কোচিত গুণে ভরপুর। সে প্রজাদরদী। প্রজা উৎপীড়নকারীর সঙ্গে তার কোন আপস নেই। নায়কের দ্বন্দ্ব বহিরঙ্গের। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। এই দ্বন্দ্ব তাৎপর্যহীনও নয়, তৎকালীন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করার মানসিকতা থেকেই এই দ্বন্দ্বের আবির্ভাব। প্রজাহিতৈষিতাই এই দ্বন্দ্বের জন্ম দিয়েছে। তখন বাঙালীর অস্তিত্বরক্ষার লড়াই শুরু হয়েছে। নবীনমাধব এই লড়াইয়ের সেনাপতিত্ব আপন স্কন্ধে তুলে নিয়েছে। ভীরুর মত আপন স্বার্থ সিদ্ধির দিকে তাকিয়ে গ্রামান্তরে পালিয়ে যায় নি বা নীলকরের হাতে হাত মেলায় নি। তার প্রতিফল সে হাতে হাতেই পেয়েছে। প্রজা মঙ্গল কামনা নায়ককে প্রবৃত্তির বশে বশীভূত করেছে। তার ফলে বসু পরিবারে নেমে এসেছে করুণ নিষ্ঠুর এবং ভয়াবহ পরিণতি। অতএব নীলদর্পণের বিষয় সামাজিক ট্র্যাজেডির অনুকূল। নবীনমাধব এই সামাজিক ট্র্যাজেডির উপযুক্ত নায়ক। নবীন মাধব অসাধারণ বংশের সন্তান না হতে পারে কিন্তু অসাধারণ গুণের অধিকারী। তার শারীরিক সৌন্দর্য, তার বিদ্যানুরাগ, তার পরিবারের প্রতি আনুগত্য, পিতামাতার প্রতি পরম শ্রদ্ধা এবং সর্বোপরি প্রজাহিতৈষিতা তার অশেষ গুণের পরিচয় বহন করে। তার সাহসও অপরিসীম। তার ন্যায় ও নীতিবোধও অসাধারণ। মোট কথা নবীনমাধব একজন মহাপ্রাণ ব্যক্তি। এই মহাপ্রাণতাই তার শোচনীয় পরিণতির জন্য দায়ী। তাই তাকে নিয়ে গেছে সংগ্রামের পথে। এই সংগ্রাম অসম ও এ কথা ঠিক কিন্তু নির্ভীক। তার ফলেই নাটকের পরিণতিতে এসেছে ভয়ানক ও শোকাবহ পরিবেশ। এই পরিণাম বিষাদান্ত। মৃত্যু, হত্যা, উন্মত্ততা, প্রলাপ বিলাপ সমস্তই এসেছে নির্দিষ্ট নিয়মে। ট্র্যাজেডির বহিরঙ্গের লক্ষণ সবই এই নাটকে রয়েছে। নাটকের শেষে করুণরসের আধিক্য আছে একথা অস্বীকার করা যাবে না। এটাই একমাত্র নাটকের ত্রুটি। কিন্তু এই ত্রুটি নাটকটিকে মেলোড্রামায় পর্যবসিত করে নি। নীলদর্পণ ট্র্যাজেডি, কিন্তু যথার্থ রস সমন্বিত ট্র্যাজেডি হতে পারে নি। এই নাটকে মেলোড্রামসুলভ ঘটনা বিন্যাস আছে, একথা স্বীকার্য। কিন্তু নাটকটির বিষয়বস্তুর গাম্ভীর্য ঘটনার গুরত্ব, নায়ক নবীনমাধবের জীবনের সংগ্রাম এবং শেষে শোচনীয় পরিণতি নাটকটিকে মেলোড্রামার পর্যায়ভুক্ত করে নি। এই কারণেই বঙ্কিমচন্দ্র নাটকটিকে কাব্যগুণে উৎকৃষ্ট বলেছিলেন, তার কিছু ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন